মতামত

শ্রম বিধিমালা ২০১৫ সংশোধনী (শেষ পর্ব)

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

বিধিমালা সংশোধনীর ৪৩ ক্রমিকে বিধি ১১০ এ নতুন সংযোজিত উপবিধি ৫ এ উৎসব ছুটির ক্ষতিপূরণমূলক মজুরি হিসাব করতে মূল মজুরিকে ৩০ দ্বারা ভাগ করে ১ দিনের ক্ষতিপূরণমূলক মজুরি গণনা করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু শ্রম আইনের ধারা ১১৮তে উল্লেখ আছে একদিন উৎসব ছুটির জন্য ২ দিনের ক্ষতিপূরনমূলক মজুরি এবং ১ দিন বিকল্প ছুটি দিতে হবে। অর্থাৎ শ্রম আইন অনুযায়ী একদিন উৎসব ছুটির জন্য ক্ষতিপূরণমূলক মজুরি নির্নয় করতে হলে মোট মজুরিকে বিবেচনায় নিতে হবে। সংশোধিত বিধিটি মূল আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং এর মাধ্যমে শ্রমিকেরা পূর্বের তুলনায় কম মজুরি পাবে। তাছাড়া কোন সুযোগ বা অধিকার একবার প্রয়োগ হয়ে গেলে পরবর্তীতে কোন সংশোধনীতে সেই সুযোগ বা অধিকার কমানোর কোন সুযোগ থাকেনা। এবারের বিধিমালা সংশোধনীতে সাধারণ এই নীতিটাও মানা হয় নাই।

সংশোধনীর ৪৪ ক্রমিকে, বিধি ১১১ এর উপবিধি ৫ এর শেষে নতুন সংযুক্ত যে সকল সেক্টরে নিম্নতম মজুরি প্রযোজ্য নয়, সেসকল সেক্টরে মূল মজুরি, মোট মজুরির ৫০% এর কম হবেনা উল্লেখ করা শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা মূল মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের ওভার টাইম কাজের মজুরি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের চাঁদা কর্তন, বাৎসরিক উৎসব বোনাস,বাৎসরিক মজুরি বৃদ্ধি, চাকুরী অবসানে চূড়ান্ত পাওনার হিসাব নির্ধারন করা হয়। তাই শ্রমিকের মোট মজুরি নির্ধারনের পাশাপাশি  মূল মজুরি নির্ধারনও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  এখানে ৫০% স্থলে ৫৫% করা সুপারিশ করছি।

এছাড়া বিধি ১১১ এর উপবিধি ৫ এ পূর্বে পূর্বে উল্লেখ ছিল বোনাস মূল মজুরির অধিক হবেনা। এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। কেননা আইন বা বিধি হচ্ছে ন্যুনতম শ্রমমান।  সুতরাং আইন বা বিধির মাধ্যমে কখনো সর্বোচ্চ পরিমান নির্ধারন করে দেওয়া উচিৎ নয়। তাই বিধি ১১১ এর উপবিধি ৫ এ উল্লেখিত “বোনাস মূল মজুরির অধিক হবেনার” পরিবর্তে  “বোনাস মূল মজুরির কম হবেনা” যুক্ত করা সুপারিশ করছি। বহুল বিতর্কিত এই বিধিটি বাতিল করার ছিল সময়ের দাবি কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এরূপ একটি বহুল বিতর্কিত এবং সমালোচিত বিধিও সংশোধন করতে পারলো না আমাদের শ্রম মন্ত্রণালয়।

সংশোধনীর ৭৪ ক্রমিকে, বিধি ২১২ এর উপবিধি ১ এর শেষে নতুন সংযুক্ত – “শতভাগ রপ্তানীমুখী শিল্প তহবিল স্থাপিত হলে কোম্পানীর মুনাফায় শ্রমিকের অংশগ্রহণের বিধান প্রযোজ্য হবে না “ অনুচ্ছেদটির মাধ্যমে রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঠকানোর একটা পায়তারা করা হচ্ছে বলে আমি মনে করি। সুতরাং এই অনুচ্ছেদটি বাদ দেয়ার সুপারিশ করছি। অবশ্য এখনো রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস এ  শ্রমিকেরামালিকের  লভ্যাংশ বঞ্চিত হচ্ছে কিন্তু আইন করে সেটা বন্ধ করে দেয়া হলে তারা আরো বেশি বৈষম্যের শিকার হবে যা কাম্য হতে পারে না। অনেকে হয়তো বলবেন গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্রীয় তহবিল আছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় তহবিল হতেতো শ্রমিকেরা লভ্যাংশ পাচ্ছেনা।

আইন বা বিধিমালা সংশোধনের লক্ষ হওয়া উচিৎ  বিদ্যমান আইন বা বিধির ত্রুটি নির্নয় করে তা সংশোধন পূর্বক উক্ত আইন বা বিধির মাধ্যমে  যাতে ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে কাজ করা যায়। অথচ লক্ষনীয় ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশে ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়নের পর ২০১৩ সাল এবং ২০১৮ সালে দুটি বড় ধরণের সংশোধনী হয়েছে। আবার ২০১৫ সালে বিধিমালা প্রণয়নের পর এই বছর তথা ২০২২ সালে বিধিমালা সংশোধন করা হয়েছে বটে কিন্তু বরাবরের মত এবারের সংশোধনীও শ্রমজীবী মানুষের  প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।

শিল্পের প্রধানত পক্ষ দুইটি। মালিক এবং শ্রমিক। রাষ্ট্র একটি অন্যতম শক্তিশালী পক্ষ হলেও তার নিরপেক্ষ অবস্থান থাকা বাঞ্চনীয়। শিল্পের স্থিতিশীলতা এবং শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে এটা খুবই জরুরী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সে নিরপেক্ষ আচরণ পাওয়া যাচ্ছেনা। ফলে শ্রম আইন এবং বিধিমালা প্রণয়ন ও সংশোধনীর সময় প্রতিবারই বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা থেকে শ্রমিকের পক্ষের সুযোগ সুবিধাগুলো ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করা হয়। এতে আপাত দৃষ্টিতে মালিক পক্ষ লাভবান হচ্ছে মনে করা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে শিল্পের স্থিতিশীলতা ও শৃংখলা বিনষ্ট হতে বাধ্য। অস্থিতিশীল এবং বিশৃংখল শিল্প পরিবেশ প্রকৃত বিচারে দেশের অর্থনীতির জন্য ভাল ফল বয়ে আনতে পারে না।

বাংলাদেশে শ্রমিক সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় কোটি। শ্রমিক সংখ্যার বিচারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। এই বিশাল সংখ্যক শ্রমিককে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে এদেশের শিল্পখাত তথা অর্থনীতির চাকা বেগবান করা সম্ভব। শ্রমিকের আইনগত অধিকার অর্জনের মধ্য দিয়ে তার যে মানসিক দৃঢ়তা তৈরি হবে তা প্রকারন্তরে শ্রমিকের কর্মদক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা  বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তাই শ্রম আইন ও বিধিমালা সংশোধনীর সময় রাষ্ট্র আরো দায়িত্বশীল হবে এমনটিই প্রত্যাশা।

-সমাপ্ত-

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি