মতামত

ভিন্নমত

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রস্থান : অশ্রু বিহীন শোক

-অপু সারোয়ার

ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ ৯৬ বছরে মারা গেলেন ৯ সেপ্টেম্বর ২০২২। রানী ব্রিটেনের রাষ্ট্র প্রধান।  রানী এলিজাবেথের মৃত্যু ঘোষণার ফলে বিশ্বজুড়ে সরকারী শোক বার্তার ঝড় বইছে। সিংহাসনে  সাত দশক ধরে জাতি ও কমনওয়েলথের প্রতি তার কথিত প্রতিভা এবং সেবার প্রশংসা করেছেন সবাই। রানী এলিজাবেথের ১৯৫৩ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। সেই সময়ে একটি বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধিকর্তা হলেন রানী এলিজাবেথ। এই সাম্রাজ্য লক্ষ লক্ষ আইরিশ, আরব, আফ্রিকান,ভারতীয়  এবং এশীয়দের রক্ত ঘাম শোষণের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল। রাজতন্ত্রের  অসামান্য গহনার প্রতিটি টুকরো, প্রতিটি মুকুট এবং  রাজকীয় সংগ্রহে থাকা প্রতিটি হীরা- জহরত  উপনিবেশিক জন সাধারণকে চরম শোষণের মাধ্যমে গড়ে তোলা। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বেশিরভাগই ধীরে ধীরে রানির রাজত্বকালে উপনিবেশিক শাসন ছিন্ন করে । কিন্তু রাজপরিবারের অনুগ্রহের ফলে কোন উপনিবেশিক শাসনের অবসান হয় নাই।  অনেক ক্ষেত্রে, উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়েছিল । ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনী প্রতিটি উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামকে নির্মম ভাবে দমন করতে  সক্রিয় ছিল।  ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান কমান্ডার হিসাবে, রানী এই সব  বর্বরতার দায় এড়াতে পারেন না।

রানীর মৃত্যুতে বাংলাদেশ ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ! বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সম্পর্ক শিকড় উপড়ানো গাছের পল্লবিত  লতায় পাতায় । সম্পর্কের শিকড় উপরে ফেলা হয়েছে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বিতরণের মধ্যে দিয়ে। অধিকাংশ দেশেই বৃটিশ উপনিবেশ বাদের অবসান হয়েছে আপোষ রফার মাধ্যমে। ভারত -পাকিস্তান বিভক্তি হচ্ছে এই আপোষ রফার ফসল। এই সম্পর্কের অবকাঠামো হচ্ছে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশের প্রতীক। পাকিস্তান শাসনামলে মুসলিম লীগ ও আওয়ামীলীগ উভয়ই রাজনৈতিক দল ইঙ্গ- মার্কিনী নীতির সমর্থক ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর , শেখ মুজিবর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে  লন্ডন- দিল্লী হয়ে ঢাকায় ফেরেন। শেখ মুজিবর রহমানের এই যাত্রা ছিল শিশু রাষ্ট্র বাংলাদেশের ভবিষৎ পররাষ্ট্র নীতির পদ চিহ্ন। গত পাঁচ দশকে  বিভিন্ন সরকারের সময় পররাষ্ট্র নীতির কিছু হয়েছে তবে লন্ডন মুখী নীতির কোন তারতম্য হয় নাই।

আধুনিক কমনওয়েলথ গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে।২০১২ সালের আগে কমনওয়েলথের  কোন সংবিধান ছিল না।   কমনওয়েলথ অব নেশন্স বা কমনওয়েলথ ( Commonwealth of Nations) অতীতে ব্রিটিশ উপ কমনওয়েলথ দেশের সংখ্যা ৫৪। নিবেশ ভুক্ত   ছিল এমন স্বাধীন রাষ্ট্র  নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা। কমনওয়েলথ হচ্ছে প্রাক্তন ঔপনিবেশিকতার শিকার দেশ গুলির একটি ক্লাব। তবে  সদস্যরা মনে করে থাকে  দেশগুলোর উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে কমনওয়েলথ । এ পর্যন্ত কমনওয়েলথের  প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন ব্রিটিশ রাজতন্ত্র । যদিও সদস্যদেশ গুলোর কমনওয়েলথের  প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হবার উপরে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই । দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়  ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা , বার্মা, মালোশিয়া কমনওয়েলথ  ভুক্ত দেশ। ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ – রাজতন্ত্র কমনওয়েলথ ভুক্ত ১৬টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান । বাকি দেশগুলোর ছয়টিতে নিজেদের রাজা রয়েছে আর ৩১টি দেশ প্রজাতন্ত্র।  যে সমস্ত দেশে রাষ্ট্র প্রধান ব্রিটিশ রাজতন্ত্র সেই দেশ গুলিতে রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে এক জন স্থানীয়  নাগরিক  গভনর জেনারেল পদ মর্যদায় রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। ১৯৯১ সালে সেভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয়ের পর থেকে কমনওয়েলথ আন্তর্জাতিক ভাবে ধীর পদক্ষেপে নতুন জোটে রূপান্তরের চেষ্টা করে আসছে। এই প্রচেষ্টায় ১৯৯৫ সালে মোজাম্বিক এবং  ২০০৯ সালে রোয়ান্ডা কমনওয়েলথের সদস্য করে নেয় । কিন্তু দেশ দুটি কখনোই ব্রিটিশ কলোনি ছিল না। এই দেশ দুইটি  জার্মানি ও  বেলজিয়ামের উপনিবেশ  ছিল।

কমনওয়েলথ ভুক্ত তিনটি বড় দেশ কানাডা , অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সাংবিধানিক রাষ্ট্র প্রধান ব্রিটেনের রানী /রাজা। । এই দেশ গুলিতে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের নানা কাহিনী বহুল আলোচিত। অন্য কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ গুলির সাথে এই তিন দেশের পার্থক্য হচ্ছে এই তিন দেশে উপনিবেশ বিস্তার করতে সাদা চামড়ার মানুষদের বসতি স্থাপন করে স্থানীয়দেরকে নির্মূল করেছে। সেই থেকে এই দেশ সুমুহে ইউরোপীয় বংশভুতরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। কালের আবর্তনে ইউরোপীয় বংশোভূত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব বিভিন্ন ভাবে ধূমায়িত হয়েছে। এই ধূমায়িত ক্ষোভকে সামাল দিতেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতক্ষ্য শাসনের অবসান ঘটেছে ১৯০০ সালের শুরুর দিকে। সেই থেকেই ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এই দেশ গুলির সাংবিধানিক প্রধান। অস্ট্রেলিয়াতে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থেকে বেড় হয়ে আসার জন্য সক্রিয় আন্দোলন রয়েছে। কখনো কখনো এই আন্দোলন বেশ গতিশীল হয়ে উঠে। রয়েছে আদিবাসীদের অধিকারের নানান আন্দোলন। তিনশ বছরের দমন পীড়নে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অবস্থা অতি করুন। নিউজিল্যান্ডে রয়েছে মাওরি ( Māori ) জনগোষ্ঠীর আত্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষীণ বহমান আন্দোলন।

কমনওয়েলথ ভুক্ত ১৬টি দেশের সাংবিধানিক প্রধান ব্রিটেনের রাজতন্ত্র। তবে কানাডা-অস্ট্রলিয়া -নিউজিল্যান্ড ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রধান প্রতিনিধিত্বকারী দেশ হিসেবে পরিচিত ও বিবেচিত। সরকারী ভাবে এই দেশ গুলিতে শোক ও রাজতন্ত্রকে মহিমান্বিত করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা হয় নাই। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং প্রার্থনা শোকাহত রাজ পরিবারের সদস্য এবং যুক্তরাজ্যের শোকাহত জনগণের সাথে রয়েছে এবং আমরা মহামান্যের বিদেহী আত্মার চিরশান্তি ও পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা করছি।……, রানি শুধুমাত্র ২৫০ কোটি কমনওয়েলথ জনগণের স্তম্ভ এবং শক্তি ছিলেন না, বরং তিনি করুণা, মর্যাদা, প্রজ্ঞা এবং সেবারও প্রতীক ছিলেন। …..বিশ্বের সমসাময়িক ইতিহাসে কিংবদন্তী এবং দীর্ঘতম রাজত্বকারী রাজা হিসাবে কর্তব্য, সেবা এবং ত্যাগের সর্বোচ্চ মান স্থাপন করেছেন তিনি এবং বিশ্ব জুড়ে তাঁর অগণিত মানুষের কাছে উৎসর্গের একটি অতুলনীয় উত্তরাধিকার রেখে গেছেন।…….রানি আমার দেশের নাগরিকদের জন্য অনুপ্রেরণা, সাহস এবং শক্তির একটি দুর্দান্ত উৎস হয়ে থাকবেন। “- বিবিসি – ৯ সেপ্টেম্বর ২০২২।

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শোষণ – নিপীড়নে ভারত বর্ষে কোটি-কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায়।  শাসন-নিপীড়ণের প্রতিবাদ করতে যেয়ে হাজার হাজার মানুষকে খুন হতে হয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শোষকদের হাতে। এই অঞ্চলের মানুষদের হত্যা খুন ও সম্পদ লুন্টনে যে উপনিবেশিক দেশ র হাত রক্তাক্ত সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক রানী এলিজাবেথের মৃত্যুতে তিন দিন রাষ্ট্রীয় শোকের কেন দরকার হয়ে পড়লো তা বোঝা সাধারণের পক্ষে কঠিন।  রানি কখনোই বাংলাদেশের  দেশের নাগরিকদের জন্য অনুপ্রেরণা, সাহস এবং শক্তির একটি দুর্দান্ত উৎস  ছিলেন না  এবং কখনোই এমন হবার সম্ভবনা নেই।

## কার্টুন  ছবি – লাল বর্ণ