মতামত

দুর্নীতি ফাঁস করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেলেন এক বিক্রয়কর্মী

-সততার জন্য পুরস্কৃত না হয়ে হলেন তিরস্কৃত

প্রতীকী ছবি (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

বাংলাদেশের দক্ষিনে প্রত্যন্ত অঞ্চল সাতক্ষিরায় আমার জন্ম। বড় আশা নিয়ে চট্রগ্রামের একটি খুব বড় কোম্পানীতে “সেলস পারসন” হিসাবে যোগদান করি ২০১৮ সালের শেষের দিকে। প্রতি মাসে মায়ের চিকিৎসা ও ঔষধের খরচসহ নিজের ছোট্ট ২ বাচ্চাকে নিয়ে খুব সুখেই দিন কাটছিল আমার এবং পরিবারের সদস্যদের। কোম্পানী থেকে প্রাপ্ত বেতন দিয়েই আমি সাজাতে চেয়েছিলাম সুখের সংসার।
চাকুরিতে যোগদানের প্রথম বছর পর জানতে পারি কোম্পানীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের ছোট বড় দূর্নীতির অনেক গোপন সংবাদ। মালিকের দেয়া মাসিক উচ্চ বেতন এবং নানান সুযোগ সুবিধা পেয়েও তাদের মন-পেট কিছুই ভরছিলনা। ফলে উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই জড়িয়ে পড়েন নানান দুর্নীতির সাথে। নগণ্য একটি সেলস পারসন হিসাবে নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য পরোক্ষভাবে কোম্পানীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের দূর্নীতির বিষয়ে মুখ খুলেছিলাম। এটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। পুরস্কৃত হওয়ার পরিবর্তে তিরস্কৃত হলাম। আমাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হলো। দুর্নীতিবাজদের মাঝে যে একটা অশুভ আঁতাত আছে সেটা তখনো আমার জানা ছিলনা। এস্কল দুর্নীতিবাজরা তারা তাদের দুর্নীতি ঢাকা দেয়ার জন্য কত ভয়ংকর হতে পারে তা আমি এখন হারে হারে টের পাচ্ছি।
পদত্যাগের পর শ্রম আইন মোতাবেক আমার বকেয়া মজুরিসহ চূড়ান্ত হিসাবের পাওনা চাওয়া যেন আমার আরো বড়ো অপরাধ ছিলো! তাই আমার বিরুদ্ধে শুরু হয় ষড়যন্ত্রের নতুন নাটক। দেয়া হয় মিথ্যা মামলা। মিথ্যা মামলায় ইতিমধ্যে ১ মাস জেল খেটেছি। পরে জামিনে মুক্ত হয়েছি ঠিক তবে এরই মধ্যে আমার ১ লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমি একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার তেমন কোন জমানো টাকা না থাকায় আমার পরিবারকে ঋন করেই টাকা খরচ করতে হয়েছে। আমার পরিবার এখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
জেলে গিয়ে আরো নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার হল আমার। এখানে এসে জানলাম অধিকাংশ মানুষই ষড়যন্ত্রের শিকার। বড় বড় দুর্নীতিবাজরা বাহিরে বুক ফুলিয়ে রাজত্ব কায়েম করেছে আর নিরীহ অসহায় মানুষগুলো জেলের মধ্যে কিংবা জেলের বাহিরেও নানান হয়রানির শিকার হচ্ছে। সবচেয়ে কষ্টের জায়গা হচ্ছে যারা আইনের রক্ষা কবচ তারাই যেন আইন ভাঙ্গার মহোৎসবে মেতে আছে। তাদের সাথে অসৎ মানুষগুলোর রয়েছে অশুভ আঁতাত। আমি লক্ষ করেছি প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা এবং অসৎ লোকগুলোর মধ্যে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। যা ভাঙতে না পারলে অসহায় নিরীহ মানুষের মুক্তি কখনোই সম্ভব নয়। মানুষের অসহয়াত্ব নিয়েও এক শ্রেণির অনুভুতিহীন মানুষগুলো কী অবলিলায় একের পর এক দুর্নীতি করে যাচ্ছে সেটা আমি জেলে না গেলে বুঝতেই পারতাম না।
আমাদের দেশের কোম্পানির মালিক বা শিল্পপতিগণ (বিশেষ করে চট্রগ্রামের বড় কোম্পানির মালিকরা) তারা যেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর, কারন প্রধান মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগের অনেক মাধ্যম থাকলেও -চট্রগ্রামের শিল্পপতিদের সাথে যোগযোগ করা অসম্ভব এক ব্যাপার। আমি অনেক চেষ্টা করেও কোম্পানীর মালিকের সাথে দেখা করতে পারিনি। দেখা হলে হয়তো কোম্পানীর অভ্যন্তরে দুর্নীতির বিষয়ে বলতে পারতাম। কিন্তু চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম মালিকের চারিপাশে দুর্নীতিবাজদের শক্ত প্রাচীর -যা ভেদ করা যেন অনেকটা অসম্ভব। আমি পারিনি। ইহকালে আর পারবো বলেও মনে হয়না। এই দুর্নীতিবাজগুলোর সাথে কোম্পানীর মালিকেরাও জড়িত কিনা আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। কোথাও একটা শুভঙ্করের ফাঁকতো আছেই, তা না হলে এভাবে বছরের পর বছর দুর্নীতিবাজ চক্রগুলো দুর্নীতি করে যাচ্ছে -কোম্পানীর কোটি কোটি টাকা বেহাত হচ্ছে –তা কোম্পানীর মালিকেরা একেবারে বুঝেনা কীভাবে মেনে নেব।
আমার উপরের কথাগুলো অত্যন্ত হতাশার হলেও আমি স্বপ্ন দেখি একদিন এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। আমি জানি দুর্নীতিবাজরা আর্থিকভাবে এবং সামাজিকভাবে শক্তিশালী হলেও তারা সংখ্যায় খুবই নগন্য। দেশের অধিকাংশ মানুষ সহজ সরল এবং সৎ। কিন্তু সংকট হচ্ছে, এই মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন। ঠকতে ঠকতে যখন এই সকল সহজ সরল মানুষগুলো যদি একদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় তখন নিশ্চয়ই দুর্নীতিবাজরা পিছু হঠতে বাধ্য হবে। সেদিন হয়তো খুব বেশী দূরে নয়।

লেখক: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ঢেউ টিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত ছিলেন