শিল্প সাহিত্য

মিছিলের মুখ

-নাজিমুদ্দীন শ্যামল

ও মিছিল!
আমায় তোমার সাথে নাও।
একটা সময় আমারও ছিলো…
আমাদের তারুণ্যে কিংবা ছাত্র জীবনে…
কতো না হেঁটেছি পথ
তোমার সাথে!
পায়ে পায়ে পা মিলিয়ে,
হাতে হাতে হাত ধরে যেতে যেতে
স্লোগানে  স্লোগানে উড়িয়েছি
স্বপ্ন-কবুতর এই আকাশে।
কতো রাজপথ, গণপথ, পাড়ার গলি
হেঁটেছি অধিকারের কবিতা বলতে বলতে।

কতোকাল, চিরকাল আমরা হেঁটেছি
মিছিলের সাথে। কতো কথা বলেছি…
বলেছি :
‘আমার ভাষা তোমার ভাষা
বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা।’

তারপর গুলি এসে বিদীর্ণ করেছে,
রক্তে ঘামে সংগ্রামে জনপদ
একাকার। তারপরও মিছিল…

ও মিছিল,
আমরা হেঁটেছি তোমার সাথে
পায়ে পায়ে; সেøাগানে ¯েøাগানে।
বলেছি :
‘শিক্ষা সুযোগ নয়
জন্মগত অধিকার।’
‘অন্ন চাই বস্ত্র চাই,
বাঁচার মতো বাঁচতে চাই।’

তারপর রক্ত, হামলা, মামলা
নির্যাতনের খড়গ। কখনো কখনো
স্তম্ভিত জনতা। তবুও মিছিল
আমরা হেঁটেছি তোমার সাথে
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে,
বলেছি :
‘পদ্মা মেঘনা যমুনা
তোমার আমার ঠিকানা।’
‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর
বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’
‘রক্তের বন্যায়
ভেসে যাবে অন্যায়।’

অতপর পতাকা উড়েছে, উড়েছে
রক্তলাল কবুতর। কতো মুখ
হারিয়ে গেছে। আপনজন আর
ফেরেনি ঘরে। তথাপি মিছিল
থামেনি কখনো, মিছিল চলেছে
আর আমরা চলেছি মিছিলের সাথে।
বলেছি :
‘ভাত দে কাপড় দে
নইলে গদি ছেড়ে দে।’
‘শহীদের রক্ত
বৃথা যেতে দেব না।’
‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম
চলছে চলবে।’
‘শোষণ মুক্তির সংগ্রাম
চলছে চলবে।’
‘বাঁচার মতো বাঁচতে চাই
ভাত চাই, কাপড় চাই।’
‘শিক্ষা চাই, চাকরি চাই
লড়াই করে বাঁচতে চাই।’

তথাপি স্বপ্নরা চলেছে। স্বপ্নের
ফুলগুলো হলুদ হয়ে ঝরেছে।
রক্তের বন্যায় বয়ে গেছে
পদ্মা মেঘনা যমুনা। ও মিছিল,
আমরা তোমার সাথে ছুটেছিÑ
বানের পানির মতোন। পাখির মতো
পিষে মেরেছে আমাদের জলপাই বুট।
তবুও মিছিল চলেছে, মিছিল হেঁটেছে
রাজপথ, গণপথ ঘর গেরস্থালি
তছনছ করে মানুষ মিছিল করেছে।
বলেছে :
‘স্বৈরাচার নিপাত যাক
গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’
‘দুনিয়ার মজদুর
এক হও লড়াই করো।’
‘আপোষ না সংগ্রাম
সংগ্রাম সংগ্রাম।’
‘ক্ষমতা না রাজপথ,
রাজপথ রাজপথ।’
‘নুর হোসেনের রক্ত
বৃথা যেতে দেব না।’
‘বেঁচে থাকার আরেক নাম
গণতন্ত্রের সংগ্রাম।’
‘শোষণ মুক্তির আরেক নাম
সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম।’

ও মিছিল,
তোমার সাথে ঘরে ফিরলাম।
সকলে বললো গণতন্ত্র এসেছে।
বাতাসে পাখির কাকলি উড়ছে,
গাছে গাছে সবুজ পাতা, রঙিন ফুল।
ছেলেরা দল বেঁধে গাঙে ঝাঁপ দেবে;
মেয়েরা স্কুলে যাবে প্রজাপতির মতোন।
গায়েন গান গাইবে গলা ছেড়ে।
তারতো কিছুই হলো না। যার গায়ে
রক্তের দাগ তার মাথায় পতাকার
শিরস্ত্রাণ। যে মিছিলে চালিয়েছে
গুলি, গণতন্ত্রকে শরবতের মতোন
করেছিলো পান, সেতো বনে গেলো
মুসকিল আসান।

ও মিছিল,
দেখেছো তো বানরের পিঠাভাগ,
ক্ষমতার হালুয়া রুটির ভাগাভাগি।
দেখেছো তো বন্ধ কারখানার
নির্বাক যন্ত্রপাতির বোবা কান্না।
দেখেছো তো হাড় জির জিরে
বস্ত্রবালিকার জীবন্ত পুড়ে মরা,
দেখেছো তো পেট্রোল বোমা,
ক্রসফায়ার, গুম, অপারেশন ক্লিন হার্ট
মিছিলের লাশের বেচাকেনা।
দেখেছো তো গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণ,
রাজাকারের আস্ফালন আর
আমজনতার নিত্যদিনের মরণ-জ্বলন।
তারপর জিন্দাবাদ, তারপর জয় বাংলা
অতপর চিরজীবী হোক বাংলাদেশ।
তবুও মানুষের সংগ্রাম হয় না আর শেষ।
তবুও মানুষের মিছিল হায় হয় না তো শেষ।

ও মিছিল,
ও বেঁচে থাকার স্বপ্ন
ও আগামীর বাংলাদেশ,
এত বছর
এত যুগ
এত মৃত্যু
দেখতে দেখতে এখনো চলছো
রাজপথে হেঁটে হেঁটে। এখনোতো
চলছো সাহসী মানুষের মনে মনে
দ্রোহের রক্তে রক্তে। কত মুখ
হারিয়ে গেছে মিছিল থেকে,
কতো স্বপ্ন যোজিত হলো
এই মিছিলে। দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য
মানুষের মিছিল চলছে;
বাঁচার সংগ্রাম চলছেই চলছে,
মুক্তির মিছিল চলছেই, চলবে…

 

নাজিমুদ্দীন শ্যামল: কবি ও সাংবাদিক