চলমান সংবাদ

পতেঙ্গা সি বিচ বেসরকারি কোম্পানিকে ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া সচেতন নাগরিকদের ক্ষোভ

চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত একটি অংশ বেসরকারি কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সমুদ্র সৈকতের জায়গাটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-চউক’র না হলেও ইতিমধ্যে সৈকতের একাংশ ২৫ বছরের জন্য বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য টেন্ডার আহ্বান করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রাকৃতিক অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত উন্মুক্ত সাগর পাড় বেসরকারি খাতে ইজারার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের মানুষ। চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকবৃন্দ বলছেন, এটি হলে সেখানে সর্বসাধারণের অবাধ যাতায়াতের অধিকার খর্ব হবে। জনগণের সম্পদ থেকে জনগণকে বঞ্চিত করে বাণিজ্যিকভাবে ইজারা দেওয়া আইন বিরোধী। চউক জানায়, পতেঙ্গা সৈকতের টানেল প্রান্ত থেকে রাশমনি ঘাট পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার অংশকে দুটি জোনে ভাগ করে ২৫ বছরের জন্য ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যা বাস্তবায়ন হবে ২০২৪ সালে। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের প্রায় ৭ কিলোমিটারের মধ্যে দেড় কিলোমিটার অংশ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় অর্থাৎ ইজারা দিয়ে নতুন আঙ্গিকে পর্যটন জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে সিডিএ। ওই অংশটি বিশেষ জোন হিসেবে পরিচালনা করার জন্য একজন অপারেটরকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। সেখানে রাইডসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। এর থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বাকি পাঁচ কিলোমিটার অংশ রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। পাঁচ কিলোমিটার অংশ উন্মুক্ত থাকবে। প্রস্তাবনা ছিলো, ৭শ মিটারের মূল সৈকতে প্রবেশে পর্যটকদের গুণতে হবে প্রবেশ ফি। চউক’র এমন উদ্যোগের বিরোধিতা করে শুরু থেকে তার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ। কিন্তু চউক ইজারাদার নিয়োগে অনড় রয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বলেন, পতেঙ্গা বিচের জমির মালিকানা চউক’র নয়। এর মালিকানা জনগণের, রাষ্ট্র এখানে জনগণের নিমিত্তে ট্রাস্টি হিসেবে তা সংরক্ষণ করবে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্টের প্রদত্ত ঐতিহাসিক রায়ে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮’র ক, ২১, ৩১, ৩২ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে বলা হয়, পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, সমুদ্র সৈকত, নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওর, ঝিল, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন এবং বাতাস ইত্যাদি সবকিছুকে পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি বা জনগণের সম্পত্তি। এগুলোর কোন একটির অধিকার থেকে নাগরিকদেরকে বঞ্চিত করা সংবিধান পরিপন্থী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব সম্পত্তি সব নাগরিকের, কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়। এসব পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তিতে সাধারণ জনগণের মুক্ত এবং বাধাহীন ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে রাষ্ট্র। এসব পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি কোন ব্যক্তি বা কোম্পানিকে বাণিজ্যিকভাবে ইজারা দেওয়া যাবে না। ফলে চউক’র এ সিদ্ধান্ত স্পষ্টত বাংলাদেশের সংবিধান, আইন ও উল্লেখিত রায়ের পরিপন্থী। পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি ড. মু. সিকান্দার খান বলেন, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত প্রকৃতির দান। জনগণই এর মালিক। এখন বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়া হচ্ছে, যা জনগণের স্বার্থে করা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠজনদের স্বার্থে তা করা হচ্ছে। সমুদ্রসৈকতের দেড় কিলোমিটার অংশ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দিলে তাতে সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব হবে। উন্মুক্ত সমুদ্র সৈকত ইজারার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, পতেঙ্গা সি বিচ একটি পাবলিক বিচ ও প্রাকৃতিক সম্পদ। এর উপর সবার সমান ও অবাধ অধিকার প্রাকৃতিক, এ অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যায় না। সম্প্রতি চউক পতেঙ্গা সি বিচ বেসরকারি কোম্পানিকে ইজারা দেওয়ার জন্য টেন্ডার আহবান করেছে। সি বিচের মতো প্রাকৃতিক উন্মুক্ত স্থান বাণিজ্যিকীকরণের তৎপরতা, এক্সক্লুসিভ জোন করা এবং এর মাধ্যমে শুধু সামর্থ্যবানদের প্রবেশ করতে দেওয়া মানুষের অধিকারকে খর্ব করার শামিল। তিনি বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের অজুহাত দেখিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের একাংশকে প্রাইভেট জোন ঘোষণা করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়ার প্রক্রিয়া গণবিরোধী প্রক্রিয়া। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত প্রকৃতির দানে গড়ে ওঠা সম্পদ, কোনো ব্যক্তিবিশেষের তৈরি নয়। জনগণের সম্পদ। বেসরকারি খাতে সৈকত দিয়ে দিলে সেখানে সর্বসাধারণের অবাধ যাতায়াতের অধিকার খর্ব হবে। আপামর জনসাধারণের অধিকার খর্ব করে জনগণের সম্পদ শুধুমাত্র বিত্তবানদের হাতে তুলে দেয়ার এখতিয়ার কারো নেই। চউক’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, পতেঙ্গায় বিপুল পরিমাণ জায়গা আমরা রিক্লেইম করেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে এই জায়গা আমাদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকেও বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। ভূমির মালিকানার ব্যাপারটি সুরাহা করা হয়েছে। তিনি জানান, পতেঙ্গা এলাকায় চউক নির্মিত ছয় কিলোমিটার বিচের মধ্যে এক কিলোমিটার এলাকা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দেয়া হচ্ছে। বাকি অংশ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। বেসরকারি কোম্পানি ওই অংশ ঘিরে নিজেদের মতো করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তৈরি করবে। পর্যটকদের জন্য ওয়াশরুম থেকে শুরু করে ফুড কর্নারসহ সবকিছু তারা নির্মাণ এবং পরিচালনা করবে। তিনি বলেন, আমরা তো দেখভাল করতে পারি না, ওরা সৈকতের দেখভাল করবে। তাই দেয়া হচ্ছে ইজারা। পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন ৭ কিলোমিটার পরিসরের দেড় কিলোমিটার এলাকা বাদ দিয়ে বাকি পরিসরকে পর্যটন জোন-১ এবং পর্যটন জোন-২ হিসেবে ভাগ করে টেন্ডারের মাধ্যমে ২৫ বছরের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ইজারা দিতে চাচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। কিন্তু সিডিএ কোনো স্থান আইনগতভাবে ইজারা দেওয়ার অধিকার রাখে না। এছাড়া আইনগত যে কোনো জটিলতা এড়ানোর স্বার্থে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিপর্যায়ে ইজারা দেওয়ার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে আমরা অনুরোধ জানাচ্ছি। # ২১.০৮.২০২২ চট্টগ্রাম #