শিল্প সাহিত্য

সিদ্ধান্তের ভ্রম!

-ডা. গৌতম দত্ত

স্পুরিয়াস করিলেশন (Spurious Correlation) এর বাঙলা কি হবে? মেকি অনুসন্ধ, না কি সোজা বাঙলায় ভুয়া আন্তঃসম্পর্ক? অন্য হাজারো ইংরেজি শব্দের মতো স্পুরিয়াস শব্দের সূত্র ল্যাটিন, যার মানে হলো অবৈধ বা ভুয়া! এই শব্দ-সংঘাতকে পাশ কাটিয়ে ভাব-সংঘাতে যাওয়ার চেষ্টা করা যাক।

যা সঠিক বা প্রকৃত নয় কিম্বা যা না থেকেও থাকার ভ্রম জাগায়; তাই স্পুরিয়াস। করিলেশন মানে অনুসন্ধ যা অনেকটা আন্তঃসম্পর্ক (interrelation)-এর মতোন। স্পুরিয়াস করিলেশন বুঝতে গেলে আবার ভ্যারিয়েবল (variable) বলতে কি বোঝায় সেটাও জানা দরকার। কিসের জন্য কি হচ্ছে তা বুঝতে চাইলে অর্থাৎ কোন ঘটনা বা প্রক্রিয়ার কার্যকারণ বুঝতে চাইলে কিছু পরিবর্তনশীল উপাদাননির্ভর হতে হয়; যার একটির পরিবর্তন অন্যটির আনুধাবনযোগ্য বা পরিমাপযোগ্য পরিবর্তন ঘটায়। বিভিন্ন পরিমাণ বা ধরনে উপস্থিত হতে পারা যে কোনো ফ্যাক্টর, বৈশিষ্ট্য , বা শর্তই হলো এই পরিবর্তনশীল উপাদান বা ভ্যারিয়েবল। ভ্যারিয়েবল হতে পারে স্বাধীন, নির্ভরশীল এবং নিয়ন্ত্রিত, এই তিন ধরণের।

যখন একটি মিথ্যা বা অপ্রমাণিত অনুমানে দুটি ভেরিয়েবলকে সম্পর্কিত করা হয় তখন সেটি হয় স্পুরিয়াস করিলেশন। কোন তৃতীয় (কিম্বা একাধিক)ভ্যারিয়েবলকে হিসেবে না আনা, আড়াল বা উপেক্ষা করার ফলেই ওই অবৈধ বা ভুয়া অনুমানগুলো সত্যের ভ্রম জাগায়! সমাজ-অর্থনীতির প্রক্রিয়াগুলো জটিল হওয়ায় স্পুরিয়াস করিলেশন-এর প্রয়োগে মানুষকে বিভ্রান্ত করা সহজ হয়!

এবার কিছু নমুনা দেখা যাক (কিছু নমুনা দেশ কাল ভেদে ভিন্ন হবে, এটা মাথায় রাখতে হবে); বিষয়টির জটিলতার কারণে প্রথমে কিছু রসোদ্দীপক উদাহরণ এবং শেষে কিছু জটিল উদাহরণ তুলে ধরছি।

১) আইসক্রিম বেশি খেলে ডুবে মরার সম্ভাবনা বাড়ে (Moore, 1993) যে তৃতীয় উপাদানকে এই সম্পর্ক টানায় উপেক্ষা করা হয়েছে তা হোল গরম , গরম বেশি পড়লে লোকের আইসক্রিম খাওয়া এবং জলে নামা দুটোই বাড়ে

২) পুলিশের সংখ্যা বাড়লে অপরাধের পরিমাণ বাড়ে (Glass and Hopkins, 1996): এক্ষেত্রে উপেক্ষিত তৃতীয় উপাদান হোল জনসংখ্যার ঘনত্ব, যেখানে ঘনত্ব বেশি পুলিশও সেখানেই বেশি …

৩) চা ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়ঃ উপেক্ষিত উপাদান ধূমপান , চা পানকারীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা কম …

৪) উপাসনালয়ের সংখ্যা যেখানে বেশি সেখানে মানুষ-খুনের প্রবণতাও বেশি; বড় শহরগুলোয় উপাসনালয় এবং মানুষ খুনের সংখ্যা দুইই বেশি, তবে কার্যকারণ ভিন্ন।

৫) মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের মধ্যে একটি অনুমানযোগ্য এবং বিপরীত সম্পর্ক আছে (Phillip’s curve):

অর্থনীতির রমরমা অবস্থায় বেকারত্ব কম থাকে , বেকারত্ব কম হলে মজুরি বাড়ে (যেহেতু অধিকাংশের কাজ আছে, মজুরের চাহিদা বাড়ে), মজুরি বাড়লে কেনাকাটার ধুম বাড়তে বাড়তে (যেহেতু মজুরেরা পণ্যের ভোক্তাও বটে) এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে পণ্যের যোগান তাল সামলাতে না পেরে আনে মুদ্রাস্ফীতি (যেহেতু পণ্যের যোগানের চাইতে চাহিদা বেশি হয়ে যায়)! বিপরীতে বেকারত্ব বেশি হলে (অর্থনীতির মন্দাবস্থায়) মজুরি কমে, মজুরদের কেনাকাটা কমে আর এতে মুদ্রাস্ফীতিও কমে! এই আন্তঃসম্পর্ক আপাতঃদৃষ্টে যৌক্তিক মনে হলেও একান্তই ক্ষণস্থায়ী, এই তত্ত্বের একদশকের মধ্যেই সত্তর দশকে মার্কিন অর্থনীতিতে আসে যুগপৎ বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতির দীর্ঘস্থায়ী সহাবস্থান বা stagflation! অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান Phillip’s curve – এর অসারতা তুলে ধরেন। মজুর-মালিকের মুদ্রাস্ফীতিকে হিসেবে রেখেই আগে থেকেই মজুরি নিয়ন্ত্রনের মতো তৃতীয় (এবং আরও একাধিক) ভ্যারিয়েবলকে হিসেবে না আনাই মজুরি-বেকারত্বের স্পুরিয়াস করিলেশন তৈরি করে।

এটুকু পাঠের পর পাঠককে সঙ্গত কারণেই কিছু হোমওয়ার্ক ধরিয়ে দেয়া যায়ঃ

১) আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে

২) আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের অর্থনীতি বহুগুণ বলিয়ান হয়েছে

৩) দেশে ধার্মিকতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্দা-করা নারীর সংখ্যা বেড়েছে

 ৪) দেশের মানুষ খুব ভালো আছে তাই শতকরা আশি ভাগ মানুষের সমর্থনের দাবিদার বিএনপি জনগণকে নিয়ে আন্দোলন গড়ার শক্ত বিষয় খুঁজে পাচ্ছে না (ধর্মের সুড়সুড়ি দেয়া বিষয়বস্তু ছাড়া)

৫) জ্বালানী ছাড়াই শক্তি উৎপাদনের মতো যুগান্তকারী আবিষ্কারককে ডক্টর শমসের আলীর মদদ প্রদান দেশে বিজ্ঞান মনস্কতা বিকাশের কারণেই সম্ভব…

৬)সলিমুল্লাহ খানের জনপ্রিয়তা দেশে যুক্তি-দর্শন-বিজ্ঞান বিষয়ক চর্চার প্রসারেরই ইঙ্গিত দেয়। চোখ-কান খোলা রাখলে এমনই আরও হাজারো আন্তঃসম্পর্ক খুঁজে পাবেন পাঠক। খুঁজুন, ভাবুন! [ শেষের টা কৌতুক … যদিও ঘটনা সত্যি! বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ যৌক্তিক কার্যকারণ অনুসন্ধানে সহায়ক তথ্য অনুসন্ধানের সময় তথাকথিত ডক্টর ডিগ্রীধারি ( PhD – which also stands for doctor of p- – -c hair)-দের এড়িয়ে চলুন।]

ডা. গৌতম দত্ত চিকিৎসক, হসপিটাল মেডিসিন ভার্জিনিয়া হসপিটাল সেন্টার এম ডি, ইন্টার্নাল মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি অব টেনেসি, ইউ এস এ এম বি বি এস, ঢাকা মেডিকেল কলেজ