চলমান সংবাদ

দুদক’র গণশুনানি সরকারি সংস্থার দিকে সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগের ‘তীর’

চট্টগ্রামের সকল সরকারি অফিসের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে গণশুনানির আয়োজন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে নগরের ২২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বিরুদ্ধে। ৪৮টি অভিযোগের মধ্যে ২০টিই এই চার সংস্থার বিরুদ্ধে।

এরমধ্যে সিটি কর্পোরেশন ৭টি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ৫টি ও বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস ও সিডিএ‘র বিরুদ্ধে ৪টি অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। গণশুনানিতে চট্টগ্রামের সকল সরকারি অফিসের যেকোনো সরকারি সেবা পেতে হয়রানি বা দুর্নীতির শিকার ভুক্তভোগীদের অভিযোগ তুলে ধরা হয়।

বুধবার (৩ আগস্ট) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শহীদ বীরোত্তম অডিটোরিয়ামে গণশুনানিতে এসব অভিযোগ শুনানি করেন দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান। পরে দুইপক্ষের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত দেন তিনি।

দুদক সূত্রে জানা যায়, ৪৮টি অভিযোগের মধ্যে আগ্রাবাদ ভূমি অফিসের ৩টি, এল এ শাখার ৩টি, রেলওয়ের ২টি, বিআরটিএ’র ২টি, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ২টি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ২টি, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ১টি, চট্টগ্রাম ওয়াসার ২টি, বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রণের ২টি, কেজিডিসিএলের ১টি, খাদ্য অধিদপ্তরের ১টি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১টি, বিআরটিসির ১টি, বিটিসিএলের ১টি, যমুনা ওয়েল কোম্পানির ১টি, সড়ক ও জনপথের ১টি, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ১টি ও জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের বিরুদ্ধে ১টি অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩৫টিরও বেশি অভিযোগের শুনানি হয় এবং বাকিগুলোর অভিযোগকারীরা অনুপস্থিত থাকায় তা শুনানি হয়নি।

এদিকে আলোচনার প্রেক্ষিতে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান দুইপক্ষের অভিযোগ শুনে সিদ্ধান্ত দেন। এতে অভিযোগের ভিত্তিতে অনেক সংস্থাকে ৩ দিন, ৪ দিন ও আবার অনেক সংস্থাকে ৭ দিনের সময় বেঁধে দেন। যদি বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সেবাগ্রহীতারা সেবা না পান তাহলে দুদক অফিসে পুনরায় অভিযোগ করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে তথ্য প্রমাণ ছাড়া ভুল অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন দুদকের এ কর্মকর্তা।

এর আগে, প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘সকল দুর্নীতিবাজরা আতঙ্কে রয়েছে। তারা শিগগিরই ধরা পড়বে। দুদক ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হচ্ছে। এখন দুদকের ব্যাপ্তি ও সক্ষমতা বেড়েছে। দুর্নীতিকে আমলে নিয়ে বিচার করার সংখ্যাও বেড়েছে। দুদকের কর্মকর্তারা হাতে নেওয়া মামলাগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করছে; যার কারণে আদালতের মাধ্যমে ৭০ শতাংশ মামলায় শাস্তি দিতে সক্ষম হয়েছি আমরা।
তিনি বলেন, দুদক শুধু চুনোপুঁটি নয়, এখন রাঘববোয়ালদেরও ধরে। অনেক বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা এখন কারাগারে আছেন। কেউ অপরাধী হলে জীবদ্দশাতে তাদের ছাড় দেওয়া হয় না। শুধু মারা গেলেই নিস্তার পাওয়া সম্ভব। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম আমৃত্যু চলবে।

‘জিরো টলারেন্স টু করাপশন’ লক্ষ্য নিয়ে দুদক কাজ করছে জানিয়ে ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত দুদক কাজ চালিয়ে যাবে। বর্তমানে ৩৬টি কার্যালয়ে দুদক কাজ করছে। ৭০ ভাগ মামলায় শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরেছি। দেশে-বিদেশে দুদক’র কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। তিনি বলেন, গণশুনানিতে ভুক্তভোগী জনসাধারণ তাদের অভিযোগসমূহ তুলে ধরেন। দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনেও এ ধরনের গণশুনানি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন, দুদক মহাপরিচালক (আইসিটি ও প্রশিক্ষণ) এ কে এম সোহেল, সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, দুদক চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মো. মাহমুদ হাসান, চট্টগ্রাম মহানগর দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি সভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী প্রমুখ।

তবে ঘটা করে গণশুনানির আয়োজন করলেও তাদের এ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। গণশুনানিতে আসা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও সেবাগ্রহীতারা অনুষ্ঠান আয়োজনে ‘অব্যবস্থাপনার’ অভিযোগ তুলেন। ভেন্যু অডিটোরিয়ামে জায়গা না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত প্রকাশ করেন।

শুনানিতে ৮৭ বছরের নুর চেহের বেগম নামে এক বৃদ্ধা অভিযোগ করেন, ১৯৮০ সালে স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ সম্বল নিউমুরিং এলাকার ৩৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নিজের বৈধ জমি হওয়া স্বত্ত্বেও জেলা প্রশাসনের ভুলে ক্ষতিপূরণের টাকা পায় অন্যরা। এরপর থেকে নিজের ন্যায্য পাওনা বুঝে পেতে বছরের পর বছর ধরনা দেন জেলা প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষের দুয়ারে দুয়ারে।

গণশুনানিতে নুর চেহের বেগমের ছেলে মিজানুর রহমান বলেন, গত ৪০ বছর ধরে আমার মা ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য ঘুরছে। অথচ যারা এই ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করেছে, তাদের বন্দর কর্তৃপক্ষ উল্টো ভূমি দিয়ে পুনর্বাসন করেছে। আর আমার মা ক্ষতিপূরণের আশায় জেলা প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে। আগে একটি গণশুনানিতেও অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু কোনো সমাধান পাচ্ছি না।

বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি বলেন, আমরা বিষয়টি শুনেছি। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। আমরা জমি পছন্দ করার পর অধিগ্রহণের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে জেলা প্রশাসন। তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা ভুয়া কাগজ দেখিয়ে অন্যরা আত্মসাৎ করেছে। এ নিয়ে ৬ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলাও রয়েছে, যা আদালতে বিচারাধীন। তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি জানার পর কিছুই করার ছিল না। আইনগতভাবেও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও মানবিক দিক বিবেচনা করে নূর চেহের বেগমের এক সন্তানকে বন্দরে চাকরির ব্যবস্থা করেছি।

শুনানিতে জেলা প্রশাসনের ভুলের বিষয়টির ব্যাখ্যা দেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি (বৃদ্ধা মহিলা) আমার কাছে একাধিকবার এসেছিলেন। আমি তাকে আশ্বাস দিয়েছে কিছু করার। অর্থ আত্মসাৎকারী যে ৬ জন রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন। যেহেতু মামলাটি বিচারাধীন, ক্ষতিপূরণ আদায় করতে কষ্ট হবে। তবে বিষয়টি মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করলে ভালো হয়। এক্ষেত্রে যদি বন্দর সিএসআর ফান্ড থেকে মামলার বাদি ক্ষতিগ্রস্তকে পুনর্বাসনে করে তাহলে ভালো হয়। আর জেলা প্রশাসন থেকে আমরা তাদের ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিবো।

# ০৩.০৮.২০২২ চট্টগ্রাম #