চলমান সংবাদ

হালদা নদীতে একের পর পর মরছে বিপন্ন প্রজাতির ডলফিন

বঙ্গুবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষিত হালদা নদীতে এক সপ্তাহের মধ্যে বড় আকারের তিনটি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে। এনিয়ে গত চার বছরে হালদা নদীতে ৩৮টি ডলফিনের মৃত্যু হলো। এর বেশিরভাগেরই শরীরে বড় বড় ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকাভুক্ত(অতি বিপন্ন প্রজাতি) জলজ প্রাণী মিঠাপানির গাঙ্গেয় ডলফিন রক্ষায় হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও রক্ষার দায়িত্ব যেন কারোরই নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) সকালের দিকে রাউজান উপজেলার পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাট এলাকায় মৃত একটি ডলফিন ভেসে থাকতে দেখা যায়। ডলফিনটি প্রায় ৭ ফুট লম্বা এবং ওজন ৬০ কেজি। পঁচে যাওয়ায় মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। তবে এর শরীরের আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। এর আগে বুধবার (২০ জুলাই) দুপুরের দিকে একই এলাকায় একটি মৃত ডলফিন ভাসতে দেখা যায়। এটির ঠোঁটের নিচের অংশ ও দাঁত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে। এছাড়াও গত ১৪ জুলাই রাউজান পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ গহিরা এলাকায় হালদার সংযোগ খাল বুড়িসর্তায় প্রায় সাড়ে ৮ ফুট লম্বা ১২ কেজি ওজনের আরেকটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। হালদা গবেষকরা বলছেন, ডলফিনের জন্য হালদা নদী অনিরাপদ আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। অবৈধ মাছ শিকারিদের জাল, ইঞ্জিন চালিত নৌযান ডলফিনের মৃত্যু বাড়ার কারণ বলে অভিযোগ করেছেন গবেষকরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে হালদা নদী ডলফিন শূন্য হওয়ার আশংকা করছেন তারা। হালদা নদীর বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিন রক্ষায় ইঞ্জিনচালিত নৌ-যান চলাচল ও খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা মানছে না বালুখেকোরা। প্রজনন মৌসুমের (ফেব্রুয়ারি-জুলাই) ছয় মাস ছাড়া অন্য সময় চলাচল করছে বালু ও পাথর বহনকারী বার্জ। এছাড়াও প্রায় প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ জালসহ নৌ পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে মাছ শিকারীরা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল হালদা নদীতে খননযন্ত্র ও ইঞ্জিনচালিত নৌ-যান ব্যবহার বন্ধের সুপারিশ করে। এছাড়া আরও চারটি সুপারিশ করা হয়। সেগুলো হলো: বালু তোলা বন্ধ, নদীতে জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ, কল-কারখানার বর্জ্য ও দূষিত পানি নদীতে প্রবেশ করতে না দেওয়া এবং নদী তীরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ডলফিনের নিরাপদ বিচরণ, প্রজনন ও গবেষণার ব্যবস্থা করা। জেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থাকে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এসব সুপারিশ এখনও কাগজে-কলমে। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট হালদা নদীর ডলফিন রক্ষায় একটি কমিটি গঠন করেন। সেখানে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) সদস্য সচিব করা হয়। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সদস্য রাখা হয়। হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ শাহিদুল আলম বলেন, ডলফিন ও হালদার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন নিয়মিত কাজ করছে। ডলফিনের মৃত্যু রোধে ঘটনা তদন্ত করে সেগুলো রক্ষায় নতুন কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, হালদা দূষণের সকল উৎস আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। ইতিমধ্যে হালদা নদী সংলগ্ন ১৭টি শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট যে শিল্প-কারখানা রয়েছে সেগুলোর বর্জ্য হালদায় পড়ে না। তিনি আরও বলেন, হালদা নদী রক্ষায় যা যা করার দরকার আমরা সব করছি। হালদা নদীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে এসেছি। হালদা নদী সংলগ্ন ৯টি ইটভাটা বন্ধ করে দিয়েছি। ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছি। কিন্তু কি কারণে হালদায় ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে সেটি আমরা এখনো শনাক্ত করতে পারিনি। বয়সের কারণেও ডলফিনের মৃত্যু হতে পারে। হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত হালদা ও এর শাখা খালে মোট ৩৮টি ডলফিন মরে ভেসে ওঠে। প্রায় সবকটি ডলফিনের শরীরে আঘাতের চিহ্ন শনাক্ত রয়েছে। অসংখ্য ডলফিনকে হত্যাও করা হয়। হালদা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতি বিপন্ন প্রজাতি গাঙ্গেয় ডলফিন বিশ্বের বিভিন্ন নদীতে আছে মাত্র ১ হাজার ১০০টি। এর মধ্যে শুধু হালদাতেই ছিল ১৭০টি। গত চার বছরে হালদায় ৩৮টি ডলফিন মারা যাওয়ার ঘটনাটি খুবই উদ্বেগজনক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদা নদীতে যে হারে ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে এটি উদ্বেগজনক। হালদার ডলফিন রক্ষায় এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় হালদা ডলফিন শূন্য হতে বেশি সময় লাগবে না। # ২২.০৭.২০২২ চট্টগ্রাম #