শিল্প সাহিত্য

শেষ ইচ্ছা

-শাহীন আকতার হামিদ  

 আন্দ্রে শেবচিয়েঙ্ক কোন ভাবেই এগুতে পারছেনা। ইউক্রেনের বাতাসে আজ হ্রভেনিয়া ঘুরে বেড়ায়। বন্ধু আলিএগ, ইগো্র,‌ ছাসা সবাই কেমন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। কাপড়ের ব্যবসা, চা-কফির দোকান সব কিছুই চেষ্টা করে দেখেছে আন্দ্রে , না কোনকিছতেই তার ভাগ্য খুলছেনা।   আক্সানা আন্দ্রের বউ, বাচ্চা হবে তিনমাস, ডাক্তার বলেছে বিছানায় থাকতে ও ভাল ভাল খাবার খেতে। আন্দ্রের তো ঘর ভাড়া দেয়ার ক্ষমতাই নেই, তায় ভাল খাবার। মামা বাবা তাদের দুই রুমের ফ্লাটে নিজেরাই থাকে, বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়, মদ খায়, বেড়াতে যায়। যা পেনশন পায় তাতে ভালভাবে তাদের চলে যায়।   আন্দ্রে আজ দিশেহারা। বন্ধু আলিএগ বলল, ‘চল আমরা রিভার ক্রুজের ব্যবসা করি। আমার এক বন্ধু সব টাকা দিবে। এই রিভার ক্রুজ ব্যবসায় অনেক লাভ।‘ উপায়হীন আন্দ্রে আলিএগের কথায় রাজি হয়ে গেল। পাঁচ মিলিয়ন হ্রভেনিয়া ধার নিয়ে শুরু করল নদীতে ভ্রমণের ব্যবসা। ধারে দেয়া হয়েছে একটি ছোট জাহাজ, একি সাথে তাকে করতে হয়েছে জাহাজ ও নিজের জীবনবীমা। যদি কখনো কোন দুর্ঘটনা ঘটে আন্দ্রের জীবনবীমার  হ্রভেনিয়া সব পাবে তার বউ। ব্যবসা ফুলে ফেপে উঠল। আন্দ্রে কিনল নদীর পাড়ে চমৎকার ফ্লাট বউয়ের নামে। গাড়ি কিনল, বউয়ের রেগুলার ডাক্তার দেখান হচ্ছে। মা বাবাকে আন্দ্রে টাকা দিল তাদের ফ্লাট মেরামত করার জন্য।   ঋণের টাকা অল্প অল্প করে ফেরৎ দিচ্ছে। জীবন এগিয়ে যাচ্ছে। ছেলের নাম রাখল স্টাস শিবচিয়েঙ্ক। আক্সানার খরচ অনেক বেড়ে গেছে, সে এখন প্রায় প্রতিদিন নুতন কাপড় পরতে অভ্যস্ত  হয়ে পড়েছে। ঘরের আসবাব কদিন পর পর পালটাচ্ছে। বেড়ে গেছে জীবনের পরিধি, আক্সানার মা-বাবা-বন্ধুদের নিত্য আনাগোনা বেড়েই চলছে।   একদিন যাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিল আন্দ্রে, আজ তারাই আন্দ্রের বসার ঘরে নিত্য আড্ডা দেয়।  যাদের বউ বা বান্ধবি আক্সানাকে একটু পানিও দেয়নি তারা আজ আক্সানা হাঁটলে পায়ে ব্যাথা পাচ্ছে কিনা তাই নিয়ে চিন্তিত।   আন্দ্রের বন্ধু আলিএগ আন্দ্রের ঋণদাতা বন্ধুর সাথে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আন্দ্রেকে আর এগুতে দেয়া যাবেনা। অফুরন্ত হ্রেভেনিয়ার মালিক গেন্নাদি মিখাইলোভিচ এভাবেই লোককে ধার দিয়ে থাকে ও মাঝপথে টেনে নামায়। আলিএগ এখানে দালালের কাজ করে থাকে। এই দালালি দিয়েই সে অনেক পয়সার মালিক হয়ে ইউরোপের অনেক দেশে বাড়ি বানিয়েছে। গেন্নাদির কথা বলে শেষ করা যাবেনা। সমাজতন্ত্রের ভাঙ্গনের আগেই কোম্পানীর প্রধান হিসাবে অনেক কিছুই নিজের করে নিয়েছিল গেন্নাদি। পরে সরকার যখন বিভিন্ন কোম্পানী ব্যাক্তিমালিকানায় দিয়ে দেয় গেন্নাদি তিনটা বড় কোম্পানী কিনে নেয়, তার একটা হল জাহাজের ব্যবসা। অনেক পুরণ জাহাজে সে যাত্রী বহণ করার জন্য নদী সমুদ্রে চালায়। সেখান থেকে একটা জাহাজ নিয়েছে আন্দ্রে ও সাথে পাঁচমিলিয়ন হ্রভেনিয়া।   জাহাজের বীমা কাগজ জমা দিতে হয়েছে গেন্নাদিকে, এটাই ছিল একমাত্র শর্ত। জাহাজে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে জাহাজ ও যাত্রী বীমার সব টাকা যাবে গেন্নদির কাছে কিন্তু বীমা চালাতে হবে আন্দ্রেকে। আন্দ্রে তার জীবনবীমার কাগজ জমা রেখেছে বউয়ের কাছে।   নীপার নদি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আন্দ্রের জাহাজ ‘স্টাস’। ছেলের নামে নাম রেখেছে জাহাজের। আজ জাহাজে তেমন কোন মানুষ নেই, শীতে ভ্রমণ পিপাসুরা ঘরে বসে মদ খেতেই বেশি পছন্দ করে। তাছাড়া মাঝে মাঝে নদীতে জমা বরফ পাওয়া যায় তখন জাহাজ চালান সহজ হয়না।   আন্দ্রের জাহাজের ভ্রমণের পথ হল কিয়েভ থেকে দনেপ্র হয়ে ঝাপারশি। এখন অনেকেরই প্রচুর সম্পত্তি হয়েছে, তারা ঘুরতে পছন্দ করে, বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা।  আন্দ্রে একদিনের জন্যও জাহাজ ছেড়ে যায়না। সপ্তাহে একদিন সে ছুটি নিয়ে বউ বাচ্চার সাথে সময় কাটায়।   মনে হল জাহাজ খুব ধীরে চলছে। ক্যাপ্টেন বলল, ‘কেমন যেন গোলমাল হচ্ছে জাহাজে।দুজন লোককে নীচে পাঠাল দেখার জন্য কোথাও কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। সিদ্ধান্ত নিল  যাত্রীদের নামিয়ে দিবে ঝাপারশি। ঝাপারশির তীরে শেষ যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে আন্দ্রে তাদের হ্রভেনিয়া ফেরৎ দেয়ার প্রতিজ্ঞা করল। আন্দ্রে, ক্যাপ্টেন ও স্টাফদের নিয়ে এগিয়ে চলল দনেপ্রোর দিকে। প্রচন্ড শব্দে কেঁপে উঠল জাহাজ।  ডেকে দাঁড়িয়ে  চারিদিকের দৃশ্য দেখতে ছিল আন্দ্রে, ছিটকে পড়ল পানিতে, বাকিদের খবর সে জানেনা।   মারা গেছে ক্যাপ্টেন্সহ দুই স্টাফ, বেঁচে আছে আন্দ্রে ও বাকি পাঁচ স্টাফ। দুজনের অবস্থা খুব খারাপ।  ডাক্তার বলেছে, ‘হয়তো টিকবে না।‘ দুদিন হাসপাতালে থাকার সময় একমাত্র মা বাবাকে ছাড়া কাউকে সে দেখেনি। বউ বা ছেলে কেউই আসেনি। বাসায় যাওয়ার পরে বউয়ের অগ্নিমূর্তি, কেন সে আগে থেকে জাহাজের সব কিছু দেখে রাখেনি। আলিএগ নাকি এসে সব কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছে।   জীবন বিমার কাগজও চলে গেছে আলিএগের হাতে। আক্সানা বলল আলিএগ সব দেখে রাখবে বলেছে। আন্দ্রে বুঝল ঘটনা কোনদিকে ঘুরছে। শরীর ও মনের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে আন্দ্রে বলল,’ তুমি কী চাও?’ আক্সানা বলল, ‘তোমার মৃত্যু হলে আমি বেঁচে যাই।‘   মদে আকন্ঠ ডুবে থাকল সপ্তাহখানেক আন্দ্রে। না তার তেমন কোন পরিবর্তন হলনা। ক্রমেই মৃত্যু তাকে টানছে। কানে ভাসছে, ‘তোমার মৃত্যু হলেই আমার শান্তি অন্তত কিছু টাকা পাব।‘ আন্দ্রে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল কাউকে কিছু না বলে। চলে গেল কিয়েভ জীবন বীমার হেড অফিসে। খুঁজে বের করে ফেলল সেই ব্যাক্তিকে যে তার বীমা করেছিল। বলল, “আমি কাগজ হারিয়ে ফেলেছি, তাই বীমা দিতে পারছিনা।” লোকের সহায়তার সে পেয়ে গেল সব কাগজ।   তার বীমা সহায়তাকারীর  সাহায্য নিয়ে পালটে ফেলল নমিনির নাম। মা বাবা ও স্টাসের স্টাফ ও ক্ষতিগ্রস্থ যাত্রীদের দিল অর্ধেক। বাকি অর্ধেকের সমান ভাগ করে দিল বউ ও বাচ্চাকে। আন্দ্রে বলল, “আমি মারা গেলে কি এটা নমিনিদের কাছে যাবে?” বীমা সহায়তাকারী বলল, “অবশ্যই যাবে।‘“ আন্দ্রে বলল,”আমাকে আপনার বসের কাছে নিয়ে চলুন যে এই টাকা ফেরৎ দিবে।” বীমা সহকারী একটু অবাক হয়ে গেলেও নিয়ে গেল বসের কাছে। বস কিছুটা বিরক্ত হলেও আন্দ্রের কথা শুনল মনযোগ দিয়ে।   আন্দ্রে বলল, “আপনাদের কথার কোন উল্টোপাল্টা হবেনা আমি  আশা করছি।” বস ক্ষেপে গিয়ে বলল,”এ যাবৎ হয়নি, তোমার এ এক মিলিয়ন হ্রারভেনিয়ার এমন কি হবে!” কথা শেষ করার আগেই আন্দ্রে তার পকেট থেকে পিস্তল বের করে নিজের মাথায় গুলি করে সেখানেই লুটিয়ে পড়ল।পুলিশ এসে লাশ নিয়ে গেল হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তার পেল আন্দ্রের পকেটে জবানবন্দি।   “আমি আন্দ্রে শিবচেঙ্কো, আমাই জীবনের বিনিময়ে আমার শেষ ইচ্ছা রেখে গেলাম। এ ব্যর্থ জীবনের বোঝা আমি আর বহণ করতে পারছিনা।  মা-বাবা, বউ-বাচ্চা ও জাহাজের স্টাফ কাউকে আমি পথে বসিয়ে গেলাম না।“