চলমান সংবাদ

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুগোধূলির ভেতর আবহবোধ

– শোয়েব নাঈম

হুমায়ূন আহমেদের গল্পে-উপন্যাসে বিস্তারিত মহিমায় সুদৃঢ় ভাবনা এবং আবেগগত প্রেরণা আছে। আছে― আধুনিকতার আত্মবাদীতা, প্রগাঢ় আত্মচেতনা, আত্মনৈঃসঙ্গ্যের স্বতঃস্ফূর্ততা। আছে বহুবর্ণিল
জীবনস্পষ্ট আখ্যান― যাহা অস্তিত্বের এবং নগরের বাস্তব সংকটকে চিহ্নিত করে। আরও আছে তাঁর গদ্যভঙ্গিতে এক সুবিস্তৃত অলীক সম্মোহন। তাঁর গদ্যভঙ্গিকে মুখে ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু সুতীব্রভাবে
পাঠতৃপ্তে অনুভব করা যায় লেখকের অনন্যবোধ। তাঁর গদ্যভঙ্গি থেকে আবর্তনশীল চিন্তাঘোরে অতিরিক্ত কোনো ভাবনা অথবা ভাবের ব্যঞ্জনা অনুভূত হয়। অর্থাৎ— কাহিনীর কার্যকর ফর্মে যেসব অনুভূতি প্রকাশ করেছেন লেখক, তা’এক অভূতপূর্ব ব্যঞ্জনায় প্রতিধ্বনিত হয় পাঠকের চিন্তা ও অচিন্তার সংঘবদ্ধতায়। তাঁর লেখাকে খুব সক্ষ্মভাবে ব্যাবচ্ছেদ করলে মৌলিকভাবে ৩টি বিষয়কে স্পষ্ট করা যায়—
১) প্রথাহীন স্বাতন্ত্র্য, ২) সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞা, এবং ৩) অভিনবত্বের অন্তর্বয়ন। সাধারণ টেক্সটে লেখা হুমায়ূন আহমেদের এসব অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলি পাঠকের মনোজগতে খুবই যথার্থভাবেই সমাদৃত হয় পাঠ পরবর্তিতে।তাঁর সৃষ্ট নির্দিষ্ট কৌশলে অন্তর্গত জগতের গোলকধাঁধায় কথা বলে বলে কাহিনীকে তিনি সর্বজনীন করে গড়ে তুলতে পারেন। তাই হুমায়ূন আহমেদকে অন্যান্য পূর্বের এবং পরের পরম্পরারয় লেখক মানদন্ডে টেনে এনে প্রণিধান করা যায় না। অর্থাৎ তাঁর বর্ণনাত্মক ধারাটি পূর্বসূরিদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে একনিষ্ঠ নয়, কিন্তু ধ্রুপদি ঐতিহ্য আত্মস্থ করেই তিনি স্বতন্ত্রে এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে একীভূত হয়ে মহিয়ান হয়ে উঠেছেন। হুমায়ুন-কাহিনীর চরিত্রদের জীবনাচরণ ও আত্মদর্শনের মধ্যেই পাওয়া যায় মানব জীবনের শ্রেয় ওঠার ইঙ্গিত। তাঁর লেখার এই সুসামঞ্জস্যপূর্ণ রীতি-নীতি ধরণটি সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি, একে সাহিত্যের প্রথাগত নৈতিকতার মানদণ্ড দিয়ে বিবেচনা করা চলে না, কেবল লেখকের স্বতন্ত্র মানদণ্ডেই যাচাই করতে হয়। শব্দ, অর্থ, রস, রসায়ন,
গুণ, অলঙ্কার, প্লট, রীতি― প্রভৃতি উপকরণাদির দ্বারা তাঁর সাহিত্যকে তিনি জ্ঞানের বিষয়ীভূত এবং সৃজনক্ষমতার পরিপূরক করতে পেরেছেন। লেখক হুমায়ূন আহমেদের এই স্বতন্ত্রধারা সৃজনক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্য অনুধাবন করেই বাংলা সাহিত্যে
অনন্ততৃষ্ণায় তিনি চিরকালই মূল্যায়িত হবেন। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যব্যাপ্তি’ই তাঁর সত্তার মৌল বিচরণ এবং পাঠক-অনুভূতিতে অবিরল কম্পন। মৃত্যুর ১০ বছর পরে, পাঠকের বোধের দর্পণে এখনও অনবরত তৈরি হয় হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য অবয়ব।
শোয়েব নাঈমঃ কবি ও প্রাবন্ধিক