মতামত

করোনাকালীন শিক্ষা পেয়েও জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাত বিশেষ গুরুত্ব পেলনা

-ডা: এ, কে, এম, আরিফ উদ্দিন আহমেদ (আরিফ বাচ্চু)

ডা এ, কে, আরিফ উদ্দিন আহমেদ (আরিফ বাচ্চু)

করোনা অতিমারি আমাদেরকে অনেক নতুন শিক্ষা দিয়েছে। মানুষ নতুন করে জন-স্বাস্থ্যের গুরুত্বের কথা ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু  প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট দেখে স্বাস্থ্য খাত গুরুত্ব পেয়েছে তা মনে হওয়ার কোন কারণ নেই। বাজেট প্রণয়নকারীরা এবারও জাতীয় বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ রেখেছেন স্বাস্থ্যের জন্য। গত এক দশক ধরে এমনই চলছে। করোনা মহামারির সময় দেশে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা, দুর্দশা, ও অপ্রতুলতা গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ও চিকিৎসা ব্যয়ের বিবেচনায় জনস্বাস্থ্যবিদরা বলে আসছেন, জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত। কিন্তু তা হচ্ছে না, কারন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বড় দুর্বলতা, তারা বরাদ্দ খরচ করতে পারে না। বছর শেষে এই মন্ত্রণালয় থেকে টাকা ফেরত যায়।

সর্বশেষ গত ২০২১–২০২২ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল মোট জাতীয় বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২০–২০২১ অর্থবছরে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আর আগের তিনটি অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৯–২০, ২০১৮–১৯ ও ২০১৭–১৮ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৪ দশমিক ২, ৪ দশমিক ৮, এবং ৫ দশমিক ২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান ২০২২–২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের জন্য জাতীয় বাজেটের কম পক্ষে ৭ থেকে ৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ করেছিলেন। মধ্যম মেয়াদে এ অনুপাত ১০ থেকে ১২ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।

‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার যে বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন, সেখানে স্বাস্থ্য খাতে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ হিসাবে স্বাস্থ্য খাত বরাদ্দ পেয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, গত অর্থবছরের বাজেটেও এই হার একই ছিল। চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। সংশোধনে তা কিছুটা কমে ৩২ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা হয়। সেই হিসেবে নতুন অর্থবছরে টাকার অংকে বরাদ্দ বেড়েছে ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরের ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণের জন্য। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য সেবার জন্য থাকছে ২৯ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। এর ১৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা খরচ হবে পরিচালন বাবদে, উন্নয়ন পাবে ১৫ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরের (২০২২–২৩) বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পরিমাণ টাকার অংকে বাড়লেও মোট বরাদ্দের আনুপাতিক হারে তা না বাড়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত দুই বছর করোনাভাইরাস অতিমারীর কারণে স্বাস্থ্য খাতে জরুরি প্রয়োজনে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংক্রমণ কমে আসায় এবার তা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতের জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

 কেন জাতীয় বাজেটের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজনঃ    

  • বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য মোট যে ব্যয় তার ৭৩ শতাংশই আসে নাগরিকদের ব্যক্তিগত আয় থেকে, যার বেশীর ভাগ তাদের পকেট খরচের বাইরে জমানো টাকা। বাকি ২৭ শতাংশ জাতীয় বাজেট বরাদ্দ থেকে। স্বাস্থ্য সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের এই ‘আউট অফ পকেট কস্ট’ কমানোর জন্য জাতীয় বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।
  • প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন বাজেট এবং বিনামূল্যে বিতরণ করা ওষুধের জন্য জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন।
  • দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালু করার পরিকল্পনা এখন থেকে নেয়া উচিৎ ও এই জন্য অবকাঠামো ও জনবল তৈরীতে অর্থ বরাদ্দ দেয়া উচিৎ। এ শ্রেণির নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
  • মেডিকেল প্রফেশনালদের প্রশিক্ষণ ও গবেষনা কার্যক্রমের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অব্যয়িত থাকে কেনঃ

  • বিগত বছরগুলোতে, স্বাস্থ্য খাতের পরিচালন বরাদ্দের ৩ থেকে ৫ শতাংশ এবং উন্নয়ন বরাদ্দের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অব্যয়িত থাকে। যেটা খরচ হয়, তা-ও অনেক ক্ষেত্রে গুণগত মানের নয়।
  • উন্নয়ন বা পরিচালন বাজেটের অব্যয়িত থাকার, মূল কারণ হচ্ছে, কেনাকাটা সংক্রান্ত জটিলতায় স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ পুরোপুরি খরচ করতে না পারা। এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছে বার্ষিক প্রকিউরমেন্ট পরিকল্পনা তৈরি, ঊর্ধ্বতন দপ্তর থেকে এসবের দ্রুত অনুমোদন। তা ছাড়া রয়েছে সময়মতো অর্থ ছাড়ের বিষয়। প্রথমটির সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি কস্ট-সেন্টারের ব্যবস্থাপকের ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত দক্ষতাসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রকিউরমেন্ট পলিসি এবং দরপত্রের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা। আর দ্বিতীয়টি নির্ভর করে ঊর্ধ্বতন দপ্তরের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের একাগ্রতা, দক্ষতা, আন্তরিকতা ও সততার ওপর। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই ঘাটতি বেশ স্পষ্ট।
  • স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবস্থাপকদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য বুনিয়াদি প্রশিক্ষণসহ, প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত উপযুক্ত প্রশিক্ষণের তেমন ব্যবস্থা নেই।
  • উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে যোগ্য প্রকল্প পরিচালকের অভাব, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব অর্পণ, তাঁকে প্রশিক্ষণ এবং দাপ্তরিকভাবে জনবল দিয়ে সক্ষম করে না তোলা, একাধিকবার প্রকল্প পরিচালকের পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাবে যোগ্য ফার্ম বাছাই করতে না পারা, ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা, নিয়োগকৃত ফার্মের আর্থিক সক্ষমতার অভাবসহ বিভিন্ন বিষয় জড়িত।
  • অন্যদিকে, ক্ষেত্রবিশেষে ঊর্ধ্বতন দপ্তরের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের একাগ্রতা, দক্ষতা, আন্তরিকতা ও সততার অভাবে অনুমোদনের প্রক্রিয়া অনেক বিলম্বিত হয়। আবার ইন্টিগ্রেটেড বাজেট অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের (আইবিএএস++) মাধ্যমে বছরের প্রথম দুই কোয়ার্টারের বরাদ্দ দ্রুত ছাড় করা হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ কোয়ার্টারের বরাদ্দ ছাড়ের ক্ষেত্রে বেশ বিলম্ব হয়।
  • একটি অদৃশ্য দুষ্টচক্র তো সর্বত্র বিরাজমান, যেখানে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, হিসাব সংরক্ষণ অফিস, অডিট অফিসসহ সমাজের নানা স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীরা জড়িত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই দুষ্টচক্রই নির্ধারণ করে কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কন্ট্রাক্ট দিতে হবে এবং কোন মূল্যে দিতে হবে। তাই যে খরচ করা হয়, সেটাও গুণগত মানের হয় না। আর এ ক্ষেত্রে দ্রব্য বা ইকুইপমেন্ট বুঝিয়ে না দিয়ে নানা রকম কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। এ কারণে সৎ ব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালকেরা প্রাপ্ত বরাদ্দ ব্যবহারে ভয় পান।
  • স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা অনেক বেশি এবং তা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপ্ত হওয়ায় এই দুষ্টচক্র অনেক বেশি বিস্তৃত। আগে স্থানীয়ভাবে ঔষধ ও অন্যান্য সামগ্রী কেনার কিছু দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনের দপ্তরের ওপর ন্যস্ত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে সেই দায়িত্ব ও বরাদ্দ উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স পর্যন্ত চলে গেছে। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বর্তমান গভর্ন্যান্স কাঠামোয় বিষয়টি হিতে বিপরীত হয়েছে। কেনাকাটার টাকার ভাগ পাওয়ার জন্য এখন ৪৯৫টি উপজেলায় ৪৯৫টি দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সারা বছর এই দুষ্টচক্রের ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়। অন্যদিকে, এসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানির পুরোপুরি সক্ষমতা না থাকায় তারাও চাহিদাকৃত ওষুধ সময়মতো সরবরাহ করতে পারে না। ফলে পরিচালন খাতের এ অর্থও ঠিকমতো খরচ করা যায় না।

তাই বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটা গুণগতভাবে খরচ না করতে পারলে বাজেট বৃদ্ধির সুযোগও নেই, যৌক্তিকতাও নেই। এর জন্য প্রথমেই দরকার কেন্দ্রীয়ভাবে একটি শক্তিশালী প্রকিউরমেন্ট দপ্তর গঠন করা। সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরেজ ডিপোর কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমেও তা করা যায়।

উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে গতি আনয়নসহ স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে মেডিকেল ক্যাডারে হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে একটি নতুন ধারা সংযোজন করা একান্ত প্রয়োজন। এ ধারায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ক্যারিয়ারের শুরু থেকে স্বাস্থ্য খাতের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, প্রকিউরমেন্ট, টেন্ডারিং প্রক্রিয়াসহ নানা বিষয়ে দক্ষ করে তোলা, যেন তাঁরা স্বাস্থ্য খাতকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারেন। তা ছাড়া করোনার শিক্ষা কাজে লাগিয়ে দেশের পুরো স্বাস্থ্যসেবাকে জনমুখী করার জন্য প্রতিকারমূলক সেবা উন্নয়নের পাশাপাশি প্রতিরোধ সেবা জোরদারকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সংযোজন করা।

স্বাস্থ্যে উন্নয়ন বরাদ্দের বড় অংশ অব্যয়িত থেকে যাওয়ার সমস্যা সমাধানে এ খাতের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যখাতের ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা বাড়াতে পৃথক স্বাস্থ্য ক্যাডার গড়ে তোলার বিষয়টিও ভাবা দরকার। যেসব মন্ত্রণালয় উন্নয়ন বরাদ্দ ব্যয়ের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি সক্ষমতা দেখাচ্ছে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এগোতে পারে।

তথ্য সূত্রঃ বিভিন্ন ওয়েবসাইট

লেখকঃ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক (ক্লিনিক্যাল মেডিসিন)
ফোকাল পার্সন (কোভিড ইউনিট) ও একাডেমিক কোঅর্ডিনেটর
ইমপেরিয়াল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম