শিল্প সাহিত্য

প্রকৃতির আক্রোশ

– তামান্না হোসেন

ইউক্রেইনের মিস লায়ুদোভ লুকমানোভ
(Lyudov Lukhmanov)অনেক দিন পরে আজ ক্লিনিকে এলো।ফলোআপ ভিসিটে। তাঁর হাই ব্ল্যাড প্রেসার আর থাইরয়েড আছে।ফলোআপ ভিসিট তার ওভারডিউ হয়েছে বেশ আগেই। মাঝে একবার ফোনে বলেছিল, সে খুব চাপে আছে, ক্লিনিকে আসতে পারবে না। ডাক্তার তখন তাকে সব মেডিসিনের রিফিল দিয়েছিল।আমি জানতাম, ইউক্রেনের মেরিউপল( Mariupol) শহরে তাঁর ৭০ বছরের মা বাস করে।যুদ্ধের দামামায় লায়ুদোভ খুবই দুশ্চিন্তা গ্রস্থ ছিলো।
আমি ফোনে খোঁজ রাখতাম। ফোন পেলে মন খুলে কথা বলতো,কান্না করতো।যুদ্ধের মধ্যে বাস করা অসুস্থ মায়ের
জন্য তার যে অস্থিরতা তা আমাকেও স্পর্শ করতো। এক সময় মেরিউপলে বাস করা মায়ের সাথে তাঁর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো। ছবিতে দেখে, মা যে বাসভবনে বাস করে তার চারিধাররেই বোমার আঘাতে ধংস হওয়া সব কংক্রিট। লায়ুদোভ চিৎকার করে কাঁদে মায়ের জন্য। জানে না মা বেঁচে আছে কি নেই।এরি মাঝে বেশ কিছুদিন তাঁর খবর নিতে পারিনি।মনে হল যখন, ফোন করে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি লায়ুদোভ এর ফোন আনসারিং এ চলে যায়। মেসেজ রাখলাম।কিন্তু খোঁজ নেই তার। অবশেষে আজ এলো। হাসি খুশী, উচ্ছল লায়ুদোভ। আমাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে উঠলো। যা জানা হল,লায়ুদোভ এর মা খুব কস্ট করে পোলিশ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পোল্যান্ডে প্রবেশ করে। লায়ুলোভ তা শোনা মাত্রই চলে গেছে পোল্যান্ডে। মাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে মার্কিন দেশে। হেসে হেসে জানালো, তার মায়ের ছেলে বন্ধু যে নাকি মায়ের থেকে ১০ বছরের ছোট আর লায়ুদোভের স্বামীর থেকে মাত্র দুই বছরের বড়। মেরিউপলে মা আর মায়ের ছেলে বন্ধুর আতংক আর অনাহারে দিন কেটেছে।তারা ক্রমান্বয়ে দুই জনেই ওজন হারিয়েছে। মাকে আনতে পেরে সে খুবেই আনন্দিত। আমি জিজ্ঞেস করলাম,তোমার মায়ের ছেলে বন্ধুকে কি আবার রেখে মা কে একাই নিয়ে এলে নাকি? অসাধারণ রূপবতী লায়ুদোভ মিস্টি হেসে বলে, আমার মা তার ছেলে বন্ধু ছাড়া আসতে রাজী হয়নি। দুই জনকে এক সাথেই এনেছে সে। আমারও শুনে খুব শান্তি লাগলো।

শান্তি পেলাম লায়ুদোভের মায়ের জন্য এই ভালোবাসার
কাতরতায়। মাকে সে জীবিত পেয়েছে নিজের কাছে এনেছে। আহ,কি শান্তি মেয়ের।

কিন্তু আমার মনটা তো শান্ত নেই। আমাদের দেশ ভেসে যাচ্ছে অকাল বন্যায়। ১২২ বছরের ইতিহাসে এত বড়
বন্যা আর হয়নি। মেঘালয়ের প্রাকৃতিক বনায়ন সাফ করে সেখানে করা হচ্ছে কৃত্রিম বনায়ন, পাহাড় অরন্য কেটে নগয়ারন বৃদ্ধি , বৃষ্টির জন্য খ্যাত এই মেঘালয়ে হচ্ছে অতি বৃষ্টি। বর্ষা কালে (জুন, জুলাই,আগস্ট) সাধারণত ৪,৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়ে থাকে।এবার গত ১৯ দিনেই প্রায় ৪,১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে গেছে।আর কৃত্রিম বনায়ন বৃষ্টির পানি ধারন করে করে রাখতে সক্ষম নয়। জেট স্টীম বা জেট তরঙের গতিপথ পরিবর্তন। তার উপর আছে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব। সব মিলিয়ে এই মেঘালয় রাজ্যের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সিলেটের অধিকাংশ এলাকা বিশেষ করে সুনামগঞ্জের করুন পরিনতি এই সুনামীতে। ভয়াবহ বন্যায় বাড়ির চালে উঠেও মানুষ বানে ভেসে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে ধান, ভেসে যাচ্ছে গবাদিপশু। নেই বাসস্থান, নেই আহার। আছে শুধু মৃত্যুর সহজ আহবান। এর জন্য কি শুধু প্রকৃতি দায়ী? আমাদের কি কোন দায় নেই?

মেঘনা অববাহিকায় ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রকৃতি বিনাশি কর্মকান্ড, পাহাড় ধসের কারনে অতিরিক্ত
পলি প্রবাহ নদ নদীর নাব্যতা হ্রাস করেছে। অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ এর সংগে যুক্ত হয়েছে কিশোরগঞ্জের হাওরে নির্মিত “অল অয়েদার রোড। এই সড়ক পথের কারনে পাহাড়ি ঢলের সংগে আসা বৃষ্টির পানি বাহিত পলিমাটি বা পলিমাটি যুক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাসনের সু্যোগ না পেয়ে স্থির হয়ে আছে তিন বছর ধরে। যার কারনে হাওর এলাকায় নদ নদীর নাব্যাতা কমে গেছে। কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে এই রকম একটা সড়ক তৈরি করা প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। নদীতে একের পর এক বাঁধ ড্যাম নির্মাণ, নদী ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব।জলবায়ু পাল্টে দিচ্ছে।

পরিবেশবিদরা সব সময় বলছে এই সমস্ত বাঁধ পানি প্রবাহের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। কে শুনে কার কথা। এখন শুনা যাচ্ছে বাঁধ কাটা আর অনান্য অপরিকল্পিত অবকাঠামো ভাংগার প্রস্তুতি নিচ্ছে । বাঁধ ভাংগার সাথে অনেকেরই বড়লোক হবার বাঁধও ভেংগে যাবে।

মানুষ যেহেতু প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি ফলে প্রকৃতি দুর্যোগ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তবে মানুষের অর্জিত জ্ঞান ব্যাবহার করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়। এই রকম ভারী বৃষ্টিপাত
আগামীতেও বাড়তে থাকবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৌশল তৈরির জন্য আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে।

বন্যা কবলিতদের জন্য অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা শুভ্র দিল। সেও খুবই সচেষ্ট অর্থ সংগ্রহের জন্য। লায়ুদোভকে জানালাম আমাদের এই চরম দুর্দশার কথা। সেও খুব ব্যাথাতুর হৃদয়ে মানি ডোনেট করলো। আমার সাথে কাজ করে ওরা সবাই দিল। পরিমান এখানে গন্য নয়।একাত্ম হওয়া, সহমর্মী হওয়াই মুখ্য।

মনে সাধ, বানবাসি মানুষের জন্য যদি কিছু করতে পারতাম
আবার এটাও ভাবি..খাজনা পাতি তো ঠিক মতো দেয়া হয়নি,জমিতো নিলাম হবেই।

“পরের জায়গা পরের জমি
ঘর বানাইয়া আমি রই
আমিতো সেই ঘরের মালিক নই”।