বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৪৫)

– বিজন সাহা

বাংলায় একটা কথা আছে, বিপদে বন্ধু চেনা যায়। এটাকে একটু সম্প্রসারিত করে বলা যায় ক্রিটিক্যাল পরিস্থিতিতে মানুষ চেনা যায়। কারণ একমাত্র এসব পরিস্থিতিতেই মানুষ তার আসল রূপ তুলে ধরে। অন্য সময়ে যতই মুখোশ পরে থাক না কেন, ক্রিটিক্যাল পরিস্থতিতে মানুষ নিজের অজান্তেই মনের কথা বলে ফেলে।

বর্তমানে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে যা ঘটছে তা থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে, সুযোগ আছে মানুষ চেনার। এটা আমার ক্ষেত্রে যেমন সত্য তেমনি সত্য অন্যদের ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করেছি তারা এ প্রশ্নে বিভক্ত। এই বিভক্তির পেছনে যতটা না যুক্তি তারচেয়ে বেশি কাজ করে আবেগ। প্রথম কথা হল কেন রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করল। এখানে বিগত ৮ বছর ধরে দনবাসের মানুষের দুঃখ কষ্ট, এমনকি কিয়েভ প্রশাসন ইউক্রেনের মানুষদের একটি অংশের মাতৃভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা ও পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার অধিকার হরণ এসব কথা তারা মাথায় নেয় না। আর এখান থেকেই শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝির। আমি জানি, আমি বুঝি এদের অনেকেই এখন পশ্চিমা বিশ্বে অবস্থান করছেন, পশ্চিমের প্রোপ্যাগান্ডা তো আছেই তার পরেও আছে বৈষয়িক স্বার্থ। রাশিয়ার মানুষের কাছে থেকে চুরি করা ৩০০ বিলিয়ন ডলারের কিছু কিছু তাদের পকেটেও ঢুকবে এটা তারা না বললেও বুঝতে পারে। যেসব দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে অন্যান্য দেশ থেকে লুট করা সম্পদের উপর সেখানে আফগানিস্তানের ১ বিলিয়ন বা রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন – এটা তো নস্যি মাত্র। এসব বুঝি বলেই এক সংক্রান্ত ব্যাপার এড়িয়ে চলি, চেষ্টা করি এ নিয়ে তাদের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে না পড়তে। তবে অনেকেই অনেক সময় গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে। তারই একটা নমুনা নীচে। যার সাথে কথা হচ্ছে সে মস্কোয় পড়াশুনা করেছে, এখন আমেরিকা প্রবাসী। আগে যোগাযোগ থাকলেও বেশ কয়েক বছর সেটা ছিল না, তাও বলতে গেলে অকারণে। তবে ঘটনা সত্য। অনেক আগে একবার ও আমাকে বলেছিল
তুই তো আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে ট্যালেন্টেড ছেলেদের একজন ছিলি। আজ আমার আমেরিকায় কয়েকটা বাড়ি আর তোর কি আছে? না গাড়ি না বাড়ি কিচ্ছু না।

কথাটা ও মিথ্যা বলেনি। তবে একটা কিন্তু আছে। ও যখন সেই ছাত্র জীবনে গাড়ি বাড়ির স্বপ্ন দেখত আমি সে রকম কিছু দেখতাম না। আমার জন্য কাজের ফলের চেয়ে কাজের আনন্দই ছিল মুখ্য। সে কথা ওকে বললেও ঠিক বুঝল বলে মনে হয় না। তাই আমি নিজে থেকেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তবে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ওর বিভিন্ন পোস্ট আমি খেয়াল করেছি। দেখেছি অন্ধ রুশ বিরোধিতা। কিন্তু কোন কমেন্ট করা থেকে বিরত থেকেছি। তাছাড়া ও এতদিনে আমেরিকার যত লবন খেয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ায় খাওয়া লবন সে তুলনায় একেবারেই নগণ্য। যদিও একথা ঠিক যে আজ ওর এই জীবন গড়ার পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক অবদানই রেখেছে। তবে জীবনে এসবের মূল্য কম। শুধু একটাই সত্য আছে জীবনে – স্বার্থ। যাহোক আমাদের এক বড়ভাইয়ের লেখায় এক কমেন্টের কারণেই হয়তো ও আমাকে ইনবক্স করে। নীচে সেটাই দিচ্ছি।

– আমি তোর মতামতকে শ্রদ্ধা করি এবং তুই যে আদর্শে বিশ্বাস করিস সেটা মহান। চল আমরা অন্যদের মতামত ও বাক-স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই।

খুব ভাল কথা। তবে সব কিছুর প্রতি শ্রদ্ধা রাখা আর যাই হোক আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে ভাল মন্দ বলে কোন কিছুই থাকবে না। তাই উত্তরে লিখলাম
– কিন্তু আমি মিথ্যাকে শ্রদ্ধা করতে পারি না। আজ পশ্চিমা মাধ্যম যা প্রচার করছে তাতে প্রচুর ফেইক নিউজ। মনের ভাব প্রকাশ করার স্বাধীনতা মানে তো মিথ্যা বলার স্বাধীনতা নয়।

ওদিক থেকে উত্তর এলো

– আমরা সেটা দেখেছি সোভিয়েত আমলে। কিন্তু আমরা এখানে ভিন্ন ভাবে সেটা দেখি। সেখানকার সিস্টেম এতটাই ভণ্ড যে তারা পশ্চিমের সাথে ব্যবসা করতে চায়, পশ্চিমা ধাচের জীবন যাপন করতে চায়। সেটাকে আমরা কি বলব? বাংলাদেশের মতই অধিকাংশ নেতার মতই সেখানকার নেতাদের ছেলেমেয়েরা, পরিবারের অনেকেই পশ্চিমা বিশ্বে বাস করে, এখানে তারা সমৃদ্ধি লাভ করে। খুব বেশি দূরে যেতে হবে না, ক্যানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে তাকালেই তাদের দেখা যাবে। তাদের ভেনিজুয়েলা, উত্তর কোরিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নে (যার অস্তিত্ব এখন আর নেই) বাস করা। আমি রাশিয়াকে ভালবাসি। আমার সাধ্যমত আমি সাহায্য কয়ার চেষ্টা করব। তুই এখানে ব্যতিক্রমী।

কিছুক্ষণ পরে আবার মেসেজ এলো

– আমি বিশ্বাস করি না যে পৃথিবী আবার কখনও সোভিয়েত সিস্টেমে ফিরে যাবে। আমি বিশ্বাস করি যে পুতিন কোন ভাবেই এই যুদ্ধে জয়ী হতে পাবে না। ইউক্রেনের পুনর্নির্মাণের জন্য রাশিয়াকে মূল্য দিতে হবে। সমস্ত এক্স সোভিয়েত রিপাবলিক ভালবাসি। এসব রিপাবলিকের জনগণ দেশের বাড়ি থেকে এনে আমাদের বিনা মূল্যে শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলেছে। আমি সব সময়ই তাদের ভালবাসব। কিন্তু আমি যুদ্ধ পছন্দ করি না, হত্যা ও ধ্বংস পছন্দ করি না। ৮ বছরের বাচ্চা হিসেবে আমি একাত্তর দেখেছি। দেখেছি রাজাকার আর বিহারীদের সংঘটিত হত্যাকাণ্ড। আমি সেই আগের (নিজের নাম) আছি, তোর বন্ধু। কিন্তু আমার নিজের মতামত আছে এবং আমাদের একে অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করতে হবে।  আমরা একে অন্যেকে নিজের মতামত চাপিয়ে দেব না। আমরা বন্ধু এবং একে অন্যকে শ্রদ্ধা করি। করোনায় অনেককেই হারিয়েছি। এখন আর যুদ্ধে কাউকে হারাতে চাই না।

ভাবখানা এই শুধু রাশিয়া পশ্চিমাদের সাথে ব্যবসা করে, ওরা রাশিয়ার সাথে ব্যবসা করে না। যেন আমেরিকা বিগত ত্রিশ বছরে বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার মানুষ মারেনি। তাই ওর দীর্ঘ বক্তব্যের পরে লিখলাম

– বন্ধুত্ব আমার জন্যে এরচেয়ে বেশি কিছু। আমি “দ্বিমত পোষণ করতে রাজি” এই ফর্মুলায় বিশ্বাস করি। কিন্তু বন্ধুত্ব মানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের মতের মিল থাকতে হবে। তুই কেন বার বার পুতিন পুতিন করছিস? তুই তাঁকে জানিস? তিনি সমস্ত ব্যাপারেই পশ্চিমা বিশ্বের মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি শর্তহীন ভাবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন। তিনি নিজের দেশের নিরাপত্তা চেয়েছেন। কিন্তু পরিণতিতে নিজের সীমান্তে ন্যাটোর ঘাঁটি পেয়েছেন। আমেরিকা তাঁকে বাধ্য করেছে যুদ্ধে নামতে। তুই চাইলে এ ব্যাপারে আমার লেখাগুলো পাঠাতে পারি। আমি চেষ্টা করেছি যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ ভাবে এসব লিখতে। আপাতত এটুকুই। শুভকামনা।

এর উত্তর এলো কিছুক্ষণ পরেই।

– তুই তোর বিশ্বাস নিয়ে থাক। আমেরিকার উদ্দেশ্য রাশিয়ার অর্থনীতি ও রাশিয়ার সামরিক শক্তি ধ্বংস করে দেওয়া। রাশিয়ার অর্থনীতি টেক্সাস বা ইতালীর অর্থনীতির চেয়েও ছোট। মনে রাখিস সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কি ঘটেছিল। এখানে একটাই প্রশ্ন, পুতিন পরবর্তী রাশিয়া নিয়ে। আমরা জানি ডিক্টেটর, খুনী, কসাই আর যুদ্ধাপরাধী পুতিনকে। মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক ভাবে সে প্যারানইড। শীঘ্রই খুব কম দেশই রাশিয়ার তেল বা গ্যাস কিনবে। এই যুদ্ধ তেল ও গ্যাসের মার্কেট নিয়ে। ন্যাটো বা অন্যান্য কথা – এটা প্রোপ্যাগান্ডা। চীন রাশিয়ার রক্ষায় এগিয়ে আসবে না এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্যাঙ্কশন আরোপিত ২০-৩৫% অতিরিক্ত তেল ও গ্যাস কিনবে না। সুতরাং আমাদের আল্টিমেট লক্ষ্য রাশান অর্থনীতি ও সামরিক শক্তি ধ্বংস করা। তুই তোর বিশ্বাস নিয়েই থাক। ভাল থাকিস। এ সবই অর্থ আর ক্ষমতার জন্য। শীঘ্রই রাশিয়ার সাথে বানিজ্য করার কেউ থাকবে না, এমনকি আশেপাশের দেশগুলোও না। আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখ। বাস্তবতা হচ্ছে সবাই চায় সুন্দর জীবন, সুখ আর স্বাধীনতা।

 

অনেকক্ষণ ধরে ও অবশ্য কিছু সত্য কথাই লিখল ওদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে।  লিখলাম

– লক্ষ্য রাশিয়াকে ধ্বংস করা। আমরা এটা জানি। আমরা জানি আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব এটা করবে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া – এদের দিকে তাকিয়ে দেখ। পুতিনের জন্য নয়, এটা রাশিয়ার জন্য অস্তিত্বের প্রশ্ন। কিন্তু এরা জানে কি করতে হবে। আমি চিন্তিত এই ভেবে যে এই সব কিছুর সাথে শুধু রাশিয়া নয়, আমেরিকা, ইংল্যান্ড এমনকি ইউরোপের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। পারমাণবিক যুদ্ধ অবাস্তব কিছু নয়। আমার মনে হয় আমাদের আর এ নিয়ে আলোচনা চালানো ঠিক নয়। তুই তোর বিশ্বাস নিয়ে থাক। শুভকামনা ও বিদায়।

– কোন পারমাণবিক যুদ্ধ নয়। আমরা সেটা জানি। কিছুদিনের মধ্যেই রাশিয়ার টাকা শেষ হয়ে যাবে। বছরের শেষে। সব টাকা আটকে দেওয়া হয়েছে। আরও অনেক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে।

– জাহান্নামে যা তোর টাকা নিয়ে। নাকি তুই চাইছিস আমি তোকে ব্লক করি? আমার তোর সাথে কথা বলার বা তোর কথা শোনার ইচ্ছে একেবারেই নেই।

– গুড লাক। নিরাপদ ও সুস্থ্য থাকিস। ডিক্টেটর সমালোচনা পছন্দ করে না। তোর লেখা পাঠাস। যত্ন নিস। তুই চাইলে আমাকে ব্লক করতে পারিস। আমরা একেবারেই ভিন্ন। এথিক্যালি ও মোরালি দুই ভিন্ন জগতের মানুষ। নিজের যত্ন নিস। আমরা ভিন্ন এবং আমরা একে অন্যকে বুঝতে পারি না। যোগ্যরাই বেঁচে থাকে – সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট – তুই এটা জানিস।

আমার ধারণা এটা ওর একার নয় অনেকেরই কথা, যদিও ভিন্ন মতের লোকও আছে। এসব কথা বা স্ট্যাটাস থেকে আমি একটা জিনিসই টের পাই, আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বের সমস্ত কাজের ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে তাদের বিশ্বাস এতটাই অন্ধ যে ভিন্ন কোণ থেকে দেখার চেষ্টাই তারা করে না। এই অন্ধবিশ্বাস আর যাই হোক, তাদের গণতন্ত্র বা মানবতার সৈন্য করে না, উল্টো এসব গালভরা স্লোগানের আড়ালে যারা ভিন্নমতকে হত্যা করে, ধ্বংস করে দেশের পর দেশ – সেই সমস্ত দৈত্যদের ঢালে পরিণত করে। এ নিয়ে পরের পর্বে।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া