বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৪৪)

– বিজন সাহা    

২৪ এপ্রিল রুশ অর্থডক্স চার্চ ইস্টার পালন করল। সেখানে নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। বলেছিলাম বাসায় অনেকটা আমার উদ্যোগেই ইস্টার পালন করা হত, কেননা এর মধ্য দিয়ে আমি চেষ্টা করতাম ছেলেমেয়েদের এদেশের প্রাচীন সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। এটাও লিখেছিলাম যে এমনকি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও সেই সোভিয়েত আমলেও আমি চার্চে যেতাম বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতে। সে সময় চার্চে যেতেন মূলত বৃদ্ধা মহিলারা। আর অধিকাংশ সোভিয়েত পরিবারই তখন ছিল কমবেশি লেনিন পূজারী। ঠিক এই প্রসঙ্গেই এক বন্ধু লিখল

একেবারে কী যে সত্যি কথা সেটা এখনকার মানুষ বুঝবে না। ইনস্টিটিউটে, লাইব্রেরিতে, ঘরের কোণায় কোণায় লেনিনের মাথা…। এখন বুঝি যে, তখন নিশ্চয়ই এমন অনেক মানুষ ছিলেন যাঁদের এসব রাখতে ইচ্ছা করত না, তাও বাধ্য হয়ে সাজিয়ে রাখতেন। তারপর, বাড়াবাড়ি করলে যা হয় তাই হলো…।  আমরা সবকিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পর্যায়ে নিয়ে যাই কেন বলেন তো বিজন’দা? বাড়াবাড়ি করলে যে যেকোনো জিনিস তিতা হয়ে যায় সেটা আগেভাগে বুঝি না কেন? ধ্বংস হওয়ার পর টনক নড়ে, যাঃ বেশী হয়ে গেছিল, এতটা না করলেও হতো! কেন?

আমার মনে হয় এর উত্তর মানুষের প্রকৃতিতে। যেভাবে মানুষ একদিন ঈশ্বরের পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল ঠিক একই ভাবে সে যে তার থেকে কোন না কোন ভাবে সফল তাঁকে পূজা করতে রাজি। মানুষকে তেল দেওয়া তো অনেকটা সেই পূজা করার মতই। আর সেটা আমরা দেখতে পাই সর্বত্র। এর বেশির ভাগই হয় রাজনৈতিক কারণে। মনে আছে আগে রাজাকে বলা হত পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি? অর্থাৎ সেই প্রাচীন কাল থেকেই যখন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে তখন থেকে নানা ভাবে শাসক ও শোষকদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। পরবর্তীকালে এটা রাজনৈতিক দলের মধ্যেও ঢুকে গেছে। বিভিন্ন ভাবে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতাদের বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে আর তাদের মৃত্যুর পর নেতাদের ঘিরে গড়ে ওঠে বিভিন্ন রূপকথা। এসব অনেকটা ধর্ম প্রবর্তকদের স্টাইলেই করা হয়। এর মানে এই নয় যে আমি বলতে চাইছি বুদ্ধ, যীশু, লেনিন, গান্ধী এরা আর দশজন মানুষের মত ছিলেন। তাঁরা অবশ্যই মহামানব তবে পরবর্তীতে অনুসারীরা নিজেদের স্বার্থেই এদের অতিমানবীয় গুণাবলীতে ভূষিত করেছে। আর এসব করা হয়েছে অত্যন্ত সচেতন ভাবে মানুষের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় রেখে।

কিছুদিন আগেই একটা গল্প বলেছিলাম লেনিনকে নিয়ে। আমরা যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে আসি রুশ ভাষা ও নিজ নিজ স্পেশালিটির বাইরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস পড়তে হত, পড়তে হত ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, বৈজ্ঞানিক কমিউনিজম ইত্যাদি। প্রস্তুতি পর্বে আমাদের সুযোগ ছিল বাংলায় ইতিহাস পরীক্ষা দেবার। সেখানে আমাদের এক বড় ভাই শিক্ষককে আমাদের উত্তরগুলো রুশে অনুবাদ করে দিতেন, যদিও তিনি ইংরেজি জানতেন আর আমাদের ইতিহাস ক্লাস ইংরেজিতেই নিতেন। আমাদের এক সহপাঠীর প্রশ্ন ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর। ও কয়েকবার লেনিন লেনিন বলায় শিক্ষক প্রশ্ন করলেন, “দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে লেনিন এলেন কোত্থেকে?” বড় ভাই ওনাকে বুঝিয়ে বললেন, “ও আসলে বলছে লেনিন বেঁচে থাকলে মনে হয় যুদ্ধই হত না।” গল্পটা এ জন্যে করা যে এমনকি তখন আমাদেরও মনে হয়েছে লেনিন সমস্ত মুশকিল আসান। কিন্তু সমস্যা হল ধর্মের মতই নেতাদের ভাবমূর্তিকেও অনেকেই ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করে। সেটা আমরা দেখেছি সোভিয়েত ইউনিয়নে। এখন বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা কি দেখি? চারিদিকে মুজিব সেনা দিয়ে ভরা। তারা মুজিব কোট পরে ঘুরে বেড়ায়, কথায় কথায় শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিতে চায় অথচ বঙ্গবন্ধু যে আদর্শের জন্য, যে বাংলাদেশের জন্য লড়াই করেছিলেন এদের অধিকাংশই তার ধারে কাছেও যায় না। সমস্যা হয় এখানেই। আসলে ঘরে, বাইরে সর্বত্রই এরা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর ছবির পেছনে আড়াল করে রাখে। ফলে এদের কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ সেটা আমরা অনেক সময়ই বুঝে উঠতে পারি না। এটা বস্তুত যেকোনো দেশের বা যেকোনো দলের ক্ষেত্রেই বলা চলে।

এটা যে শুধু রাজনীতিবিদদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়। এই মনোভাব জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করছে। খেলাধুলার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ভগবানের দেখা পাই। তবে এজন্যে খেলোয়াড়রা দায়ী নয়, দায়ী আমাদের মত মানুষেরা যারা তাদের সেই দেবতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। এটা আমরা দেখি কবি সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল – এরাও কিন্তু নিজেদের অজান্তেই সেই প্যান্থিয়নে স্থান পেয়েছেন। গৌতম বুদ্ধে নিজে কখনও ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখেননি, অথচ মৃত্যুর পরে নিজেই অবতার বা ভগবান বনে গেছেন। এটা সেই “বাবু যত বলে পরিষদ দলে বলে তার শতগুণ” এর মত অবস্থা। এদিক থেকে বিজ্ঞানীরা মনে হয় ব্যতিক্রম। কেননা বিজ্ঞানীর কাজই হচ্ছে অন্য বিজ্ঞানীর, তা তিনি যত বড়ই হন না কেন, কাজকে সন্দেহ করা, প্রশ্ন করা, আর এই প্রশ্ন করে নতুন নতুন আবিষ্কারের পথে এগিয়ে যাওয়া। আইনস্টাইন, হকিং বা অন্যান্য বিজ্ঞানীদের প্রায় দেবতার আসনে বসিয়েছে সাধারণ মানুষ, বিজ্ঞানীরা নয়। বাইবেলে বলা হয়েছে যে «কাউকে বা কোন কিছুকে আইডল বানিও না বা দেবতার আসনে বসিও না।» এটা ঠিক আমরা রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলকে পূজার আসনে বসাই এদের কাজের প্রতি সম্মান জানানোর জন্যই। এবং সেটা ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিক যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা অন্ধ ভক্তিতে পরিণত হচ্ছে। কারণ ভক্তি যখন অন্ধ হয় তখন মানুষ সেই ভক্তির পাত্রকে সব রকম আলোচনা সমালোচনা বা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। তখন সে লোক হন সেই বিষয়ে উন্নতির শেষ সোপান, শেষ কথা।  আর শেষ সোপান থেকে উপরে ওঠার কোন পথ নেই, রাস্তা একটাই – নীচে নামার।  কিন্তু জ্ঞানের তো শেষ সোপান বলে কিছু নেই, আছে ক্রমাগত উপরে ওঠা, নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ করে নিজের কলেবর বৃদ্ধি করা। তাই আমরা যখন কাউকে, তা তিনি যত বড়ই হন, কোন বিষয়ে শেষ কথা না ভেবে তার চিন্তাকে, তার ভাবনাকে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা দ্বারা সমৃদ্ধ করব, সেটাই হবে তাঁর প্রতি সব চেয়ে বড়  শ্রদ্ধা। যেমন ধরুন কেউ যদি কোন খেলোয়াড়ের রেকর্ড ভাঙ্গে তাতে সেই খেলোয়াড় আগের জায়গায় না থাকলেও তার কিন্তু এতটুকু অসম্মান হয় না, উল্টো খেলাটা নতুন মাত্রায় পৌঁছে। বিজ্ঞানে যেমন বিজ্ঞানীরা রথী মহারথীদের চ্যালেঞ্জ করে নতুন কতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে সব ক্ষেত্রেই সেটা হতে পারে। মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন বা অন্য কেউ – এরাও কিন্তু  বলেননি যে তাদের কথাই শেষ কথা। তাঁরা শুধু পথ দেখিয়ে গেছেন, অন্যদের বলে গেছেন অন্য ভাবেও ভাবা যায়, কোন কাজ অন্য ভাবেও করা যায়। তারা দেখিয়ে গেছেন শোষণের বীভৎস চেহারা, বলে গেছেন শোষণ মুক্ত সমাজের কথা। যারা তাঁর অনুসারী তাদের উচিৎ ছিল তাঁদের পূজা না করে, তাঁদের কাজকে গবেষনার মাধ্যমে সামনে নিয়ে যাওয়া। একমাত্র সেটা করলেই শুধু তাঁদের প্রতি সম্মানই জানানো হয় না, তাঁদের কাজকেও দীর্ঘজীবী করা যায়। একই কথা খাটে অন্য যে কারও ক্ষেত্রেই। আসলে কাউকে আইডল বানানো মানে তাঁর সৃজনশীলতা রোধ করা। আর একজন মানুষ ততদিনই সৃজনশীল থাকেন যতদিন পর্যন্ত অন্য মানুষ তাঁর কাজ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে নতুন নতুন কাজ করে। যেমন আমরা যদি নিউটনকে দেবতা বানিয়ে পূজা করি তাতে না হবে নিউটনের লাভ, না হবে সমাজের লাভ। কিন্তু তার তত্ত্ব ব্যবহার করে আমরা এখনও আমাদের জীবন যাত্রার মান উন্নত করতে পারি। যত দিন এটা করা যাবে ততদিনই নিউটন বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। আর এটাই হবে নিউটনের কাজের প্রতি সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধা।  সুতরাং সমস্যা আসলে আমাদের, যারা নিজেরা উদ্যোগী না হয়ে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি আর এই সুযোগে কী ধর্মও ব্যবসায়ী, কী রাজনৈতিক ধান্দাবাজ আমাদের কাছে সমস্যা সমাধানের ট্যাবলেট বিক্রী করে। কিন্তু সমস্যার সমাধান তো এমনি এমনি হয় না, এর জন্য কাজ করতে হয়। আমরা যদি কাজ না করে অন্যের উপর ভরসা করে বসে থাকি আজ হোক আর কাল হোক মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়বেই। এই কাজ মানে আমাদের দৈনন্দিন কাজ নয়, এটা সমাজকে সামনে এগিয়ে নেবার কাজ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সবাই লেনিনের আশায় বসে ছিল, এখনও বিভিন্ন দেশে মানুষ বিভিন্ন জীবিত বা মৃত নেতাদের আশায় বসে থাকে। এর ফলে কি হয়। নেতা বদলায়, দল বদলায় – কয়েক বছর পর পর নতুন দল ক্ষমতায় আসে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমস্যা সেই আগের জায়গাতেই থেকে যায়। কেন? আমরা মানুষেরা বদলাই না, নিজেদের না বদলিয়ে শুধু অন্যদের কাছে সমস্যা সমাধানের আশা করলে তো হবে না। সমস্যা তাই মানুষের নিজের মধ্যে। মানুষ যখনই নিজের সমস্যা নিজে সমাধান করার চেষ্টা না করে অন্যের আশায় বসে থাকে তখনই জন্ম নেয় বিভিন্ন রকমের ধান্দাবাজ গুরু, ফকির, নেতা – যারা আসলে সমস্যার সামাধান করে না, মানুষের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের কাজ বাগিয়ে নেয়। এ থেকে বেরুনোর উপায় আছে কি? যতদিন মানুষের মধ্যে কাম, ক্রোধ, লোভ, হিংসা এসব থাকবে, আর এরা যেহেতু বায়োলোজিক্যাল, তাই থাকবে বলেই মনে হয় – ততদিন এরকম আইডল তৈরি হবেই। তবে সঠিক শিক্ষা দিয়ে সমাজে এর উপস্থিতি কমিয়ে আনা যায়। এটা অনেকটা ভ্যাক্সিনের মত। সবাইকে ভ্যাক্সিন না দিলেও চলে, দরকার ৭০ – ৯০% মানুষকে ভ্যাক্সিন দিয়ে কালেক্টিভ ইমিউনিটি তৈরি করা। দুর্নীতির জন্য ঘুষখোরের সাথে সাথে ঘুষ দেবার মানুষও দরকার। কিন্তু শিক্ষার মাধ্যমে তাদের সংখ্যা যদি একটা ক্রিটিক্যাল সীমার নীচে নামিয়ে আনা যায়, তাহলে অন্যান্য ব্যাধির মত দুর্নীতিও সমাজ থেকে নির্মূল না হলেও প্রায় মুছে যায়। এরা তখন আর সমাজে নিয়ামক শক্তি হতে পারে না। আর এভাবেই সম্ভব সমাজ থেকে ব্যাক্তি পূজার সংস্কৃতি চিরতরে দূর করা।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া