বিজ্ঞান প্রযুক্তি

জায়ান্ট পার্ল পেঁপে: বিরাট আকারের, বেশি ফলনের, সুস্বাদু কিন্তু হাইব্রিড নয়

জায়ান্ট পার্ল পেঁপে হাতে ডক্টর নজরুল ইসলাম।
জায়ান্ট পার্ল পেঁপে হাতে ড. নজরুল ইসলাম।

জাপানে মেরিন সায়েন্সে পিএইচডি করে বাংলাদেশে ফিরে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করা ড. নজরুল ইসলাম তার খামারে ফলিয়েছেন বিস্ময়কর এক পেঁপে, যার নাম জায়ান্ট পার্ল পেঁপে, যেটির একটিই ওজনে সাত থেকে আট কেজি ওজনের হয়ে থাকে।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের এই খামারে ফলন হওয়া পেঁপেটি কিন্তু কোন হাইব্রিড বা বিদেশি জাতের পেঁপে নয় বরং পুরাদস্তুর দেশী জাতের একটি পেঁপে।

অথচ ছোট সাইজের এই পেঁপে গাছে ফলন হচ্ছে ৩/৪ কেজি থেকে শুরু করে ৭/৮ কেজি ওজনের পেঁপে।

কোটচাঁদপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহাসীন আলী বলছেন যে, তারা ওই খামার পরিদর্শন করে পেঁপেগুলো দেখেছেন।

“এটি সাইজে অনেক বড় ও খেতেও সুস্বাদু। কৃষকরা এটি আবাদ করলে ভালো লাভবান হবে কারণ ফলনও অনেক হয়। বাজারে থাকা অন্য পেঁপের মতো সবজি হিসেবেও যেমন খাওয়া যায় আবার পাকা ফল হিসেবেও বিক্রি করা যাবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

মিস্টার আলী বলছেন, এলাকার কৃষকদের অনেকেই এখন ড. নজরুল ইসলামের কাছ থেকে চারা ও বীজ সংগ্রহ করছেন।

জায়ান্ট পার্ল পেঁপে
জায়ান্ট পার্ল পেঁপে

পেঁপে বাংলাদেশে কাঁচা ও পাকা – দু ভাবেই বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে কাঁচা পেঁপে সবজি হিসেবে আর পাকা পেঁপে ফল হিসেবে খাওয়া হয়।

বেশ পুষ্টিকর এই ফলটি কাঁচা থাকা অবস্থায় সবুজ রংয়ের আর পাকলে হলুদ বর্ণ বা লালচে হলুদ বর্ণ ধারণ করে।

অনেকে বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা এড়াতে কাচা ও পাকা পেঁপে খেয়ে থাকেন। এছাড়াও আরও অনেক কারণেই পেঁপে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার তালিকার থাকা একটি সবজি বা ফল।

কীভাবে এলো এই পেঁপে

ড. নজরুল ইসলাম পড়ালেখা করেছেন ফিশারিজ নিয়ে।

কিন্তু পরে জাপানে পিএইচডি করেন সমুদ্র বিজ্ঞান নিয়ে।

পরে দেশে ফিরে এসে যোগ দেন জাইকার একটি প্রকল্পে।

করোনার সময় প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে গ্রামে ফিরে কৃষিকাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নেন।

এরপর কোটচাঁদপুরে গড়ে তুলেছেন কৃষি খামার।

খামারের মধ্যে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছেন।

সেই পুকুর থেকে তোলা মাটিতে তিনি আবাদ করছেন জায়ান্ট পার্ল পেঁপের।

“এলাকারই একজন কৃষকের কাছ থেকে বীজটি পেয়েছিলাম আমি। তিনি যথাযথভাবে আবাদ করতে পারেননি বলে ফলন পাননি। আমি খামারের পুকুরের পাড়ের উর্বর মাটিতে আবাদ করলাম। বিশেষ কিছু কৌশল অবলম্বন করে সাফল্য পেলাম,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

মি. ইসলাম বলেন বাজারের হাইব্রিড পেঁপেও দেড় কেজি ওজনের বেশি সাধারণত হয় না কিন্তু আমার এই পেঁপে একটি ৭/৮ কেজি পর্যন্ত ওজনের হয়।

কৃষি কর্মকর্তা মো. মহাসীন আলীর মতে আকারের মতোই স্বাদের হওয়ায় এই পেঁপেটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

পাকা পেঁপে ফল হিসেবে বিশেষ প্রিয় গৃহবধূ ফারহানা ইসলামের।

তার শিশু সন্তানের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যার কারণে চিকিৎসক পেঁপে খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

“আমার খুব প্রিয় একটা ফল। আর বাচ্চার কারণে তরকারি হিসেবেও নিয়মিত পেঁপে খাই আমরা,” বলছিলেন তিনি।

অনেক কৃষকই এখন আগ্রহী হচ্ছেন।
অনেক কৃষকই এখন আগ্রহী হচ্ছেন।

কীভাবে ফলন ভালো হয়

ড. নজরুল ইসলাম বলছেন, প্রথমত মাটির মান খুব ভালো হতে হবে আর জৈব সার ব্যবহার করতে হবে।

তিনি বলেন, পুকুরের তোলা মাটি সাধারণত অনেক বেশি উর্বর হয় বলে তিনি পেঁপেটি আবাদের জন্য সেই মাটিকেই বেছে নিয়েছেন।

“পেঁপে চাষ সহজ মনে হলেও আসলে কিন্তু ততটা সহজ ব্যাপার না। আমি কখনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করিনি। বরং জৈব সার ব্যবহার করেছি,” বলছিলেন তিনি।

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পেঁপে চাষে সবসময়ই বিশেষ যত্ন নেয়ার পাশাপাশি অনেক ছোট ছোট বিষয় খেয়াল করতে হয়।

পেঁপে চাষের জন্য দরকার উঁচু জায়গা যেখানে পানি জমার সম্ভাবনা থাকবে না।

কারণ পেঁপে গাছের গোড়ায় একদিন পানি থাকলেও গাছটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

আবার হাইব্রিড পেঁপে অনেক ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও জায়ান্ট পার্ল পেঁপে খুব একটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয় না।

আর যে কোন পরিবেশের জন্য সহনশীল।

মিস্টার ইসলাম বলছেন, যে এ সব বিষয় চিন্তা করেই তিনি পুকুরের পাড়ের উঁচু জমিকে বেছে নিয়েছিলেন।

“সেখানকার মাটিও অনেক বেশি উর্বর ও পুষ্টিমান সম্পন্ন। আর সাথে জৈব সার দিলে উর্বরতা আরও বেড়ে যায়”।

এই পেঁপেটির ওজন সাড়ে সাত কেজির বেশি।
এই পেঁপেটির ওজন সাড়ে সাত কেজির বেশি।

ভালো ফলনের জন্য দরকার বিশেষ কৌশল

ড. নজরুল ইসলাম বলেন, এক একটি পেঁপে গাছে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ চার মন পর্যন্ত পেঁপে হতে পারে।

এর মধ্যে প্রথম দিকের পেঁপেগুলো ৭/৮ কেজি ওজনের হয়। কখনো কখনো দশ কেজি পর্যন্ত হতে পারে একটি পেঁপের ওজর।

আর দ্বিতীয় ধাপে যে পেঁপে পাওয়া যায় ওই একই গাছ থেকে সেগুলো ৪/৫ কেজি ওজনের হয়ে থাকে।

“তবে এক বছরে ফল সংগ্রহের পর দ্বিতীয় বছরের পর নতুন করে গাছ রোপণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

তাহলে আবার প্রথম দফার মতো বড় সাইজের পেঁপে পাওয়া যাবে”।

মিস্টার ইসলাম বলেন, চারা বোনার পর ছয় মাসের মধ্যে ফল বাজারে নেয়ার উপযোগী হয়।

“আমার কাছ থেকেই অনেকে এখন চারা বীজ নিচ্ছে। কিছুদিন আগে তিন হাজার বীজ করলাম। আশা করি এই ফলটি পেঁপের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে এটিকে আরও সহজলভ্য করে তুলবে,” বলছিলেন মিস্টার ইসলাম।

সূত্রঃ বিবসি বাংলা