মতামত

আমি সিরাজুল আলম খান বলছি – পাঠক প্রতিক্রিয়া (১)

– অপু সারোয়ার

স্বাধীন বাংলাদেশে সমতা ভিত্তিক সমাজের দাবীতে যুবকদেরকে আকৃষ্ট ও সংগঠিত করতে পেরেছিল জাসদ । সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচীর অভাব ছিল জাসদের। পথ চলতে – চলতে রাজনৈতিক দিশা ঠিক করতে হয়েছে জাসদকে। । চলার পথে কর্মীসূচীর চমক ছিল তবে  অভাব ছিল দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার । জাসদ জনগণের মনন বুঝতে পেরেছিল। জাসদ জানত তারা কি চায় না। তবে খুব সঠিকভাবে জানতো না তারা কি চায় এবং  কি ভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। জাসদের চলতি পথের প্রায় সব কর্মসূচীই ছিল হটাৎ হটাৎ জ্বলে উঠা। এই  জ্বলে উঠার প্রক্রিয়াতে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল জাসদকে।  রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও আত্মরক্ষার অস্থিরতা জাসদের কর্মসূচীকে প্রভাবিত করছে। এই অস্থিরতায়  কখনো হটকারী বা কখনো আপোষ কামী পথ মাড়িয়ে চলেছে জাসদীয় রাজনীতি । এভাবেই জাসদের আকর্ষণ ফিকে হয়ে আসে দল গঠনের এক দশকের কম সময়ের মধ্যে। ১৯৭২- থেকে ১৯৮০ সাল কে জাসদ রাজনীতির সোনালী সময় বলা যায়। এরপর ভাঙ্গন  জাসদ পরিবারের নিত্য সহচর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাঙ্গনী কূলের বিপ্লবী সুরের বাঁশি ওয়ালার হচ্ছেন আধা ডজন বাসদ নামের দল গুলি ।  আর  ঐক্যমতের সরকার , জাতীয় সরকার, ক্ষমতার অংশীদারিত্বের  তত্ব ও অনুশীলন কারীরা হচ্ছে  জাসদ পরিবার।

​সিরাজুল আলম খান জাসদের প্রধান তাত্ত্বিক ও অনুপ্রেরণার বাতিঘর ছিলেন ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। সিরাজুল আলম খান জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির পদ -পদবীতে না থাকার দাবী করে থাকেন। জাসদ রাজনীতির সামগ্রিক কাজের দায়দায়িত্ব থেকে নিজেকে রেহাই দেওয়ার প্রবণতাই এ দাবীর প্রধান কারন। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী   ভারতীয় কংগ্রেস দলের কোন পদ পদবীতে ছিলেন না। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর  প্রভাববলয় থেকে ভারতীয় কংগ্রেস মুক্ত ছিল না।  ১৯৪৮ সালে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী খুন হওয়ার কারনে ভারতীয় কংগ্রেসের মধ্যে বিদ্রোহ দেখতে হয় নাই। সমাজে সামন্ততন্ত্রিক প্রভাবের কারণে মৃত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী জীবিত গান্ধীর চেয়ে শক্তিশালী হিসাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিরাজমান। সিরাজুল আলম খান  জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে না থাকলেও ১৯৮০ সাল পর্যন্ত জাসদ সকল সিদ্ধান্তের সাথে যুক্ত ছিলেন।  উল্লেখিত দু’জনই তাদের দলের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন। যখনই এই দল দুইটিতে গুরুবাদিতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তখনই ভাঙ্গন হয়েছে।  সিরাজুল আলম খানের প্রভাব ও রাজনৈতিক সিদ্বান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল ১৯৭৫ সালের আগেই। ১৯৮০ সালে এই বিদ্রোহ দলের ভাঙ্গন আনে।

জাসদ রাজনীতি থেকে সিরাজুল আলম খানকে পৃথক করার কোন উপায় নেই। যদি কোন কারণে এই বিযুক্তিকরণ সম্ভব হয় তবে সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে আলোচনার কোন প্রয়োজনীয়তাই থাকবে না । জনাব খান জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার বাস্তবতাকে পিছনে ঠেলে দিয়ে সমসাময়িক রাজনীতির নির্বাচিত অংশ বিশেষ আলোচনা করতে চান।  এই চেষ্টাতেই আমি সিরাজুল আলম খান বলছি বই প্রকাশ।  প্রাক্তন জাসদ সংগঠক শামসু্দ্দিন পেয়ারা সিরাজুল আলম খানের বক্তব্যকে অপরবর্তিনীয়ভাবে লিপিবদ্ধ করার দাবী করেছেন। শামসু্দ্দিন পেয়ারা এই বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন “এই মুখবন্ধটি ছাড়া এ বইতে আমার নিজের লেখা কোনো কিছুই নেই। তিনি বলেছেন, আমি লিপিবদ্ধ করেছি। মুখের ভাষাকে লেখার ভাষায় রূপ দেবার জন্য ছাটো-খাটো  কোনো শব্দ যোগ বা বাক্যের বিন্যাস করতে হলে, তা করেছি। ”  এই মুখবন্ধকে আমলে নিলে বইটি সিরাজুল আলম খানের। সিরাজুল আলম খান এই বইয়ে  ” আমার সীমাবদ্ধতা ” নামে একটি অধ্যায় লিখে এই বইকে নির্ভরযোগ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

এই বইয়ের শ্রুতি লিপিবদ্ধ কারক শামসু্দ্দিন পেয়ারা , পেশায় সাংবাদিক। অধুনালুপ্ত জাসদের দৈনিক পত্রিকা গণকণ্ঠের সাংবাদিক ও সংগঠক ছিলেন জনাব  শামসু্দ্দিন পেয়ারা। সাংবাদিকতায় পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতায় সিক্ত। এই বইটি যে পাঠকেকে হতাশ করবে সে ইঙ্গিত জনাব  শামসু্দ্দিন পেয়ারা অস্পষ্ট রাখেন নাই । জনাব শামসু্দ্দিন পেয়ারার ভাষায় ” অনেক বিষয় আমি ইচ্ছে করে তাকে [ সি আ খান ]জিজ্ঞেস করিনি। তিনিও ইচ্ছে করেই অনেক বিষয় এড়িয়ে গেছেন বা বলেননি। ” ( পৃষ্ঠা ১৩) । কেন অনেক বিষয় জিজ্ঞাসা করা থেকে বিরত থাকা বা কেন  অনেক বিষয় এড়িয়ে যাওয়া এর কোন রকম ব্যাখ্যা বা পাদটীকা যুক্ত করতে সাংবাদিক শামসু্দ্দিন পেয়ারা অসমর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। সিরাজুল আলম খান অনেক কিছু এড়িয়ে যাবার কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। সিরাজুল আলম খান কে দায়মুক্তির দেওয়ার চেষ্টায় সাংবাদিকতার অনুসন্ধিৎসুতা কে কি শামসু্দ্দিন পেয়ারা মাটি চাপা দিয়েছেন ? এই জাতীয় সাধারণ প্রশ্ন নিয়েই অনেকেই বইটি পড়া শুরুতে বাধ্য হবেন সচেতন পাঠকগণ। জনাব শামসু্দ্দিন পেয়ারা বইয়ের মলাটে নিজের পরিচয় লিখেছেন ” ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তাঁর নেতৃত্বাধীন রাজনীতির কর্মী ছিলেন। বর্তমানে মোহমুক্ত। “শামসু্দ্দিন পেয়ারা নিজেকে মোহমুক্ত হিসেবে দাবী করেছেন। সিরাজুল আলম খানকে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকাকে নিঃসন্দেহে অতি অল্প সংখক মানুষই মোহমুক্তি আলামত হিসেবে গ্রহণ করবেন।

সিরাজুল আলম খান । রাজনৈতিক গবেষকদের কাছে অতি পরিচিত নাম । তবে সাধারণ জনগণের কাছে নামটি বিশেষ পরিচিত নয়। পিছনে থেকে কল কাঠি নাড়ার সুনাম ও অভিযোগ দুইয়ের সাথে সিরাজুল আলম খানের নাম জড়িত। লম্বা সময় সামনে না এসেও আলোচনায় থাকা বিশেষ সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য জনাব খান প্রশংসিত হবেন। তিনি রাজনৈতিক নেতাদের মত প্রকাশ্য বক্তৃতা – বিবৃতি বা মিটিং মিছিলে অংশ নেওয়া থেকে গুটিয়ে রাখতে পেরেছেন পাঁচ দশকের বেশী সময়।  সিরাজুল আলম খান  ১৯৬০ এর দশক থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রাজনীতি নিয়ে অর্থবহ – নির্মোহ  কোন লেখা থেকেও হাত গুটিয়ে রেখেছেন।  জনাব খান ও তাঁর অনুগামীরা বিভিন্ন সময় না লেখার কারণ গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা -উদ্যোগ নিয়ে আসছেন। সিরাজুল ইসলাম খানের নিজ বয়ানে  বিষয়টি “ আমি তো লিখতে পারি না।“ ( সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো -০৪ জুন ২০১৯ ) । সিরাজুল আলম খান লিখতে পারেন না কথা সত্য নয়। সিরাজুল আলম খান লিখতে না পাড়ার অজুহাতকে নিজেই মিথ্যে প্রমান করেছেন ছোট বড় ডজন খানেক বই লিখে। খোলা বাজারে এই বইগুলির সহজলভ্যতা, তাঁর না লিখতে পাড়ার দাবীকে নাকচ করে দিয়ে সত্য না বলার কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জনাব সিরাজুল আলম খানকে ।

 

বাংলা ভাষায় লেখার পাশাপাশি তিনি ইংরেজীতেও কয়েকটি বই ও বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন জনাব খান। ‘২১ শতকের বাঙালি’ সিরাজুল আলম খানের সাম্প্রতিক প্রকাশিত বই।

  1. On Constitution and constitutional issues (1983) – By Mr. Serajul Alam Khan and Mr. Zillur Rahman Khan
  2. Constitution and constitutional issues: comparative studies, analysis & prospects (1984) – By Mr. Serajul Alam Khan and Mr. Zillur Rahman Khan
  3. To establish a ‘sub-regional economic zone’ within South Asia & South East Asia with special reference to Bangladesh – By Mr. Serajul Alam Khan

যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে সিরাজুল আলম খানের  কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে  সমতা ভিত্তিক সমাজ গঠনে যুব সমাজের বড় অংশ জাসদ – জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এর সাথে যুক্ত হয়েছিল। জাসদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন  করতে যেয়ে হাজার – হাজার কর্মী রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল সময়কালের মধ্যে। বেশ কিছু কর্মীর ঠাঁই মিলেছে কবরে। সেই সময়ের রাজনৈতিক কর্মীদের অনেকেই  আজও দিশেহারা। ১৯৭২-১৯৭৫ সালের মধ্যে জাসদ বা অপরাপর বামপন্থী দলের কত লোক মারা গিয়েছিলেন এর কোন নির্ভর যোগ্য তথ্য নেই। অনুমান নির্ভর প্রচার রয়েছে মাত্র। সেই সময়কালের বামপন্থীদের মধ্যে জাসদের এক মাত্র দেশব্যাপী সংগঠন ছিল। খুনের শিকার রাজনৈতিক কর্মীদের বড় অংশই জাসদের।  অপরাপর বামপন্থী দল গুলি ছিল আঞ্চলিক সংগঠন। যেমন আব্দুল হকের পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট  পার্টি (এম এল ) এর কাজ ছিল প্রধানত বৃহত্তর যশোর-খুলনা অঞ্চলে। মতিন- টিপু বিশ্বাসের পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কাজ ছিল প্রধানত বৃহত্তর পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলে। সর্বহারা পার্টির কাজ ছিল প্রধানত ফরিদপুর- বরিশাল – ঢাকায়। মোহাম্মদ তোয়াহার সাম্যবাদী দলের কাজ বিক্ষিপ্ত ভাবে রাজশাহী , বগুড়া ,কিশোরগঞ্জ, ঢাকার নবাবগঞ্জ এলাকায় ছিল।

সিরাজুল আলম খান সহ জাসদের কেউই দায়িত্ব নিয়ে দেশের মানুষকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা কি করতে চেয়েছিলেন এবং কি কারণে ব্যর্থ হয়েছেন । কি বিচ্যুতি ঘটেছিলো। অতীত মূল্যায়নের নামে জাসদের একাংশ ১৯৮০ সালে দল থেকে বেড়িয়ে বাসদ গঠন করে দায়দায়িত্ব থেকে নিজেদের রেহাই দেবার চেষ্টা করেছেন। জাসদ রাজনীতির দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকার প্রচেষ্টাতে বাসদ বিপ্লবী দল, উন্নত সংস্কৃতি ইত্যাকার গুরু গম্ভীর বিষয় আলোচ্য সূচীতে ঠাঁই দিয়েছে মাত্র ।  জাসদ নামের বিভিন্ন অংশ অতীত আলোচনায় করতে কোন ভাবেই আগ্রহী হয়ে উঠে নাই। এখন নতুন করে ইতিহাস লেখার চেষ্টা চলছে। ১৯৭২ সালে জাসদ গঠনের পরে কে কতোটা শেখ মুজিবর রহমানের কাছের মানুষ ছিলেন! এই প্রবণতার চরম প্রকাশ হচ্ছে “আমি সিরাজুল আলম খান বলছি “পুস্তক।

আমি সিরাজুল আলম খান বইয়ের প্রকাশ কাল ২০১৯ সাল। তবে এই বইয়ের রাজনৈতিক গুরুত্ব বহনকারী বক্তব্যকে সামনে আনা হয়েছিল মহিউদ্দিন আহমদ, ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির   সময়ের রাজনীতি’, প্রকাশ কাল ২০১৪, বইয়ের মাধ্যমে। মহিউদ্দিন আহমদের বয়ানে শেখ মুজিবর রহমানের সাথে সিরাজুল আলম খানের সম্পর্ক হচ্ছে

  • “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের একটা বিশেষ সম্পর্ক ছিল, যা শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল।” “তাঁর বাসায় কখনো পুলিশ যায়নি। এ ব্যাপারে শেখ     মুজিবের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল।
  • “চুয়াত্তরের ডিসেম্বরে শেখ মুজিব তাঁর আস্থাভাজন সাইদুর রহমানকে সিরাজুল আলম খানের কাছে   পাঠালেন।” “অনেক দিন পর গুরু-শিষ্যের দেখা হলো। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন।”

(মহিউদ্দিন আহমদ, ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির   সময়ের রাজনীতি'(প্রথমা: অক্টোবর, ২০১৪), পৃ.১৫৭

ঠিক এই বক্তব্য গুলি ” আমি সিরাজুল আলম খান ” বইয়ে বলা হয়েছে  শব্দের হেরফের করে বক্তব্য অপরিবর্তনীয় রেখে সরাসরি সিরাজুল আলম খানের বয়ানে।  আবার একই বক্তব্য এসেছে মহিউদ্দিন আহমেদের ” প্রতিনায়ক ” বইয়ে। একই বক্তব্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে । ১৯৭২-১৯৭৫ সাল সময় কালে  সিরাজুল আলম খান শেখ মুজিবের খুব কাছের মানুষ ছিলেন এই বক্তব্যকে প্রতিষ্টিত করতে অন্য সত্যটি বেরিয়ে এসেছে , যখন কর্মীরা সরকারী নিপীড়নের শিকার সেই মুহূর্তে প্রধান তাত্বিক গোপনে আঁতাত করছেন সরকারের সাথে ।

আমি সিরাজুল আলম খান বইয়ে অতি কথন ও দুমড়ানো সত্যের বয়ান সহজেই চোখে পড়ে। তবে সবচেয়ে বড় দুমড়ানো সত্য হচ্ছে সিরাজুল আলম খানের কারা  মুক্তির দিনক্ষণ- বছর বর্ণনায় । জনাব খান দাবী করছেন তিনি ১৯৮১ সালে জেল থেকে ছাড়া পান ( পৃষ্ঠা ১৮ ও ৩৫)। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ১৯৮০ সালের মে মাসে ময়মনসিংহ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন জনাব খান । জেলের নথি বা পত্র পত্রিকা ঘেটে সঠিক দিন ক্ষণ বেড় করার দায় -দায়িত্ব গবেষকদের। সাধারণ  মানুষ অনেক কিছুকে মনে রাখে কোন একটি বড় ঘটনা দিয়ে। জাসদ রাজনীতির বড় দুর্ঘটনা ১৯৮০ সালের ভাঙ্গন। এই ভাঙ্গনের প্রক্রিয়া শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিরাজুল আলম খান ঢাকায় মুক্ত ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। যাঁরা সিরাজুল আলম খানের কারামুক্তির বছর ১৯৮১ সাল কে প্রশ্নাতীত ভাবে মেনে নিয়েছেন তাঁদের কাছে প্রশ্ন সিরাজুল আলম খানকে জেলে রেখে কি জাসদের ভাঙ্গন সম্ভব ছিল ? ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সিরাজুল আলম খান জেলে ছিলেন এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে সিরাজুল আলম খান জাসদ ভাঙ্গনের দায় -দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন মাত্র।

শামসু্দ্দিন পেয়ারা কতটুকু নির্মোহ ভাবে অনুলিখন করেছেন তা নিশ্চিত হওয়ার কোন পথ নেই।  তবে গুরুভক্তিতে দুই / চারটি অতিকথনের স্বাক্ষর রেখেছেন শামসু্দ্দিন পেয়ারা।  যেমন শামসু্দ্দিন পেয়ারা মুখবন্ধে লিখেছেন ” তিনি [ সি আ খান ] সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন।” সাধারণ ভাবে অনেকেই জনাব খানকে সমাজতন্ত্রী মনে করে থাকবে। তবে আমি সিরাজুল আলম খান বলছি বা অন্য কোন বইয়ে সিরাজুল আলম খান কখনোই দাবী করেন নাই তিনি কোন কালে সমাজতন্ত্রী ছিলেন। বরঞ্চ তিনি সমাজতন্ত্রী ছিলেন না সেই কথা অস্পষ্ট রাখেন নাই। সিরাজুল আলম খান বলছি বইয়ে ” মূলত কমিনিজমের বিরোধিতা করার জন্য আমার এসব [ মার্ক্সবাদী ] বই পড়ার প্রয়োজন মনে করেছিলাম। ”  (পৃষ্ঠা ৫৭ ) । এ যেন গুরুর বচন শিষ্যের গালে হালকা চপোটাঘাত !

প্রকাশকের উল্টো যাত্রা

‘আমি সিরাজুল আলম খান :একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য’ বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাওলা ব্রাদার্স। কোন প্রকাশক কর্তৃক বই বাজার থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনা সচরাচর ঘটেনা। এই বইয়ের বক্তব্য নিয়ে যে কোন মানুষের ভিন্ন মত থাকতে পারে। সেই মত বিরোধ এর নিস্পত্তির একমাত্র পথ হওয়া উচিত বুদ্ধিবিত্তিক। এই বইয়ের সমালোচনা বা জবাব হিসেবে বই প্রকাশ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই বইয়ের ক্ষেত্রে ঘটেছে ব্যতিক্রম।  দৈনিক সমকাল ১৩ জুন ২০১৯এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল ” মাওলা ব্রাদার্সের কো-অর্ডিনেটর মামুনুর রশিদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ”আমাদের প্রকাশিত শামসুদ্দিন পেয়ারা অনুলিখনকৃত ‘আমি সিরাজুল ইসলাম খান :একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য’ বইটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় আমরা বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।”

সমকালের প্রতিবেদন বই নিয়ে বর্তমান সরকারের মনোভাব তুলে ধরেছে ” সোমবার গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্যপুরুষ’ হিসেবে পরিচিত সিরাজুল আলম খানের বইটি নিয়ে কথা ওঠে। আওয়ামী লীগের সাবেক দুই মন্ত্রী এবং দলের উপদেষ্টা পরিষদের প্রবীণ সদস্য আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ এই বইটি নিয়ে আলোচনার সময় ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টি তুলে ধরেন। তাদের অভিযোগ, সিরাজুল আলম খানের এই বইটি মিথ্যা তথ্যে ভরা। আমিত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বইটিতে সম্পূর্ণ অসত্য তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে একমত প্রকাশ করেন। এ নিয়ে আলোচনা শেষে আমু ও তোফায়েলকে ইতিহাসের সত্য ঘটনা গণমাধ্যমে তুলে ধরতে দলীয়ভাবে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর দু’দিন বাদেই বইটি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিল প্রকাশনা সংস্থা। “-  সরকার বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা না করেও কায়দা করে বইটি জনচক্ষুর আড়ালে ঠেলে দিয়েছে । এক ধরনের সরকারি চাপ। মওলা ব্রাদার্স এই  চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে।

দৈনিক ইনকিলাব বই প্রত্যাহার নিয়ে লিখেছে ”  বসুন্ধরা গ্ৰুপের  বাংলা দৈনিকটি এই বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা শুরু করে। প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয় ৩ জুন শনিবার। পত্রিকাটির দ্বিতীয় শীর্ষ সংবাদের স্থলে এই ধারাবাহিকটি প্রকাশ শুরু হয়। শিরোনাম ‘আমি সিরাজুল আলম খান’। এই শিরোনামে পত্রিকাটি পরপর পাঁচটি পর্ব প্রকাশ করে। দুই তিনটি পর্ব প্রকাশিত হলে সাবেক মন্ত্রী এবং বর্তমান এমপি তোফায়েল আহমেদ সিরাজুল আলম খানকে টেলিফোন করেন এবং বলেন যে বইটিতে পরিবেশিত অধিকাংশ তথ্যই অসত্য এবং বানোয়াট। তিনি এসব মিথ্যা তথ্যের লিখিত প্রতিবাদ করবেন। তোফায়েল আহমেদের এই টেলিফোনের পরেও সিরাজুল আলম খানের বইয়ের পাঁচটি সিরিজ প্রকাশিত হয়। তারপরে সিরিজ প্রকাশনা অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে সংবাদ পত্রে এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয় যে মওলা ব্রাদার্স দেশের সমস্ত লাইব্রেরি থেকে সিরাজুল আলম খানের বইটি প্রত্যাহার করেছে। ফলে ষষ্ঠ সিরিজের পর আর কোনো সিরিজ প্রকাশিত হয়নি। ……………………….. যেদিন সিরাজুল আলম খানের বইটির ধারাবাহিক প্রকাশ হওয়া বন্ধ হয়ে যায় তার পর দিন থেকেই তোফায়েল আহমেদের আর একটি ধারাবাহিক প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়। রবিবার ১৬ জুন পর্যন্ত একই পত্রিকায় একই স্থানে (প্রথম পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় প্রধান সংবাদকে যেভাবে ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়) সে ভাবেই সেই স্থানেই তোফায়েল আহমেদের বক্তব্য ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছে। (১৮ জুন, ২০১৯)

সিরাজুল আলম খান বা জাসদের সাথে  আওয়ামীলীগ সরকারের  বিরোধের কারণ ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের জাসদের ভূমিকা। আওয়ামীলীগের কোন কোন নেতার সাথে এই বিরোধের সূত্রপাত যুদ্ধপূর্ব কালে তৎকালীন ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পার্থক্য। এই মত পার্থক্যের অন্যতম দিক হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের কার ভূমিকা কি ছিল। উভয় পক্ষই মুক্তি যুদ্ধে আওয়ামীলীগ – ছাত্রলীগের বাইরে অন্য সকল শক্তির ভূমিকাকে নাকচ করার  বিষয়ে একমত-দ্বিমত নিজেদের কর্তৃত্ব ভাগাভাগী নিয়ে। সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক সমালোচনাকে কোনো ভাবেই সরকারী কাফেলার আওয়াজ ভাবার কোন অবকাশ নেই। সরকারী কাফেলার সমালোচনা হচ্ছে পরমত অসহিঞ্চুতা , বিষোদগার ও প্রকাশনা বন্ধের পথ  খোঁজা। রাজনৈতিক সমালোচনা হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখা,  ছলে বলে- কৌশলে প্রকাশনা বন্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা ও বিচার মূলক পর্যালোচনা অব্যাহত রাখা।

অপু সারোয়ারঃ ফ্রীল্যান্স লেখক