মতামত

দেশের মানুষ সুখে নেই

– ফজলুল কবির মিন্টু

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথা পিছু বার্ষিক আয় ২৫৫৪ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনগনের প্রত্যেকের বার্ষিক  আয় ২৫৫৪ ডলার। বর্তমানে ১ ডলারের মূল্য বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮৬ টাকার কিছু বেশী। সে হিসাবে ২৫৫৪ ডলার সমান বাংলাদেশী টাকায় প্রায়  ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকা হবে। বাংলাদেশের গড় পারিবারিক সদস্য সংখ্যা ৪ জন। সুতরাং পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে বাংলাদেশে প্রত্যেক পরিবারের বার্ষিক আয় হবে প্রায় ৮ লক্ষ আশি হাজার টাকা। কিন্তু বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ পরিবারের বার্ষিক আয় বাস্তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবের তুলনায় বহুগুন কম।

একথা সত্য যে, পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় ধনী এবং গরীবের অস্তিত্ব যখন বিদ্যমান সেখানে আয় বৈষম্য থাকবে। যেহেতু ধনী-গরীবের সংমিশ্রণে সারাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় নির্নয় করা হয় গরীবের আয় মাথাপিছু জাতীয় আয়ের তুলনায় কম হওয়ায় স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কতটুকু কম হবে? অর্থাৎ ধনী এবং গরীবের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু হলে সেটা অর্থনীতির ভাষায় গ্রহণযোগ্য বা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বলে বিবেচনা করা যেতে পারে?

বিশ্বব্যাপী গিনি সহগ নির্ণয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটা চিত্র পাওয়া যায়। গিনিসহগের ফলাফল ০ থেকে ১ এর মধ্যে সীমাবদ্ধে রেখে প্রকাশ করা হয়। কোন দেশের গিনি সহগ ০ হলে সে দেশের অর্থনীতিতে বৈষম্য নেই বলে বিবেচিত হয়। কোন দেশের গিনি সহগের মান  ০ থেকে যতই ১ এর দিকে ধাবিত হবে সে দেশের মানুষের মধ্যে আয় বৈষম্য তত বেশী বলে বিবেচিত হবে। অর্থনীতিবিদদের মতে কোন দেশের গিনিসহগের মান ০.৪৫ এর বেশী হওয়া উচিৎ নয়। কারণ  কোন দেশের গিনিসহগের মান ০.৪৫ এর বেশী হলেই সে দেশের অর্থনীতি চরম বৈষম্যমূলক বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে ২০২০ সালে লকডাউনের পূর্বে ই গিনিসহগের মান ছিল ০.৪৮২। অর্থাৎ করোনা শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই এদেশের অর্থনীতি চরম বৈষম্যমূলক ছিল। করোনার অভিঘাতে সেটা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

করোনার অভিঘাতে অনেক মধ্যবিত্ত – নিম্ন মধ্যবিত্ত হয়েছে, অনেক নিম্ন মধ্যবিত্ত –অতি দরিদ্র হয়েছে। বিভিন্নপত্র-পত্রিকার রিপোর্টিং এবং গবেষণার হিসাব অনুযায়ী করোনার পূর্বে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি ছিল কিন্তু করোনাকালে তা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ছয় কোটি হয়েছে অর্থাৎ করোনাকালীন প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে।

এখানে লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, একদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে দেশে কোটিপতি মানুষের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে এক কোটি টাকার বেশী আছে এমন আমানতধারীর সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার ৮ শত ৯০ জন। ঠিক এক বছর পরে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে এক কোটি টাকার বেশী আছে এমন আমানতধারীর সংখ্যা  দাঁড়ায় ১ লক্ষ ১ হাজার ৯ শত ৭৬ জন। সুতরাং ১ বছরে কোটিপতি আমানতধারীর সংখ্যা বেড়েছে ৮ হাজার ৮৬ জন। একদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি অন্যদিকে কোটিপতি মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির এ চিত্রের মাধ্যমে দেশের মানুষের আয় বৈষম্য চরমভাবে ফুটে উঠেছে। সেটা গিনি সহগের মধ্যেও দেখা যায় করোনাকালীন দেশে গিনিসহগের মান দাঁড়িয়েছে ০.৬৩৫। বিশ্বের সবচেয়ে বেশী আয় বৈষম্যের দেশ হচ্ছে দক্ষিন আফ্রিকা। দক্ষিন আফ্রিকার গিনি সহগ ০.৬৩ । বর্তমানে গিনিসহগের মান বিবেচনায় বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকা একই কাতারে অবস্থান করছে।

পালমা অনুপাত নির্ণয় করেও বিভিন্ন দেশের মানুষের আয় বৈষম্য নির্ণয় করা হয়।দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে পালমা অনুপাতও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।  লকডাউনের আগে এদেশে পালমা অনুপাত ছিল ২.৯২ এবং লকডাউনের পরে পালমা অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৭.৫৩। সুতরাং পালমা অনুপাত নির্ণয়ের মাধ্যমেও বাংলাদেশের মানুষের আয় বৈষম্যের চিত্র অনুমান করা যায়।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নব নির্বাচিত সভাপতি কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম গত ১২ মার্চ ‘২২ চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে চট্টগ্রামের স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে এক মত বিনিময় সভায় বলেন, দেশের মানুষ আজ দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে ৯৫ ভাগ, অন্যদিকে মুষ্টিমেয় ৫ ভাগ। দেশের বেশীরভাগ সম্পদ ৫ ভাগ মানুষের নিয়ন্ত্রনে। এরা বাজার থেকে শুরু করে সংসদ পর্যন্ত সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। ফলশ্রুতিতে দেশের ৯৫ ভাগ মানুষের কোন রকম খেয়ে পুড়ে বেঁচে থাকাই আজ কঠিন হয়ে পড়েছে। মানুষের ন্যুনতম জীবন মানের নিশ্চয়তা নেই। গিনি সহগ এবং পালমা অনুপাত বিশ্লেষণ করলে কমরেড শাহ আলমের বক্তব্যের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যাবে।

দেশের মানুষের আয় বৈষম্য বা অর্থনৈতিক সংকট বুঝার জন্য খুব বড় অর্থনীতিবিদ বা রাজনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। এমনকি গিনি সহগ কিংবা পালমা অনুপাত বিশ্লেষণ করাও খুব বেশী জরুরী নয়। শুধু ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে টিসিবি’র ট্রাকের পেছনে গরীব-নিম্নবিত্ত মানুষের দীর্ঘ লাইন এবং একই সাথে বিভিন্ন সুপার শপে ধনীদের লাইন দেখেও অনুমান করা যায়।

আজ ২০ মার্চ, বিশ্ব সুখ দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের সাত ধাপ উন্নতি হয়েছে। পূর্ববর্তী বছরে বাংলাদেশের অবাস্থান ছিল ১০১। এ বছর সাত ধাপ এগিয়ে ৯৪তে উন্নীত হয়েছে। জিডিপি, সামাজিক সুরক্ষা, কাঙ্ক্ষিত গড় আয়ূ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, মানবিকতা, দুর্নীতির ধারণা এবং সার্বিক দুর্দশা ইত্যাদি সাত মানদন্ডের ভিত্তিতে এই তালিকা করা হয়ে থাকে। এ ধরনের তালিকা প্রণয়ন সম্পর্কে আমার ধারণা নাই। তাই তালিকাটা কতটুকু সঠিক কিংবা শুভংকরের ফাঁকি কোথায় সেটাও বুঝতে পারছিনা

অবশ্য এদেশের গ্রাম বাঙলার সাধারণ মানুষের বড় গুন হচ্ছে বড় দুর্দিনেও মানুষ প্রান খুলে হাসতে পারে। চরম কষ্টের মধ্যে থেকেও বলতে পারে ভাল আছি। কিন্তু বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে নির্দিধায় বলতে পারি আমি কিংবা আমরা কেউ কিন্তু সুখে নেই। এদশের ৬ কোটি দরিদ্র মানুষ কিংবা সাড়ে ৬ কোটি শ্রমজীবী মানুষ কেউ সুখে নেই। দেশের মাত্র ৫ ভাগ অতি ধনী বাদ দিলে বাকী ৯৫ ভাগ মানুষ সুখে নেই।

লেখকঃ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক