বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৩৬)

– বিজন সাহা

রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে বিভিন্ন রকমের পোস্টে ছেয়ে গেছে নেট। পক্ষে বিপক্ষে সব রকমের লেখাই আছে। তবে কমবেশি সবাই যুদ্ধের বিপক্ষে। আর এটাই স্বাভাবিক। তবে এ নিয়ে আমার দুটো কথা আছে। এক বন্ধু তার স্ট্যাটাসে একাত্তরের যুদ্ধের সেই নিদারুণ দিনগুলোর কথা উল্লেখ করে লিখেছে যুদ্ধের প্রতি তার ঘৃণার কথা। সেখানে আমি বলেছিলাম অন্ধভাবে কোন কিছুর পক্ষে বা বিপক্ষে বলাটা মনে হয় ঠিক না। যুদ্ধ – এটা এক ধরণের বিপর্যয়, ধ্বংসাত্মক ঘটনাপ্রবাহ। প্রকৃতি কি নিজেই মাঝে মধ্যে ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে না? আসলে যখনই শক্তির বা প্রকৃতির ক্ষেত্রে বলা যায় চাপের ভারসাম্য নষ্ট হয়, দেখা দেয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মানুষ প্রকৃতির অংশ। সমাজেও সেই ভারসাম্য নষ্ট হয়, সেটা নষ্ট হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এই ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে সামরিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বা অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে। তখন সমাজেও দরকার হয় এক ধরণের স্থিতি আর সেটা হয় বিপ্লব, যুদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে। ঐ ভাবে দেখলে যুদ্ধ তো এক রকম প্রতিযোগিতা। এই যে আমরা খেলাধুলা করি, পরীক্ষায় প্রথম হতে চাই,  দশ জনকে পেছনে ফেলে নিজের জন্য চাকরিটা চাই, চাই গাড়ি বাড়ি কত কি, আর সেটা অন্যদের পরোক্ষ ভাবে বঞ্চিত করে। এমনকি প্রতিনিয়ত নিজের সাথেই যুদ্ধ করি কোন পথে যাব, কি পড়লে ভাল হবে এমন হাজারো প্রশ্নে। এই প্রতিযোগিতা, এই যুদ্ধ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই যুদ্ধ চাই না বলাটা নিজেকে ভুলিয়ে রাখা।

তবে এখানে কথা হচ্ছে কি ধরণের যুদ্ধ আমরা চাই। কুরুক্ষেত্রে যখন চারিদিকে আত্মীয় স্বজন দেখে অর্জুন যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেন শ্রীকৃষ্ণ তাকে বিভিন্ন ভাবে যুদ্ধ করতে রাজী করানোর চেষ্টা করেন।  সেখানে তিনি বলেন যখন পৃথিবীতে ধর্ম ভূলুণ্ঠিত হয় তখন সাধুদের রক্ষা আর দুর্বৃত্তদের ধ্বংস করতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আমরা এটাকে অন্যভাবে দেখতে পারি – যখন সমাজে ন্যায় ভূলুণ্ঠিত হয়, অন্যায়ে ভরে যায় সব  তখন এই অন্যায় এই অসহায় অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করার জন্য কোন কোন নেতা জনতাকে জাগিয়ে তুলেন নিজেদের হিস্যা বুঝে নেবার জন্য। অনেক কিছুর মত যুদ্ধও দুই রকম – ন্যায় যুদ্ধ আর অন্যায় যুদ্ধ। একাত্তরের যুদ্ধ বাঙালির জন্য ছিল ন্যায় যুদ্ধ আর পাকিস্তানের জন্য অন্যায় যুদ্ধ। জানি, সব কিছুই আপেক্ষিক। তারা সেটাকে একেবারে উল্টো দিক থেকে দেখতে পারে, কিন্তু হাজারো যুক্তির পরেও আমরা আমাদের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে পারব। আর তার একটা বড় কারণ আমরা আক্রান্ত হয়েছিলাম। যে আত্মরক্ষা করে ন্যায়ের পাল্লা তার দিকেই ভারি হয়।

এখন আমরা ঘটনাটা অন্যভাবে কল্পনা করি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার সংগ্রামের ডাক দেন। তিনি বলেন যদি বাংলার মানুষের উপর আক্রমণ নেমে আসে সবাই যার যা আছে তাই নিয়ে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর মোকাবিলায়। এ থেকে আমরা দুটো সিদ্ধান্তে আসতে পারি। প্রথমত এরকম একটা আক্রমণ আসতে পারে সে ব্যাপারে তিনি কমবেশি অবগত ছিলেন বা বলা যায় নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে এমন ঘটনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। দ্বিতীয়ত তিনি আক্রমণ নয়, আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করতে বলেছেন। তার কারণ সেক্ষেত্রে তাঁকে কেউ বিচ্ছিনতাবাদী হিসেবে অপবাদ দিতে পারবে না। এখন ধরা যাক, ৭ মার্চের পর থেকে যেসব ঘটনা ঘটছিল, মানে একের পর এক অস্ত্র বোঝাই বিমান এসে নামছিল তেজগাঁ বিমান বন্দরে (কিয়েভের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ) তাতে হয়তো যুদ্ধ যে আসন্ন সেটা অনুমান করা যাচ্ছিল। আর যুদ্ধ যেহেতু অবশ্যম্ভাবী তাহলে যদি তিনি বা দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণের অপেক্ষা না করে বেঙ্গল রেজিমেন্ট সহ অন্যান্য বাঙালি সেনাদের বলতেন পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে তাহলে হয়তো ২৬ মার্চের ম্যাসাকার হত না। হ্যাঁ, বিচ্ছিনতাবাদের অপবাদ আসত, হয়তো আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে সমর্থন পেতে আরও বেশি খড়কুটো পুড়াতে হত, কিন্তু সেটার মূল্য কি ঐ রাতে হাজার হাজার নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষের প্রাণের চেয়ে বেশি হত? আমাদের তো সেই যুদ্ধে নামতেই হল, ত্রিশ লাখ প্রাণ দিতে হল – তাহলে? এই যে যারা অন্ধভাবে যুদ্ধের বিপক্ষে বলছেন তারা কি ভাবেন, তাহলে একাত্তরে প্রতিরোধ গড়ার দরকার ছিল না, তাহলে তো কয়েক হাজার প্রাণের মধ্য দিয়েই সব শেষ হয়ে যেত। তাই আমার মনে হয় যুদ্ধ না চাইলেও একবার যদি যুদ্ধটা লেগেই যায় তখন সেটার সমগ্র প্রেক্ষিত খুব ভালভাবে যাচাই করে যুদ্ধের ব্যাপারে মত দিতে হয়। একাত্তরে আমরা যদি এভাবে যুদ্ধ না চাইতাম – তাহলে কি হত? হ্যাঁ, পরবর্তীতে যারা রাজাকার, আলবদর হয়েছিল – তাদের হাতে জিম্মি হয়ে আনন্দে দিন কাটাতাম। তখন হয়তো যুদ্ধ চাই না সেটা বলারও অধিকার আমাদের অনেকেরই থাকত না। নাকি এখানে আমরা অন্য ভাবে ভাবি, যেমন একাত্তর ঠিক ছিল, বাহান্ন ঠিক ছিল। আমরা আমাদের অধিকার পেয়ে গেছি, এখন অন্যদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমরা কেন কষ্ট করব। এটা অনেকটা আমাদের দেশের বিরোধী দলগুলোর বয়ানের মত। তারা ক্ষমতার বাইরে থাকাকালীন সরকারের বিভিন্ন দমন নীতির সমালোচনা করে, তার বিলোপ চায়, কিন্তু ক্ষমতায় গেলে এসব আইন ব্যবহার করে বিরোধী দলগুলোকে হয়রানি করে। আরও একটা কথা, যুদ্ধ সাধারণত এমনি এমনি লাগে না, কোন না কোন পক্ষ কারও উপর চাপিয়ে দেয়। মনে নেই সেই গল্পের কথা যখন উকিল এসে ছোট ভাইকে উস্কানি দিত বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করতে। ফলে এক সময় শুধু বড় ভাইয়ের নয়, ছোট ভাইয়ের সম্পত্তিও উকিলের হয়ে যায়।

যুদ্ধও এক ধরণের ব্যবসা, প্রচণ্ড লাভজনক ব্যবসা। রুশরা বলে কামু ভাইনা, আ কামু মাত রাদনা মানে কারও জন্য যুদ্ধ আর কারও জন্য আপন মা। বোঝা যাচ্ছে না? এই যুদ্ধে একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, অন্য দিকে অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যাচ্ছে। একটু খোঁজ করলে দেখবেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধের পেছনে আছে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থ, তাও যেমন তেমন নয় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের স্বার্থ। যতদিন পর্যন্ত যুদ্ধ এই সমস্ত রাঘব বোয়ালদের জন্য লাভবান থাকবে ততদিন যুদ্ধ থাকবে। তাই যুদ্ধ বন্ধের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে হলে শুধু অপছন্দের একনায়কদের বিরুদ্ধে স্লোগান না দিয়ে এই সমস্ত ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। কিন্তু সেটা পারবেন না, কারণ তাদের কাছে আপনার ভালমন্দ, আপনার ভবিষ্যৎ, আপনার বর্তমান, এমনকি আপনার অতীত পর্যন্ত বন্ধক দেওয়া। তাই আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, দনবাসের সাধারণ মানুষের কষ্ট আপনার টেলিস্কোপে ধরা পড়বে না, সেখানে সব কিছু ছাপিয়ে ভেসে উঠবে সাদ্দাম, গাদ্দাফী, আসাদদের মুখ। সেখানে উস্কানিদাতা বাইডেন নয়, পুতিন। কেন? কারণ আপনারা শুধু সেই সত্যে বিশ্বাস করেন যে সত্যটা আপনাদের পক্ষে যায়। কারণ সত্যটা শুধু আপনাদের দোকানেই বিক্রি হয়। কারণ সত্যের কোন অবজেক্টিভ রিয়ালিটি নেই, সে আজ শুধুই সাবজেক্টিভ। কারণ সেটাই সত্য যেটা আপনার মুখ থেকে নিঃসৃত হয়।

আমার প্রায়ই একটা গল্প মনে পড়ে। গল্প নয়, একটা মানসিক এক্সপেরিমেন্ট। ধরুন একজন লোক প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। অনেকের কাছে অনেক বার চেয়েও এতটুকু খাবার পেল না। প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সে জানে আত্মহত্যা মহাপাপ, তাই মহাপাপ থেকে মুক্তি পেতে সে এক দোকান থেকে একটুকরা রুটি চুরি করল। এখন কথা হল যদি সে চুরি না করে অনাহারে মারা যেত সেই লোকের প্রতি সহানুভূতি জানানোর মানুষের অভাব হত না। অনেকেই বলত, আহারে না খেয়ে মরে গেল? কারও কাছে একটু খাবার চাইলেই তো অকালে মরতে হত না। কিন্তু যে মুহূর্তে সে প্রাণ বাঁচাতে চুরি করল, সে আর আপনাদের সহানুভূতির পাত্র নয়, সে চোর। এখন আপনারা তাকে ঘৃণা করবেন এটাই স্বাভাবিক। কেন এটা করেন আপনি? কারণ এভাবেই আপনাকে শেখানো হয়েছে। আপনাকে কারণ খুঁজতে শেখানো হয়নি, আপনার কাজ বিচার করা। না ঠিক বিচার করা নয়, আপনার হয়ে অন্যেরা আগেই বিচার করেছে, আপনার কাজ সেই রায়টা যত জোরে সম্ভব মানুষের কাছে ঘোষণা করা।

আমাদের মনে রাখতে হবে যুদ্ধ যেমন আগ্রাসনের জন্য হয়, তেমনি হয় স্বাধীনতার জন্য। যুদ্ধের শুধু নেগেটিভ দিকই নেই, আছে পজিটিভ দিকও। ১৯৯৭ সালে ভুবনেশ্বর গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্সে কয়েক দিনের ভিজিটে। সেখান থেকে যাই ধবল গিরি এক্সারশনে। এখানেই সম্রাট অশোক শেষ বারের মত যুদ্ধ করেন। সেই যুদ্ধে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী নাকি রক্তে লাল হয়ে গেছিল আর এত রক্ত দেখে তিনি এতটাই শোকাহত হন যে এরপর আর কোন যুদ্ধ করেননি। সেখানেই শুনেছিলাম যুদ্ধের আগে তাঁর সেনাবাহিনী, হস্তী, অশ্ব থেকে শুরু করে সরবরাহকারী দল যাতে নির্বিঘ্নে রণক্ষেত্রে পৌঁছুতে পারে এজন্য তিনি রাস্তা তৈরি করেন। মানে যুদ্ধের মাঠে ধ্বংসের সাথে সাথে সৃষ্টিও উপস্থিত হয়। শেষ পর্যন্ত ধ্বংস না সৃষ্টি কোনটা জিতবে সেটা নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির উপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্য থেকেই জন্ম নিয়েছে কালজয়ী টেকনোলজি। আমরা আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে জয়জয়কার দেখতে পাচ্ছি সেটাও ওই যুদ্ধের হাত ধরেই এসেছে। এই টেকনোলজির প্রায় সবই সামরিক তাগিদ থেকেই তৈরি হয়ছে যা পরে এসেছে নাগরিক জীবনে। তাই অন্ধত্ব নয় খোলা চোখে, খোলা মনে সব বিচার করাই শ্রেয়। মৃত্যুকে ভালবাসতে নেই কিন্তু মৃত্যু যেখানে অবশ্যম্ভাবী সেখানে সেটাকে মেনে নিয়েই জীবনটাকে আনন্দময় করে তুলতে হয়। একই ভাবে যুদ্ধও যেহেতু জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা মাথায় রেখে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে, থাকতে হবে ন্যায় যুদ্ধের পক্ষে। শান্তি নিঃসন্দেহে দরকার, তবে সেটা যেন যেকোনো মূল্যে না হয়। কারণ তাহলে শান্তি তো থাকবেই না, জীবনও থাকবে না।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া