মতামত

সমর যুদ্ধটা প্রক্সি, বাজার নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধটাই মূল

– দেব প্রসাদ দেবু

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ বা রাশিয়ার আগ্রাসন- যে নামেই বলি না কেন, সেটি ক্রমে সমস্ত অনুমানকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে সব আঙ্গিক থেকেই। সামরিক শক্তি বিবেচনায় নিয়ে অনেকেই ধারণা করেছিলেন এই যুদ্ধ স্বল্প মেয়াদী কিছু একটা হবে। ইউক্রেইন টিকে থাকতে পারবে না রাশিয়ার দানবীয় সামরিক শক্তির কাছে। আবার অন্য একটা অংশ শুরুতে আশা করেছিলো পশ্চিমারা যতো উচ্চস্বরে হুমকী দিচ্ছে, ততোটা কঠোরভাবে রাশিয়ার অর্থনৈতিক টুঁটি চেপে ধরবে না টালমাটাল বিশ্ব বাজারের কথা ভেবে। কিন্তু ক্রমে সেই সব প্রেডিকশন ফিকে হতে শুরু করেছে। নানান সমীকরণে ইউক্রেইন এখনো প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে, আবার নানান বাস্তবতার মধ্যেও পশ্চিমারা অর্থনৈতিক অবরোধের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। এসব নানান অভিনব ঘটনার ডামাডোলে চলমান বিশ্ব ব্যবস্থাতেও আনপ্রেডিক্টেবল ঘটনা ঘটে চলেছে। দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা তার “দুশমন” দেশ ভেনিজুয়েলা কিংবা ইরানকেও ছাড় দিতে রাজি আছে রাশিয়াকে ঠেকাতে। সেই লক্ষ্যে নানান ইস্যুতে ছাড় দিয়ে হলেও এই দুই দেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলমান আছে। এদিকে আরেক পরাশক্তি চীন এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো মুভ দেয়নি রাশিয়ে ইউক্রেইন যুদ্ধ নিয়ে। ধরি মাছ, না ছুঁই পানি কূটনীতির পথেই চীন হাঁটছে এখন পর্যন্ত। আমরা ইতোমধ্যে খবরে দেখেছি পুতিন শীতকালীন অলিম্পিক শুরুর অনুষ্ঠানে পিকিং গিয়েছিলেন এবং চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে ফটোসেশন করে এসেছেন এবং বলেছেন চীন-রাশিয়া সম্পর্কের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। এটাও বলা হচ্ছে চীনের অনুরোধেই পুতিন হামলা পিছিয়েছেন। অর্থাৎ যেকোনো মূল্যে চীনকে হাতে রেখেই রাশিয়া এই বাজি ধরতে গিয়েছিলো। কিন্তু সমস্যাটা হলো বিশ্বব্যাপী চীনের পরাশক্তি হয়ে উঠার পেছনের কারণ মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং সারা বিশ্বব্যাপী চীনের বণিক জাল বিস্তার। আমেরিকা কিংবা চীনের ভেতরকার লড়াইটাও আদর্শিক কোনো লড়াই নয়। এটি বাজার দখলের লড়াই, বাজার বাড়ানোর লড়াই, বাজারে খবরদারি করার লড়াই। ফলে রাশিয়াকে ‘লাইফ লাইন’ দিতে চীন নিজেকে উজাড় করে দেবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম, যদি না তাতে করে আমেরিকার অর্থনীতিতে মারাত্মক টান পড়ার সুস্পষ্ট সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেইন যুদ্ধ ইউরোপের অর্থনীতিকে সমস্যাসংকুল করে দিলেও আমেরিকার অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব উল্লেখযোগ্য হারে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বরং অর্থনীতি নতুন করে গতি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কেননা ইউরোপের দেশগুলো এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে এবং আমেরিকার তাতে করে আয় বাড়ার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি চীন তার বাজারকে হুমকিতে ফেলে রাশিয়ার পাশে বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে দাঁড়াবে না। খবরদারি কিংবা রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় অস্ত্র অর্থনীতি এবং বলা হয়ে থাকে অর্থনৈতিক অবরোধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি মারাত্মক “পারমানবিক অস্ত্র”। এটি হজম করে টিকে থাকা রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার বিশ্বায়নের এই বিশ্বে। যদি কেউ এটি মোকাবেলা করে টিকে থাকে তবে তাকে থাকতে হয় অনেকটা দারিদ্র ভাগাভাগি করে। সমস্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উন্নতির বদলে দারিদ্র ভাগাভাগি করে আছে ইরান, ভেনিজুয়েলার মতো দেশগুলো। রাশিয়া এতো বড় ঝুঁকি তাহলে নিলো কেন? তারা কি জানতো না স্যাংশন অবধারিত? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, জানতো। ইনফ্যাক্ট, নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষক সংস্থা ক্যাস্টেলুম ডট এআই এর তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনে হামলা শুরুর আগে অর্থাৎ ২২শে ফেব্রুয়ারির আগে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ২ হাজার ৭৫৪টি স্যাংশন জারি ছিল। হামলার পরে নতুন আরও ২ হাজার ৭৭৮টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এখন মোট নিষেধাজ্ঞার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৩২টি। দেশ বিবেচনায় এটি বিশ্বরেকর্ডও বটে! এই নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি নিয়েই রাশিয়া ইউক্রেইনে আগ্রাসনে নেমেছে। শুধু তাই নয়, সম্ভাব্য এই নিষেধাজ্ঞার কথা মাথায় রেখে রাশিয়া নিজের অর্থনীতিকে সাজাতে শুরু করেছে বহু আগে থেকেই। এখনো পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে কারেন্সির সেফ হেভেন বলতে ডলার। যেকোনো ভোলাটাইল সিচ্যুয়েশনে সেন্ট্রাল ব্যাংকগুলো তার রিজার্ভের বড় অংশ ডলারে কনভার্ট করে নেয় সম্ভাব্য এক্সচেঞ্জ লস থেকে রক্ষা পেতে। কিন্তু রাশিয়ার ছিলো ডলারে নিষেধাজ্ঞায় পড়ার সম্ভাবনা, তাই তারা তাদের রিজার্ভকে কনভার্ট করেছে স্বর্ণে, ইউরোতে এবং চাইনিজ কারেন্সি আরএমবিতে। ২০১৮ সালেই আমেরিকান ট্রেজারি বন্ডে ৯৬.১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ নামিয়ে আনা হয় ১৪.৯০ বিলিয়ন ডলারে। ১০১ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নামানো হয়েছে অর্ধেকে। চায়নার সাথে রাশিয়ার সমস্ত লেনদেনের বাহক এখন ইউরো, যেটি আগে ছিলো ডলারে। ২০১৪ সাল থেকেই সুইফটের বিকল্প হিসেবে SPFS নামের আলাদা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। অনুরূপ একটা নেটওয়ার্ক চীনের আছে যেটির নাম CIPS। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর নেতৃত্বে ডিজিটাল কারেন্সি প্রচলনের কাজ চলছে। এগুলো শুধু যে স্যাংশন থেকে নিজেকে রক্ষা করার পদক্ষেপ তা-ই নয়, এগুলো ডলারের একক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বিশ্বে বিকল্প লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। CIPS নেটওয়ার্ক চায়নার তেমনই একটা প্রচেষ্টা। হ্যাঁ, SWIFT এর কাছে এগুলো এখনো নস্যি। SWIFT শুরু হয়েছে ১৯৭৩ সালে। ফলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে SPFS/CIPSকে। কিন্তু এটা স্পষ্ট ফাইনান্সিয়াল লেনদেনে আমেরিকার একক আধিপত্য ভবিষ্যতে থাকবে না। প্রশ্ন হতে পারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও তো রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাহলে ডলার টু ইউরো’তে গিয়ে রাশিয়া কীভাবে সিকিউর করলো নিজেকে? গত কিছুদিনের নিউজ পড়লে দেখবেন আমেরিকার সর্বাত্মক চাপাচাপির পরও ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার উপর তেল এবং গ্যাসে নিষেধাজ্ঞা দিতে রাজি হয়নি। হয়নি কারণ এটি তাদের পক্ষে সম্ভব না নিজের দৈনন্দিন উপযোগিতার কারণেই। এই সেক্টরে ইউরোপের বড় নির্ভরতা রাশিয়ার উপর। ফলে ইউরোতে রাশিয়ার লেনদেন অব্যাহত থাকবে এবং সেই লেনদেনের জন্য সুইফটের এক্সেস পুরোপুরি বন্ধও হয়নি। কিন্তু সুইফট পুরোপুরিভাবে বন্ধ না হলেও রাশিয়া তার অবন্ধু দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে ইতোমধ্যে। যেটিতে আছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সব দেশ। শর্ত অনুসারে এই তালিকাভুক্ত দেশের কেউ রাশিয়ার সাথে লেনদেন করতে চাইলে রাশিয়ান মুদ্রা রুবলে পেমেন্ট দিতে হবে এবং রাশিয়ার কোনো ব্যাংকে একাউন্ট থাকতে হবে! ফলে ইউরোপের দেশ গুলো তেল-গ্যাস কিনতে এই শর্ত মানতে হবে। বুঝাই যাচ্ছে রাশিয়ার সবচে বড় অস্ত্র ইউরোপের বাজারে গ্যাস রপ্তানি। যে কারণে তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা দিলে তারা গ্যাস না দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক পারমানবিক অস্ত্র থেকে নিজেকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা এবং কৌশল রাশিয়া আগেই ঠিক করে রেখেছে। তারপরও কি রাশিয়ার অর্থনৈতিক বিপর্যয় থামবে? না, থামবে না। কিন্তু যেই পরিমাণ বিপর্যয় অবধারিত ছিলো তারচেয়ে কম বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে রাশিয়া টিকে যাবার সম্ভাবনা আছে। বিপরীতে আমেরিকারও ঝুঁকি আছে ওয়ার্ল্ড মার্কেট ক্রমে ডি-ডলারাইজড হয়ে যাবার। কারণ চায়না-রাশিয়া দুই দেশই সেই চেষ্টার দৌড়ে আছে পূর্ণ শক্তি নিয়ে। আমেরিকার ভয়ও ঠিক এই যায়গাটাতেই। ইউক্রেইনের সাথে আমেরিকার এমন কোনো হৃদ্যতার সম্পর্ক নেই বা আমেরিকা এমন কোনো মানবিক রাষ্ট্র নয় যে নিপীড়িতের পক্ষে সর্ব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ইরাক, আফগানিস্তান কিংবা লিবিয়াতে মুক্তিকামীর পক্ষে মানবিকতার ঢালি নিয়ে এগিয়ে আসা আমেরিকাকে আমরা খুঁজে পাইনি। আমেরিকার লক্ষ্য বাজারকে কেন্দ্র করে বলেই চীনকে হুমকি দিয়ে রেখেছে- রাশিয়ার সাথে কোনো ধরণের সহযোগিতা মূলক আচরণকে তারা সহ্য করবে না বলে। এই যায়গায় আমেরিকার ভয়টা রাশিয়ার টিকে যাওয়াতে নয়, বিশ্ব অর্থনীতি ডি-ডলারাইজড হয়ে যাওয়াতে। ফলে যুদ্ধটা ঠিক রাশিয়া-ইউক্রেইনের না। যুদ্ধটা রাশিয়া-আমেরিকারই তবে সেটি দৃশ্যমান সামরিক সমর নয়, অদৃশ্য অর্থনীতি কিংবা বাজার নিয়ন্ত্রণের।