মতামত

ইসলামপুর লবণ কারখানা শ্রমিকদের জীবনমান

– মোঃ জাহিন উদ্দীন (শাহিন)

ভূমিকাঃ- স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মাষ্টার মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক উদ্যোক্তা ইসলামপুর লঞ্চ ঘাটে কক্সবাজার সল্ট ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ নামে লবণ মিল স্থাপন করে। কালের পরিক্রমায় বর্তমানে ৭০টি লবণ মিল স্থাপিত হয়েছে। এখন নিয়মিত প্রক্রিয়াজাত কার্যক্রম চালাচ্ছে অর্ধশত মিল। কক্সবাজার জেলার অধিকাংশ লবণ এখানে এনে ক্রাশ করা হয়। আর দেশের ৯৫ শতাংশ লবণ কক্সবাজারে উৎপন্ন হয়। বর্ষাকালে ইসলামপুর থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০/৩০টি ট্রাক লবণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।  অন্যান্য সময় প্রায় দৈনিক প্রায় ৬০/৭০টি ট্রাক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। জাতীয় অর্থনীতিতে লাবণ শিল্পখাত প্রতি বছর ১২০০ কোটি টাকা অবদান রাখছে। বাংলাদেশের প্রায় ১০/১৫ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লবণ শিল্পের উপর নির্ভরশীল।

কর্ম পদ্ধতীঃ- শীত এলেই, পটিয়া, বাঁশখালী, পটিয়া, মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত লবণ মাঠ থেকে লবণ তুলে তা সরাসরি ট্রাক অথবা নৌকা যোগে ইসলামপুর লবণ কারখানায় আনা হয়।  প্রতিটি কারখানায় ১৫/৩০ জন শ্রমিক কাজ করে। মাঠ থেকে সংগ্রহ করা লবণ পরিষ্কার করে বিক্রির জন্য তৈরী করেন। এই সমস্ত কারখানা ২ প্রকার লবণ তৈরী করেন। একটি হচ্ছে শিল্প লবণ অপরটি হচ্ছে ভোজ্য লবণ। রহামানিয়া সল্ট শিল্প লবণ তৈরী করে। এস আর সল্ট ভোজ্য লবণ তৈরী করে।
১) রহমানিয়া সল্টঃ- তারা মাঠ থেকে এনে শিল্প কারখানায় সরবরাহ করার জন্য লবণ প্রক্রিয়া করে থাকে। লবণ প্রথমে গুদামজাত করে এরপর সে লবণ একটি লবণ মিশ্রিত ট্যাংকে রাখে সেখান থেকে পাম্পের সাহায্যে লবণ পানি মিশ্রিত পানির সাথে লবণগুলো আরেকটা ট্যাংকে পাঠানো হয়। সে ট্যাংক থেকে ২ জন শ্রমিক পাত্রের সাহায্যে আরেকটা ট্যাংকে লবণগুলো পাঠায়। সে ট্যাংক থেকে আরো ২ জন শ্রমিক একটা ক্র্যাশ মিশিনে হোপারে দেয়। অতঃপর লবণ আরো পরিষ্কার ও আকারো ছোট হয়ে আরেকটা লবণ পানি মিশ্রিত ট্যাংকে জমা হয়। প্রতি ট্যাংকে লবণগুলো ২/৩ মিনিট পর্যন্ত রাখা হয়। এই ভাবে ৫টি ট্যাংকের মাধ্যমে লবণ গুলো পরিশোধিত করে শ্রমিকরা বস্তায় ভরে শিল্প কারখানায় সরবরাহ করার জন্য তৈরী করে থাকে।
২) এস আর সল্টঃ- ভোজ্য লবণ করার পদ্ধতি-শিল্প কারখানায় সরবরাহ করার জন্য যে লবণ প্রস্তুত করা হয়। সেই লবণ ভোজ্য লবণ তৈরী করার জন্য প্রস্তুত করা হয়। শিল্প লবণগুলো প্রথমে পানি মিশ্রিত ট্যাংকে রাখা হয়। এই ট্যাংক থেকে পাম্পের সাহায্যে লবণগুলো ক্র্যাশ মিশিনে দেওয়া হয়। সেখান থেকে লবণ মিশ্রিত আরেখটা ট্যাংকে রাখা হয় এবং সেই ট্যাংক থেকে পাম্পের সাহায্যে আরেকটা ক্র্যাশ মিশিনে দেওয়া হয়। এই ভাবে লবণগুলোকে শিল্প লবণের দানা থেকে অনেক ছোট দানা রূপান্তর করে আরো পরিষ্কার করে ভোজ্য লবনের উপযোগী করে তুলা হয়। ভোজ্য লবণকে আয়োডিন যুক্ত লবণ পরিণত করার জন্য আয়োডিন ঘাটতি পূরণের লক্ষ জুলাই ১৯৮৯ হতে ২০০০ মেয়াদে সার্বজনীন আয়োডিন যুক্ত লবণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। সরকার ১১ ডিসেম্বর ১৯৯৪ সালে আয়োডিনে অভাব জনিত রোগ প্রতিরোধ আইন ১৯৮৯ জারি করেন। এই আইনি আওতায় ১৯৯৫ সাল থেকে আয়োডিন যুক্তি ভোজ্য লবণ ব্যতিত কোন ভোজ্য লবণ উৎপাদন বিপন্ন ও গুদাম জাত নিষিদ্ধ করা হয়। ইউনিসেফের কারিগরি সাহয়তায় বেসিক এর মাধ্যমে ২৬৭টি কারখানায় আয়োডিন সংমিশ্রন মেশিন বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়। তদারকির জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লোক নিয়োগ দান করা হয়। সেই সুবাদে এস আর সল্ট কারখানায় একটি আয়োডিন মিশ্রিত করণ মেশিন দেখতে পায়। সেই মেশিনের সাহায্যে লবণগুলো আয়োডিন মিশ্রন করে বাজার জাত করার জন্য পেকেট জাত করা হয়।
বসবাসঃ- অধিকাংশ শ্রমিক বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছে। তবে স্থানীয় লোকজন এই পেশার সাথে জড়িত। তাদের ঘরগুলো খুবই নিম্মমাণের।
কর্মঘন্টাঃ- তারা সকাল ৮ থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত কাজ করেন। তবে মৌসুমে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়।
মুজুরীঃ- দৈনিক ভিত্তিক কোন শ্রমিক নাই। উৎপাদান ভিত্তিক তারা মুজুরী পেয়ে থাকেন। লবণ মাঠ থেকে আশা লবণ আনলোড করে প্রতি মন ২ টাকা ২০ পয়সা করে পায়। লবণ প্রক্রিয়া করে ট্রাকে লোড দেওয়ার সময় প্রতি বস্তায় ৬ টাকা করে পায়। তবে ভোজ্য লবণ শ্রমিকদের শিল্প লবণ কারখানা থেকে লবণ সংগ্রহ করার পর খাবার উপযোগী আয়োডিন যুক্ত পেকেট যাত করার পর তারা উৎপাদন প্রতি মন ১৫ টাকা দরে মুজুরী পায়। লোড দেওয়ার সময় ১ বস্তায় ৬ টাকা করে পায়।
কর্ম ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা ও কর্মপরিবেশঃ কর্মক্ষেত্রে কোন সুযোগ সুবিধা নাই বাথরুম আছে তা নি¤œ মানের, বিশ্রাম কক্ষ নাই অতিরিক্ত কাজ করলে কোন অতিরিক্ত টাকা পয়সা দেওয়া হয় না। সাপ্তাহিক ছুটি সহ কোন ছুটি পাই না। কাজ করলে টাকা না করলে টাকা নাই। এই নীতি এখানে বিদ্বমান। এখানে কোন মহিলা শ্রমকি নেই। অসুস্থ হলে মালিকরা কোন অর্থিক সহযোগিতা করে না এবং ঈদ বোনাস নাই।
পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাঃ কারখানার শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে চরর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তারা সারাক্ষণ লবণ মিশ্রিত পানিতে কাজ করে। শ্রমিকদের কোমরে ব্যাথা হাটু ব্যাথ্যা কিউনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা বলেছে। এই কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের সুরুক্ষার জন্য কোন পি পি ই নাই। সেই ব্যাপারে মালিক শ্রমিক কারো কোন ধারণা নেই।
ইসলামপুর লবণ কারখানা শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়ের জন্য ক্ষতিপয় বস্তাবনাঃ
১) নিয়োগপত্র পরিচয় পত্র দিতে হবে, এই ব্যাপারে মালিকদের সাথে লবি এ্যাডভোকেসি করতে হবে। স্থানীয় জন প্রতিনিধির কাছে এই কাজের সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করতে হবে।
২) অতিরিক্ত কাজ করলে উভার টাইম দিতে হবে। লবণ কারখানা শ্রমিকদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের আইনগত অধিকারে সচেতনা করার জন্য।
৩) আলাদা মুজুরী বোর্ড গঠণ করতে হবে।
৪) শ্রমিক দের জন্য পি পি ই সংগ্রহ করতে হবে।
৫) পেশাগত রোগের জন্য মালিক নিজ খরচে চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে।
উপসংহারঃ- লবণের স্বাভাবিক চাহিদা মিটানো এবং আপদ কালীন সময়ে সরবরাহ নিশ্চিত করেছে ইসলামপুর লবণ কারখানাগুলো বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটি শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এর আওতায় থাকলেও এই শিল্পের প্রতি সরকারের নজরদারী এবং সহযোগিতা অপ্রতুল। বিদেশ থেকে লবণ আমদানী বন্ধ না করলে দেশীয় লবণ শিল্প টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে। তাই সকল মহলকে লবণ শিল্পের ব্যাপাওে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখকঃ কোর টিম সদস্য, বিলস-এলআরএসসি, চট্টগ্রাম