মতামত

বাসদ কংগ্রেস:  নির্ভেজাল সত্য স্বীকারোক্তি

-অপু সারোয়ার

এক

 বাসদ – বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল। বাসদ নামে প্রায় আধা ডজন দল -গ্রুপ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রত্যাশায় পতাকা আঁকড়ে ধরে আছে। আধা ডজন বাসদ পরস্পর থেকে নিজেদেরকে পৃথক স্বত্ব জানান দিতে দলের নামের সাথে নেতার নাম অথবা মার্ক্সবাদী কিংবা সাম্যবাদী শব্দ ব্যবহার করে আসছে। যেমন বাসদ – খালেক , বাসদ – মার্ক্সবাদী। আবারো কোন গ্ৰুপ উপরি কাঠামোর খোল-নলচে উপরে ফেলে নিজেদেরকে নতুন নামে নামাঙ্কিত করেছে। সাম্যবাদী আন্দোলন এই ধারার পথ যাত্রী। এই আলোচনা বাসদ – খালেকুজ্জামান এর নেতৃত্বাধীন দলকে নিয়ে। বাসদের ১ম কংগ্রেস ৪ মার্চ ২০২২। চার দশকের মধ্যে প্রথম কংগ্রেস বাসদের । চার দশক ধরে দলের অনির্বাচিত নেতা খালেকুজ্জামান দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মধ্যদিয়ে বাসদের ঘোষণা আসে। দল ঘোষণার আগে -পরে জাসদ ছেড়ে আসা নেতা কর্মীদের সম্মেলন ডেকে কোন নেতা নির্বাচন করা হয় নাই । ঢাকায় অবস্থিত জাসদ ও জাসদের সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত হয়েছিল। । ১৯৮০-১৯৮১ সালে বাসদের কেন্দ্রীয় আহ্ববায়ক কমিটির সদস্য ছিল ১৩ জন। সারাদেশের নেতা কর্মীদের সম্মেলনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় আহ্ববায়ক কমিটি গঠিত না হওয়ায় এই কমিটি স্পষ্টত অনির্বাচিত ছিল।

বাসদ ( খালেক -হায়দার) ১৯৮৩-২০১০ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে লৌহ কঠিন যবানিকা ভেদ করে যে দুই চারটি সংবাদ বেড়িয়েছে তা দেখে গত চল্লিশ বছরের ভিতরের অবস্থা কিছু আঁচ করা যায় মাত্র। ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে বাসদ ( খালেক -হায়দার) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আব্দুল্লাহ সরকার এক ঝাঁক প্রশ্ন সামনে আনেন। এই অভিযোগের কারণে আবদুল্লাহ সরকারের পরিবার আক্রান্ত হয়েছিল। ( সূত্র:Daily Star – September 02, 2010 ) । বাসদ ( খালেক – হায়দার) কেন্দ্রীয় কমিটির আরেক  সদস্য শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী অভিযোগ করেছেন দলের মধ্যে তিনি সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়েছিলেন। ( সূত্র: ‘ বাসদ (মার্কসবাদী)র অভ্যন্তরে মতাদর্শিক সংগ্রামের দুটো দলিল’ -পৃষ্ঠা ২৪, বাংলাদেশের সাম্যবাদী অন্দোলন, কেন্দ্রীয় পাঠচক্র ফোরাম। প্রকাশকাল ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১)। বিপ্লবী দল দাবীদার দলের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার শিকার হওয়া একটি নিকৃষ্টতম অপরাধ। বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনে পুরোধাদের অনেকেই হিন্দু সম্প্রদায় থেকে এসেছিলেন। মনি সিংহ , সুখেন্দ্র দস্তিদার, দেবেন সিকদার , নির্মল সেন সর্বজনীন বামপন্থী নেতা। এই নেতাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের নির্মোহ ও কঠোর সমালোচনা রয়েছে। তবে এই নেতারা কখনই সাম্প্রদায়িকতার শিকার হন নাই। সুখেন্দ্র দস্তিদার ছাড়া বাকী নেতারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা লিখে গেছেন।

১৯৮০ সালে গঠিত বাসদ এর সকল অংশের রাজনীতির মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। ১৯৮০ সালে জাসদ থেকে প্রধানত দুই বক্তব্যকে সামনে নিয়ে বাসদ গঠিত হয়েছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে জাতীয় সরকারে অংশ নেওয়ার সম্ভবনা নিয়ে বিতর্ক ছিল অন্যতম প্রধান বিষয় । যদিও জেনারেল জিয়াউর রহমান জাসদকে ক্ষমতা ভাগাভাগি – জাতীয় সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয় নাই। এই সময় সামরিক শাসন বিরোধী ১০ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল। ১০ দলীয় জোটের প্রধান তিন দল ছিল আওয়ামীলীগ , জাসদ ও সিপিবি। সেই সময়ে বাসদ পন্থীরা শ্লোগান তুলেছিল ” ১৯৮০ সাল জাসদ হলেও বাকশাল ” । অপর বক্তব্য ছিল জাসদ অভ্যন্তরে বিপ্লবী দল গঠনের সম্ভবনা ও উদ্যোগের বিপর্যস্থ হয়ে পড়া। ১৯৭২- ১৯৭৫ সালে আওয়ামীলীগ শাসনামলে জাসদ নির্যাতিত হয়েছিল। যার কারণে “১৯৮০ সাল জাসদ হলেও বাকশাল” – শ্লোগান বাসদ গঠনে পালে হাওয়া চড়িয়ে ছিল। ১০ দলীয় জোটের বিরোধিতায় জাসদ ভেঙে যায় একই সাথে এই জোটের সমাপ্তি ঘটে।

১৯৮২ সালে মার্চে সামরিক শাসন বিরোধী ১৫ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল। ১৯৮০ সালের দশ দলীয় জোটের বিভিন্ন দল ভেঙে দলের সংখ্যা বেড়ে ১৫ তে দাঁড়িয়েছিল। এই জোটের প্রধান শরিক ছিল আওয়ামীলীগ, জাসদ ও সিপিবি। শুরু থেকেই বাসদ ১৫ দলীয় জোটের অংশ ছিল। ১৯৮৩ সালে বাসদের প্রথম বিভক্তির পর বাসদখালেকবাসদমাহবুব একই জোটের অংশ হিসেবে থেকে যায়। ১০ দল কে নাকচ করে দেওয়া বাসদ ১৫দলে শামিল হয়েছিল। এই স্ববিরোধিতার কোন উত্তর বাসদের কোন অংশই দিতে সক্ষম হয় নাই।  ২০১৩ সালে বাসদ – ( খালেকহায়দার ) বিতর্কে প্রায় একই জাতীয় ঘটনা হয়েছিল। মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর নেতৃত্বে বাসদ – মার্ক্সবাদী গঠিত হয়েছিল এই বিতর্কের মধ্য দিয়ে। এই সময়ে বাসদ- সিপিবি জোট ছিল। সাপ্তাহিক এর সাক্ষাৎকারের মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর বলেন ” সিপিবিকে একটা শোধনবাদী এবং আপোষকামী দল হিসেবেই চিনি। সংস্কৃতিতে পুরোপুরি আওয়ামীলীগের সঙ্গে জড়ানো। আওয়ামীলীগের বি -টিম বলা হয় তাদের। ………..আমার মতে তারা অনেক বেশী আওয়ামীলীগের রাজনীতি করে। বাসদ খালেকুজ্জামানের কথা তো আগেই বললাম। তার সঙ্গে আমাদের মৌলিক পার্থক্যতাই এখানে, যে তারা নানা সুবিধাবাদী তৎপরতা চালায়। সিপিবির সঙ্গে তারা যৌথভাবে কাজ করে। এটা আমি ঠিক মনে করি না। ” ( সাপ্তাহিক , ঈদুল ফিতর সংখ্যা। ৩০ মে ২০১৯ ) মুবিনুল হায়দারের এই বক্তব্য ১৯৮০ সালে ১০ দলীয় জোটের বিরোধিতার সমান্তরাল। ১০ দলীয় জোটের বিরোধিতার বছর তিনেক পরে বাসদ ১৫ দলীয় জোটে আওয়ামীলীগ , জাসদ ও সিপিবির সাথে যুক্ত হয়েছিল। মুবিনুল হায়দার সাক্ষাৎকার সময়কাল ছিল মে, ২০১৯ সাল। এই সময়ের বহু আগেই বাসদ – মার্ক্সবাদী বাম গণতান্ত্রিক জোট সিপিবি, বাসদ – খালেকুজ্জাম্মান এর সাথে জোটবদ্ধ অংশ। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় ,বামগণতান্ত্রিক জোট গঠিত হয়েছিল জুলাই ১৮, ২০১৮ । আটটি দল মিলে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ গঠিত হয়ে ছিল। ( সূত্র: – প্রথম আলো – জুলাই ১৯, ২০১৮।) বাম গণতান্ত্রিক জোটের দল গুলি হচ্ছে – সিপিবি, বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন । বাসদের বিভিন্ন গ্ৰুপের রাজনীতির পার্থক্য ১০ দলীয় জোট থেকে ১৫ দলীয় জোটের যোগ দেওয়ার মত নাজুক ও সুবিধাবাদ -প্রয়োজনবাদ ।

দুই

 বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল গুলিতে গণতন্ত্র হীনতা খোলা চোখে দেখা যায়। প্রধান বৈশিষ্ট্য  একবার যিনি নেতা তিনি আমৃত্যু নেতা বা দলের প্রধান। আওয়ামীলীগ বা বিএনপিতে এই ধারার সাথে যুক্ত হয়েছে পরিবার তন্ত্র। অন্য দল গুলিতে পরিবার তন্ত্র নেই তবে গণতন্ত্রের চর্চা তেমন নেই। প্রচলিত ব্যবস্থাকে সংস্কার করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চায় এমন সব দলেও গণতন্ত্র হীনতা নিত্য দিনের পাথেয়। যেমন ডক্টর কামাল হোসনের গণফোরাম । দলের শুরুতে ডক্টর কামাল হোসন প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন প্রায় ত্রিশ বছর আগে। এখনও সেই ধারাতেই চলছে। না ঘরকা , না ঘাটকা মার্কা দল গুলিতেও একই অবস্থা। এই ধারার দল গুলির মধ্যে আ স ম ররের জাসদ -জেএসডি এবং মাহমুদুর রহমানের নাগরিক ঐক্য অন্যতম।

প্রচলিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের স্লোগান তুলে যারা কাজ করছেন সেই বামপন্থী মহলের অবস্থা খুব বেশি ভাল নয়। এদের অধিকাংশ নেতা আমৃত্যু দলের প্রধান হিসেবে বসে আছেন। যেমন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন , বাসদের খালেকুজ্জামান , সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া। সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রায় তিন দশক দলের প্রধান দায়িত্বে আছেন। এর আগের প্রজন্মে ছিল আব্দুল হক , মোহাম্মদ তোয়াহার মত নেতা আমৃত্যু দলের প্রধান ছিলেন। । এই ঘরনার সব গুলি দলের একই অবস্থা। শত ভুলের পরেও নেতা সব সময়ের জন্যই নেতা।

বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের একমাত্র সাফল্য সব গুলি দল অনুগত – দলদাস কর্মী তৈরী করতে পারা। বামপন্থী দলের মধ্যে কিছুটা বই পুস্তক পড়ার প্রচলন আছে এমন দাবী করা হয়। তবে এই সব প্রচারণার পক্ষে তেমন কোন প্রমান নেই। এই সৰ দলে ” সচেতন ” কর্মীরা চোখ খোলা রেখে নেতাদের অন্ধ অনুসরণের পথে হাঁটতে অভ্যস্থ । কেন আজীবন নেতা এই প্রশ্ন করার অনুকূল পরিবেশ নেই বামপন্থী দল গুলিতে।। পরিবেশ থাকলে কেউ ২০/২৫ বছর বা তার বেশি সময় নেতা থাকতে পারতো না। এই সব দল গুলি ভাঙ্গন প্রবন। অতি সামান্য কিছুতেই দুই / দশ পাতার গুরুগম্ভীর বিশ্লেষণ লিখে নতুন দল বা গ্রুপ দাঁড় করানোর জন্য বামপন্থীদের জুড়ি নেই। সাধারণ ভাবে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব বিস্ফোরণ ঘটে দল ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে। যে কোন দলের ভাঙ্গন বিপুল সংখ্যক সৎ কর্মীদের নিরাশ ও নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। সিপিবি ছাড়া অন্য বামপন্থী দল গুলির ভাঙ্গনের হিসেবে ও ভাঙ্গনের কারণ জানা বোঝা প্রচলিত যে কোন পরীক্ষাই উত্তীর্ণ হওয়ার চেয়ে ঢের কঠিন ।

তিন

 বাসদ এর প্রথম কংগ্রেস পোস্টার ঘোষণা করছে শ্রেণি সংগ্রাম বেগবান কর, মেহনতি মানুষের রাষ্ট্র সরকার প্রতিষ্ঠা কর  অগ্রসর শ্লোগান। শ্রেণিগত দিক থেকে স্পষ্ট বক্তব্য। বাসদ কংগ্রেসের সর্মথনে ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ লিফলেট প্রকাশ করেছে। এই প্রচারপত্র -লিফলেটের বক্তব্যের ভরকেন্দ্র হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরের শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবী। প্রচারপত্র -লিফলেটে বলা হচ্ছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা আকাঙ্খাকে সামনে রেখে ১৯৮০ সালের নভেম্বর আমাদের দল, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলবাসদ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। ১৯৮০ সালে ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর বাসদের নাম ঘোষণা উপলক্ষে সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্য -” আমরা পুঁজিবাদ , ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে সংগ্রামের হাতিয়ার বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করে বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থাকে পাল্টে সকল প্রকার শোষণ ,নির্যাতন , অন্যায়অত্যাচার সাংস্কৃতি অবক্ষয় ঘুচিয়ে সবদিক থেকে প্রসারিত সুখী সমৃদ্ধি শালী শোষণ হীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে একটি বিপ্লবী সংগঠনের নাম ঘোষণা করছি। বাসদ – গঠনের সাংবাদিক সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কারণে বাসদ গঠিত হচ্ছে এমন কোন বক্তব্য ছিল না। বাসদের ভিত্তি পুস্তক হিসেবে বিবেচিত ” সর্বহারা শ্রেণীর দল গঠনের সমস্যা প্রসঙ্গে ” শিরোনামের বই , প্রকাশকাল মার্চ ১৯৮১ সাল। এই পুস্তিকাতেও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও আকাঙ্খাকে সামনে রেখে বাসদ প্রতিষ্ঠা কোন বিষয় আলোচিত হয় নাই। এই পুস্তিকাতে বলা হচ্ছে জাসদ অভ্যান্তরে একটি বিপ্লবী পার্টি গঠনের প্রক্রিয়া ব্যর্থ ও বিপর্যস্থ হওয়ার কারণে বাসদের উন্মেষ।

বাসদ ও অপরাপর বামপন্থী দল মনে করে সমাজ শ্রেণী বিভক্ত। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে চিন্তা ও চেতনা শ্রেণী বিভক্ত। মুক্তিযুদ্ধে নানা পেশা ও শ্রেণীর মানুষ অংশ নিয়েছিল। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের চেতনা ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী উঠতি ধনিক শ্রেনীর একটি অংশ গ্রহণ করেছিল। এই অংশের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী একজন ছাত্র বা শ্রমিকের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণ ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সামাজিক চেতনা ও আখাঙ্খা ভিন্ন ছিল । মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহুল উচ্চারিত ও আলোচিত শব্দ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ও অব্যবহিত পর এই শব্দের ব্যবহার পত্রপত্রিকা, রাজনৈতিক সাহিত্য বা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সরকারি দলিল – দস্তাবেজে চোখে পড়ে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আসলে কি বোঝায় বেশিরভাগ মানুষের কাছে তা অস্পষ্ট। শত ভাগ অমুক্তিযোদ্ধার দল বাসদ -খালেক কি বুঝতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে গত এক যুগের বেশি সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঢোল-মাদল  ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে আসছে  ।

চার

বাসদের কংগ্রেস সম্পর্কিত প্রচার পত্র – লিফলেটে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত নিপীড়ণের এর সমাধান হিসেবে ১৯৯৭ সালের শেখ হাসিনার পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের দাবী জানিয়ে লিখছে ভূমি সমস্যা সমাধান সহ ২৪ বছরের অনিম্পন্ন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।সাধারণ ভাবে লিফলেট সংক্ষিপ্ত , বিস্তারিত বক্তেব্যের সুযোগ নেই। মূল বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে লিফলেট উদ্দেশ্য়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল । পার্বত্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭২ সালের স্বাধীন বাংলদেশে সংবিধানে পার্বত্য জাতি সুমুহের অস্তিত্বকে নাকচ করার মধ্য দিয়ে।

আওয়ামীলীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তিকে বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করে। ১৯৯৭/১৯৯৮ সালে চুক্তির সময় বাসদ- খালেকের অবস্থান আজকের অবস্থানের পুরো বিপরীত ছিল। বাসদ পার্বত্য চুক্তি প্রসঙ্গে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে,  ফ্রেব্রুয়ারী ১৯৯৮ সালে। লেখক -খালেকুজ্জামান। এই পুস্তিকায় বাসদ পার্বত্য চুক্তি সম্পর্কে দলের মতামত তুলে ধরেছে। এই পুস্তিকায় পার্বত্য চুক্তিকে অসম্পর্ন দূর্বল – ( পৃষ্টা ৪) হিসাবে উল্ল্যেখ করে বলা হয়েছে ” বাংলদেশের বুর্জোয়া শ্রেণী পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর মারফৎ যে অঘোষিত যুদ্ধ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিদুদ্ধে চালিয়ে আসছিল এবং সমতন ভূমির ভূমিহীন নদী সিকস্তি গরীব জনগণকে জমি আর টাকার লোভ দেখিয়ে যেভাবে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ,তা থেকে আপাতঃ সরে আসা এবং সেই অর্থে শান্তি প্রতিষ্টার উদ্যোগ এই চুক্তির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বা কিংবা অনগ্রসর অংশের মানুষের সার্বিক অগ্রগতি বিকাশের পরিপ্রেক্ষিত থেকে কোন নীতি গৃহীত হয়নি। ” (পৃষ্ঠা )

সমসাময়িক সময়ে আওয়ামীলীগের বক্তব্য ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। শেখ হাসিনা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তির অন্বেষায়’ প্রবন্ধে ১৯৯৮ সালে লিখেছেন, পাহাড়ে বসবাসকারী কি পাহাড়ি কি বাঙালি সকলেই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। শান্তি স্থায়ী করতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে হবে।শিক্ষায় স্বাস্থ্যকর্মে উন্নত সমাজ গড়তে পারলেই স্থায়ী শান্তি স্থাপন হবে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে শান্তির পক্ষে। সকলেই শান্তি চায়। (শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র , পৃ ২৩৯)

দুই দশক পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নাই। পার্বত্য চট্টগ্রামে অঘোষিত সেনা শাসন চলেছে। তবুও বাসদ ১৯৯৮ সালের অপেক্ষাকৃত সঠিক অবস্থান ত্যাগ করে আওয়ামলীগের কাছাকাছি চলে এসেছে। বাসদের ভাষায় অসম্পর্ন ও দূর্বল চুক্তির বাস্তবায়নের কথা বলছেন।

পাঁচ

জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলে বাসদ সহ অন্য বামপন্থীরা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলন করেছিল। এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে নির্বাচন হয়েছিল। পরবর্তীতে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক এর ধারণাকে নাকচ করে দিয়েছে। আবার বিরোধী দলে থাকার সময় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের জন্য সোচ্চার হয়েছে। ১/১১ এর পর আওয়ামীলীগ সরকার আদালতের রায় এর অজুহাতে  নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের সকল সম্ভবনা বাতিল করে দেয়।

বাসদের কংগ্রেস লিফলেট সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবী জানানোর পাশাপাশি ” দল নিরেপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। নির্বাচন কালীন সরকারের সদস্যরা কেউ নির্বাচন করতে পারবে না ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রের কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হবেন না। ” – দাবি জানাচ্ছে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবী কোন নতুন বিষয় নয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের ব্যাপারে আলোচনা করতে আগ্রহী । ১২ এপ্রিল ২০১৫, বিবিসি বাংলা, সাথে আওয়ামীলীগ সরকারের উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেন ” সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। “ বাসদ কি আওয়ামীলীগের পরিত্যাক্ত বা সম্মতি আছে এমন কর্মীসূচীকে সামনে এনে নির্বাচন কমিশন সংস্কারের আশু দাবীকে কিছুটা হলেও হালকা করে দিচ্ছে?

নির্বাচন কমিশন সংস্কার নিয়ে বাসদ ও অন্য বামপন্থীদের সাথে ক্ষমতার বাইরের বুর্জোয়াদের দাবির পার্থক্য কম । বুর্জোয়া কর্মসূচিকে পরিশীলিত আকারে উপস্থাপন করে সঙ্গে কিছু ভাল জনপ্রিয় কর্মসুচি জুড়ে নজির হচ্ছে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবী। । বাম – সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত দল – গ্ৰুপ সমূহ অতীতের মতই একই বৃত্তে ঘূর্ণায়মান।

বাসদের কংগ্রেসের লিফলেট বাসদের ভবিষৎ পথের দিকচিহ্ন মাত্র। শ্রেণী সংগ্রামের শ্লোগানের নিচেই শাসক শ্রেণীর দলের সাথে কোলাকুলির নির্ভেজাল সত্য স্বীকারোক্তি। চিরায়ত সত্য, প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। এখানেও শ্রেণী সংগ্রামের নিচেই শ্রেণী সমন্বয়ের স্লোগান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মিছিলের জয়গানের সাথে পার্বত্য শান্তির সাফাই

অপু সারোয়ার: ফ্রীল্যান্স লেখক