বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৩০)

– বিজন সাহা

যখন ছেলেমেয়েরা ছোট ছিল মাঝেমধ্যে ওদের নিয়ে বনে বেড়াতে যেতাম। সাথে থাকত ওদের বন্ধুরা। বনে সামারে বিভিন্ন রকমের বেরি হয়। ঘুরতে ঘুরতে কখনও কখনও এসব তুলতাম, খেতে দিতাম বাচ্চাদের। ওরা নিজেরাও তুলত। আমরা সাধারনত এসব বাসায় আনতাম না, যা তুলতাম সবাই মিলে সেখানেই খেয়ে বাসায় ফিরতাম। কিন্তু যখনই বেরির পরিমান বেশি হত, মানে সব খাওয়া সম্ভব হত না – তখন প্রশ্ন আসত ভাগাভাগি করে তা বাসায় নেবার। একই ঘটনা ঘটত আমাদের ছোটবেলায়। আমের দিনে যখন আম কুড়াতে যেতাম – খুব বেশি আম না পেলে সবাই মিলে গাছ তলায় দাঁড়িয়েই খেতাম  কিন্তু পরিমান বেশি হলেই প্রশ্ন আসত সেসব ভাগ করার। ছোটবেলায় যত সহজে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খাওয়া সম্ভব বড় হলে সেটা তত সহজ নয়।

অনেক আগে, যখন মানব সভ্যতার সবে মাত্র শুরু, যখন দিন কাটত শিকার করা মাংস খেয়ে তখন হয়ত এমনটাই ছিল। কেউ নিজের জন্য সংগ্রহ করত না। যা পেত সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খেত। এভাবেই সেই আদিম সাম্যবাদ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল বিরূপ প্রকৃতির বিরুদ্ধে, তাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছিল শ্বাপদ সংকুল পৃথিবীতে। এরপর সে ফসল ফলাতে শেখে। এখন আর তাকে দিন এনে দিন খেতে হয় না, অনাগত দিনের জন্যেও কিছুটা জমা করতে পারে। এভাবে তার মধ্যে জাগে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বোধ। সে বুঝতে পারে তার নিরাপত্তা অনেকটাই নির্ভর করছে তার জমানো খাদ্যের উপর।  সে বুঝতে পারে জমানো শস্যের পরিমাণ শুধু নিরাপত্তাই নয়, সেটা এক ধরণের ক্ষমতাও। আর এভাবেই ধীরে ধীরে সমাজ ভাগ হয়ে যায় শোষক আর শোষিতে। সময় যত এগিয়েছে সেই বিভাজন তত বিশাল হয়েছে। সম্পদ বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে বৈষম্য।  আজ সেই বিভাজন আকাশচুম্বী। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত সম্পদ এখন গুটি কয় মানুষের সেবায় নিয়োজিত। তবে এটাও ঠিক বিশেষ করে উন্নত দেশের পুঁজিবাদীদের মনোভাবেও পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তারা এখন সমাজকে কিছুটা হলেও মানবিক করার জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেষ্ট। যদি আগে মুনাফা ছিল শেষ কথা, এখন তারা মুনাফার একটা অংশ মানব কল্যাণে ব্যয় করতে আগ্রহী। আর এই নতুন বাস্তবতায় নতুন করে ভাবার সময় এসেছে কী হবে পৃথিবীর রাজনৈতিক চরিত্র।

মার্ক্স যখন সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন তখন শ্রমিক শ্রেণি ছিল সত্যিকার অর্থেই সব ধরণের অধিকার বঞ্চিত। শেকল ছাড়া তার হারানোর কিছু ছিল না আর জয় করবার জন্য ছিল সমস্ত পৃথিবী। কিন্তু আজ যখন ঋণ করে হলেও একটা মোবাইল ফোন বা এরকম কিছু একটা কেনা যায়, তখন সেই অর্থে সর্বহারা কেউ নেই আর যদি কিছু নাও থাকে সবার আছে ঋণ। আমাদের মত দেশে পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন না হলেও উন্নত পুঁজিবাদী দেশে শ্রমিকের অধিকার অনেক বেশি সংরক্ষিত। সমাজতন্ত্রের বা সাম্যবাদের মূল লক্ষ্য তো মানুষকে তার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, সমস্ত মানুষের জন্য কমবেশি একটা গ্রহণযোগ্য জীবন যাপনের ব্যবস্থা করা। শোষণ মুক্ত সমাজ গড়া। আর যদি তাই হয় তাহলে এক শ্রেণির উপর অন্য শ্রেণির শোষণ বন্ধ করাই তো মূল লক্ষ্য।

অক্টোবর বিপ্লব শুধু রাশিয়াতেই নয় সমগ্র বিশ্বে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে। পরিবর্তন আনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক আর মানসিক ক্ষেত্রে। এই বিপ্লবের ফলে প্রান্তিক মানুষ বুঝতে পারে যে চাইলে সে নিজেও সমাজটাকে নিজের মত করে, নিজের প্রয়োজনে বদলাতে পারে। এই বিপ্লবের ফলেই রাশিয়ার প্রান্তিক মানুষ জীবনকে নতুন করে দেখার সুযোগ পায়, সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে বিশ্ব বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী। আবার একই সঙ্গে বুর্জোয়া বিধায় সে সময়ের অনেক প্রতিষ্ঠিত কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী দেশত্যাগে বাধ্য হন। শ্রেণি বৈষম্যে জেনেটিক্সের মত বিজ্ঞানের শাখা এদেশে প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে যায়। মার্ক্সবাদী তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পের বিভিন্ন শাখা বিকাশের পথ পায় না। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতন্ত্রের প্রতি মূল অভিযোগ ছিল ভিন্নমতের প্রতি  অসহিষ্ণুতা। অথচ ভিন্নমতকে অথবা ভিন্নমত পোষণকারী  মানুষকে সমাজ গঠনে, সমাজ বিকাশে যদি অন্যদের মত সুযোগ দেওয়া হত, তাদের সৃজনশীলতাকে মানুষের মঙ্গলের কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা হত তাতে আমার বিশ্বাস এদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ যেমন ঘটত, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টিও গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে দেশের এই পরিণতি ডেকে আনত না।

১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির মেনিফেস্টো প্রকাশের পর ১৭৩ বছর পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে সমাজ সার্বিক অর্থেই অনেক বদলে গেছে। এখন মানবিকতার চাহিদা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আর মানবিকতার কথাই যদি বলি পরমতসহিষ্ণুতা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। প্রকৃতির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যের মধ্যেই নিহিত প্রকৃতির সৌন্দর্য, তার স্থিতিশীলতা। আর এটাই যদি হয় প্রকৃতির অংশ হিসেবে আমাদের সে পথেই যেতে হবে। খুঁজতে হবে সেই ফর্মুলা যেখানে বিভিন্ন মত যেমন পাশাপাশি চলতে পারে তেমনি কেউ যেন কাউকে পদদলিত করে রাখতে না পারে। অর্থাৎ এমন একটা সমাজ গড়ে তুলতে হবে যেখানে সব মত সব পথ নিজেকে খুঁজে নিতে পারে। আর সেজন্যে দরকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে পেরেস্ত্রইকা আর গ্লাসনস্তের পাশাপাশি আর একটি বহুল প্রচলিত শব্দ ছিল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। পশ্চিমা বিশ্বের নেতাদের কাছে তেমন পাত্তা না পাওয়ায় সেখানে এটা কখনোই খুব বেশি প্রচার পায়নি। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে যখন আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য তখন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আইডিয়াটা খরচের খাতায় চলে যায়। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য প্রথম যে শর্ত সেটা হল পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, কম্প্রোমাইজ করার মানসিকতা। এটা মনে হয় পৃথিবী থেকে দিন দিন উঠে যাচ্ছে। মানবতার কথা বললেও, অন্যকে মানবিক হতে বললেও আমরা নিজেরাই আর মানুষ থাকতে পারছি না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন চারিদিকে শুধু হিন্দু আর মুসলমান – মানুষ কোথায়? এখন আমরা সবাই হয় নারী, না হয় পুরুষ, হয় হিন্দু না হয় মুসলমান বা বৌদ্ধ, খৃস্টান, আস্তিক বা নাস্তিক ইত্যাদি। মানুষের বৃহৎ পরিচয় ত্যাগ করে আজ আমরা সবাই কোন না কোন দল, গোষ্ঠী, ধর্ম বা অন্য কোন পরিচয়ে পরিচিত – যেখানে অন্য কোন চিন্তার স্থান নেই। মৌলবাদকে ঘৃণা করলেও কাজে-কর্মে, চিন্তা-চেতনায়, চলনে-বলনে আমরা সবাই মৌলবাদী। “বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য” এ কথাটি আমরা মন্ত্রের মত জপলেও যখন নিজেদের সেই বৈচিত্র্য মানার প্রশ্ন আসে – দেখা যায় সেটা মানতে আমরা  প্রস্তুত নই। যারা কথায় কথায় “অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় জীবন দিতে প্রস্তুত” বলে দেয়াল ভরে ফেলে তারাই দেখা যায় যেকোনো রকম ভিন্ন মত শুনতে সবচেয়ে বেশি অনাগ্রহী। আর অন্যকে শোনার, অন্যের মতও যে তার নিজের মতের মতই টিকে থাকার অধিকার রাখে সেটাকে মেনে নেওয়ার অনিচ্ছা হল মৌলবাদের প্রকারভেদ। সবাই যেখানে মৌলবাদী সেখানে পরমতসহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এসবই পুঁথির কথা, অবাস্তব বাস্তবতা।

ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে ভাগবত পাঠ হত। পাঠ করতেন ফরিদপুর জগদ্বন্ধু সুন্দর আঙ্গিনার মহানামব্রত ব্রহ্মচারী। সেখানে তিনি গীতা পাঠ করে তার ব্যাখ্যা দিতেন। তখন ছোট ছিলাম, এসব কিছুই বুঝতাম না, তবে যেমন শান্ত ভাবে তিনি বলতেন আর ভক্তরা শুনতেন তাতে মনে হয় তার পাঠে বা ব্যাখ্যায় উত্তেজনাকর কিছু ছিল না। একই ভাবে কবিগান, জারিগান ইত্যাদি ক্ষেত্রেও দেখেছি ঈশ্বরের মাহাত্ম্যের ব্যাখ্যা দিতে। তার সঙ্গে আজকের ওয়াজ মাহফিল, অন্তত যে সব মাঝেমধ্যে ইউটিউব হয়ে ফেসবুকে আমার টাইম লাইনে আসে তার কোনই তুলনা চলে না। সেটা শান্তির বাণী প্রচার নয়, যাকে বলে যুদ্ধের আহ্বান। অনেক সময় ভাবি দেশ থেকে কেন বাউল, কবি গান, জারি গান, যাত্রা পালা – এসব উঠে যাচ্ছে? কারণ একটাই। এসব জায়গায় বিভিন্ন মতের চরিত্র আছে, আছে প্রশ্ন। সেখানে তর্ক করা হয়, সেখানে দ্বিমত পোষণ করা হয়। আর তাইতো শুধু ধর্ম ব্যবসায়ীরাই নয়, প্রশাসন এসব ভয় পায়। একাত্তরের চেতনার সরকার আর একাত্তর বিরোধী শক্তি এখানেই মিল খুঁজে পায় – এরা সবাই প্রশ্ন যারা করে তাদের বড্ড ভয় পায়। এদের শক্তি যুক্তিতে নয়, অন্ধ ভক্তিতে।

দিন দিন আমরা শিক্ষিত হচ্ছি আর সমস্যা বাড়ছে। কেন? আমরা শুধু শিক্ষিত হচ্ছি না, আমরা বেশি করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হচ্ছি। বাড়ছে আমিত্ব। আর যখনই আমি আমাদের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, আমাদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন অশান্তি আসতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে পরিবার বলি, সমাজ বলি, দেশ বলি – এসবই একটা কম্প্রোমাইজ, সমষ্টির স্বার্থে নিজের কিছু কিছু স্বার্থ ত্যাগ করা। আমরা যখন দরিদ্র ছিলাম, তখন পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা ছিল বেশি। এক সময় ছিল যখন আমাদের অনেক কিছুর জন্যই প্রকৃতির মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করতে হত। বন্যা, খরা, ঝড় বৃষ্টি যেকোনো দুর্যোগই মানুষকে অসহায় করে তুলত। এখন বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ অনেক বেশি স্বাবলম্বী। তেমনি ভাবে স্বাবলম্বী ব্যক্তি মানুষ। যার ফলে কমছে পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা। ভোগবাদী সমাজে ধর্ম, আদর্শ, মানবতা এসব নয়, অর্থ হয়েছে একমাত্র উপাস্য দেবতা। এমনকি অনেকে ধর্মের নামে দিনের শেষে সেই অর্থই উপার্জন করছে। শুধু তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে বিভিন্ন ভাবে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়া।

এখন যুগটাই স্লোগানের। যেকোনো অ্যাডভারটাইজমেন্টের কথাই বলেন, সেগুলো কি রাজনৈতিক স্লোগান থেকে ব্যতিক্রমী? নিঃসন্দেহে সেসব অনেক বেশি ক্রিয়েটিভ, তারপরও এসব স্লোগানই। আজকাল সবাই পারলে কথা ছাড়াই সব কাজ করতে চায়। ছোট ছোট এসএমএস বা স্মাইলিক – এটাই নিজেদের প্রকাশ করার ভাষা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু জ্ঞান কোন শর্টকাট পথ পছন্দ করে না, জ্ঞানার্জনের জন্য দরকার সাধনা, দরকার অধ্যাবসায় আর নিরলস চেষ্টা। কিন্তু আজকাল আমরা সহজে সবকিছু পেতে চাই। কর্ম নয়, ফলই আমাদের কাছে মুখ্য। জ্ঞান আমাদের সব ভাগাভাগির ঊর্ধ্বে উঠতে বলে, কিন্তু আমরা, বিশেষ করে শিক্ষিত মানুষ হাজার ভাবে বিভক্ত। আগেই বলেছি যে আমরা এখন মানুষ নই, আমরা পুরুষ বা নারী, গণতন্ত্রী বা একনায়ক, আস্তিক বা নাস্তিক। ভাগাভাগির কোন শেষ নেই। কিন্তু পৃথিবী আমাদের একটাই, জীবনও একটাই। তাই সবাইকে, সব মতকে মেনে নিয়েই এই পৃথিবীকে সবার বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। যারা ভাবেন খারাপদের ধ্বংস করে শুধু ভালদের নিয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলবেন, এত রক্ত, এত ধ্বংসের পরে তারা কি আর ভাল থাকতে পারবেন? কিংবা সেটা কি আদৌ সম্ভব? কারণ এমন প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে যে যদি সব ধর্মই শান্তির কথা বলে তারা কেন শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করতে পারে না। আসলে ধর্মের সমস্যা তার শোভিনিজমে। যখন একদল তার আরাধ্য দেবতাকেই, তা সে যে নামেই হোক না কেন, সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তখন তার পক্ষে সেই ইষ্ট দেবতার ব্যাপারে কারো সাথে সমঝোতায় আসা সম্ভব হয় না। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য প্রয়োজন সমঝোতা। ধর্ম যেখানে শুরুতেই সেক্ষেত্রে অনমনীয় মনোভাব পোষণ করে সেখানে ইচ্ছে থাকার পরেও সমস্যা দেখা দেবে। অন্য মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা ধর্মের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের একটা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি আদর্শও শোভিনিস্টিক রূপ নিতে শুরু করেছে। এই মনোভাব পরিহার করতে না পারলে মানে আমিই শ্রেষ্ঠ এই অহংবোধ ত্যাগ করতে না পারলে যত ওম শান্তিই করি না কেন কারো উপরে কখনোই সত্যিকারের শান্তির বৃষ্টি বর্ষিত হবে না।

বিগত শতকের আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম ও শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গরবাচভ প্রায়ই শান্তি পূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলতেন। তার ফলাফল আমরা সবাই জানি। তারপরেও আমার বিশ্বাস সবার জন্য বাসযোগ্য একটা পৃথিবীর জন্য শান্তি পূর্ণ সহাবস্থানের বিকল্প নেই। তবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য নিজেদেরও শক্তিশালী হতে হবে, তা না হলে এই সহাবস্থান হবে আসলে সবলের সাথে দুর্বলের সহবাস। দেশে দেশে বলপূর্বক সমাজতন্ত্র বা গণতন্ত্র প্রসারের প্রচেষ্টা শুধু ব্যর্থই হয়নি, প্রচুর প্রাণহানির কারণ হয়েছে। আর যদি বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের সাথে খাপ খাইয়ে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রকে পুনর্বিন্যাস করা হয় সেটা শেষ পর্যন্ত কতটা তার আসল রূপ ধরে রাখবে সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। কিন্তু মানবিক পৃথিবী গঠনে সেটাই হতে পারে কয়েকটি পথের একটা। আর সেজন্যে দরকার এসব পরিবর্তনকে হজম করতে পারে এমন মানুষ গড়ে তোলা, দরকার উপযুক্ত শিক্ষা যা আমাদের পরমতসহিষ্ণু হতে শেখায়, অন্যের মত, অন্যের পথকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। কাজটা কঠিন। পথ বন্ধুর। তবে সেটা শুরু করতে হবে। বন্ধুর পথে বন্ধুর হাতে হাত রেখে আমাদের চলতে হবে। শুরু করতে হবে আমাদের যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে ভাবি, যারা একটা মানবিক বিশ্বের স্বপ্ন দেখি। আর এভাবেই যারা শোষণ মুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেন তারা যদি নিজেদের গোঁড়ামি ত্যাগ করে শ্রেণি দ্বন্দ্ব নয় বিভিন্ন শ্রেণির সম্প্রীতির পথ দেখাতে পারে এমন রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশল গ্রহণ করতে না পারে তাহলে পরিবর্তন হয়তো আসবে কিন্তু শান্তি আসবে না।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো