বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (২৯)

-বিজন সাহা

গত সপ্তাহে আমরা বলেছিলাম বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিপ্লব সমাজ পরিবর্তনের একমাত্র পথ নয়। বিপ্লবের চেয়েও বিবর্তন অনেক বেশি এফেক্টিভ। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও চীনের অর্থনীতিতে ব্যক্তি মালিকানার সক্রিয় উপস্থিতি আমাদের এটা ভাবতেই বাধ্য করে যে পুঁজিবাদের অর্থনীতির বিভিন্ন উপাদান গ্রহণ না করে শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলা অসম্ভব। আর সেটা যদি গ্রহণ করতেই হয় তাহলে সোভিয়েত স্টাইলে বিপ্লব না করে, অতীতের সমস্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন ছিন্ন না করে, এমন ভাবে সামাজিক পরিবর্তন করা দরকার যাতে করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য যেমন কমে তেমনি কোন শ্রেণির উপর কোন শ্রেণির একনায়কত্বও না থাকে। আর সেটা সম্ভব পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে। আর বোঝাপড়া হয় শুধু সমানে সমানে। সেটা হতে পারে যখন একদিকে পুঁজিপতিরা শক্তিশালী হয় অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণি ও তাদের স্বার্থ রক্ষাকারী রাজনৈতিক দলও সমান শক্তিশালী হয়।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব প্রায় অসম্ভব। সেই শক্তি বামপন্থীদের নেই, তাছাড়া মানুষ দিন দিন যেভাবে ধর্ম ব্যবসায়ীদের দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে সেটা সম্ভব কিনা তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। আবার কোনভাবে পুঁজিবাদের প্রতিনিধিত্বকারী দুই দলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলেও ইরানের মতই ক্ষমতা যে হাত ফস্কে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে চলে যাবে না সেই গ্যারান্টিই বা কোথায়? তাই এক্ষেত্রে একটাই পথ, দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়ানো। কি সেই পথ? নির্বাচন। আর নির্বাচনে ভাল ফলাফলের জন্য দরকার নিজেদের নির্বাচনী দল হিসেবে গড়ে তোলা। আর সে জন্যে দরকার যে সমস্ত দলের নির্বাচনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে তাদের সাথে নির্বাচনী আঁতাত গড়ে তোলা। এতে লজ্জার কিছু নেই। স্মরণ করা যেতে পারে যে এমনকি শেখ হাসিনাও এক সময় গোলাম আযমের সাথে নির্বাচনী আঁতাত গড়েছিলেন বিএনপির বিরুদ্ধে। হ্যাঁ, আমরা সেই আঁতাতের সমালোচনা করি, তবে এটাও তো ঠিক যে এই আঁতাত আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিল, আওয়ামী লীগের পরবর্তী অনেক সাফল্যের নীল নকশা সেদিনই তৈরি হয়েছিল। রাজনীতি তো বটেই জীবনটাই বিভিন্ন রকমের কম্প্রোমাইজ দিয়ে গঠিত। সময় মত সঠিক শর্তে কম্প্রোমাইজ করতে না পারলে অসময়ে লজ্জাজনক শর্তে সেটা করতে হয়। যাহোক, বিশ্ব পরিস্থিতি, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ এবং বাম দলগুলোর, বিশেষ করে সিপিবির অবস্থা দেখে আমার মনে হয় দেশের রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য তাকে নির্বাচনের পথেই যেতে হবে। সিপিবি নিজেও শক্তিশালী বাম মোর্চা গড়ে তোলার ডাক প্রায়ই দেয়। তাই তারাও যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিকল্প হিসেবে নিজেদের দেখতে চায় সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আর সেটা করতে হলে দলের জনশক্তি বাড়াতে হবে, একে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। এ সবই এখন সুদূর অতীত।

১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত আমি দেশে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। অনেকটা আকস্মিক ভাবেই বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। পরে খেলাঘর আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ি। ওই সময়ই প্রথমে পার্টির গ্রুপ মেম্বার ও পরে ক্যান্ডিডেট মেম্বার হই। লতিফ সিদ্দিকী, আবুবকর সিদ্দিকী তুলু, আমি – আমরা একই গ্রুপে ছিলাম। এরপর ওরা পার্টি মেম্বার হয়, রাশিয়া আসা কমবেশি ঠিক হয়ে গিয়েছিল বলে আমার মেম্বারশিপ স্থগিত রাখা হয়। কিন্তু ওই সময় যেটা দেখেছি তা হল আমরা অনেকেই ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী, খেলাঘর ইত্যাদি আন্দোলনে এক সাথে কাজ করলেও, এক সাথে ক্ষেতমজুর সমিতি, কৃষক সমিতি ইত্যাদির সভা সমিতিতে অংশ নিলেও অনেক ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা ছিল না। মানিকগঞ্জে আমাদের একটাই অফিস ছিল যেখানে সব সংগঠনের মিটিং হত, যেখানে সবাই মিলত নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে বা স্রেফ আড্ডা দিতে। কিন্তু যখনই গ্রুপ মিটিং হত তখন এ নিয়ে একটা লুকোচুরির ব্যাপার ছিল। আমরা সবাই সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাস করেই রাজনীতি শুরু করি, পার্টির কাজে যোগ দিই। অথচ এ নিয়ে এত রাখঢাক ছিল বিব্রতকর। একই ঘটনা ঘটেছে মস্কোয়। এখানে ছাত্রদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ ছিল। একটা বড় অংশ ছিল একমনা – এরা সিপিবির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। আর ছিল ন্যাপের স্টাডি সার্কেল এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদ। ওরা ওপেনলি কাজ করলেও একমনা নিজেদের অস্তিত্ব স্বীকার করত না। আমাদের মিটিং হত গোপনে যদিও ছাত্র সংগঠনে (বিশেষ করে মস্কোয়) আমরা ছিলাম অপ্রতিদ্বন্দ্বী। পার্টির গ্রুপও ছিল। সেখানে গোপনীয়তা ছিল আর এক কাঁঠি ওপরে। এমনকি আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও অনেক সময় জানতাম না কে পার্টিতে আর কে নয়। পার্টি যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে তখন এই ট্যাক্টিস অর্থবহ, কিন্তু পার্টি যখন খোলামেলা কাজ করছে তখন এটা কতটুকু ফলপ্রসূ সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। এটা ঠিক বিভিন্ন কারণেই পার্টির মেম্বারশিপ দেবার ক্ষেত্রে সেটা পর্যবেক্ষণ করেই দেওয়া দরকার, কিন্তু এ জন্যে তাকে যখন নিজেদের কমরেডদের সাথে লুকোচুরি খেলতে হয় সেটা বিভিন্ন রকমের ভুল বোঝাবুঝির জন্ম দেয়। আর যেখানেই অকারণে অতিরিক্ত গোপনীয়তা সেখানেই স্বচ্ছতার অভাব। এভাবেই তৈরি হয় পার্টি আমলাতন্ত্র। আমি যেটা বলতে চাই তা হল পার্টিকে গণ চরিত্র দিতে হলে এসব আন্ডারগ্রাউন্ড স্টাইল কৌশল ত্যাগ করতে হবে। আর যদি বিপ্লবের প্রশ্ন এই মুহূর্তে না থাকে তবে পার্টির মেম্বারশিপ দেবার ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিল হওয়া যেতেই পারে।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমার অনেকটা উত্তাল নদীর মত মনে হয় যেখানে জনগণ হাবুডুবু খাচ্ছে। নদীর দুই তীর দখল করে আছে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি যারা জনগণকে তীরে উঠতে ক্রমাগত বাধা দিচ্ছে। এমতাবস্থায় জনগণের দরকার লাইফ বোট যেটা হতে পারত বাম গণতান্ত্রিক জোট। কিন্তু বামদের দুর্বলতা জনগণের মনে আশার সঞ্চার করছে না। কেন এই দুর্বলতা যেখানে পরিবেশ তাদের পক্ষে? মনে হয় দেশের রাজনীতি বা মানুষের নাড়ি বুঝতে পারার ব্যর্থতা। এখানে মনে হয় আরও একটা জিনিস কাজ করে – তা হচ্ছে আত্মশ্লাঘা যেটা তারা আত্মবিশ্বাসের সাথে গুলিয়ে ফেলে। মনে আছে ছাত্রজীবনে চারিদিকে সবাইকে মনে হত প্রগতিশীল। বছর দুয়েক আগে অ্যামেরিকায় বসবাসকারী এক বন্ধু লিখেছিল আমি, আমার পরিবার, আমাদের বন্ধুরা, ছেলেমেয়েদের বন্ধুরা, তাদের পরিবার – সবাই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থক, তাহলে ট্রাম্প এত ভোট পায় কোত্থেকে? আসলে আমরা নিজেরাই আমাদের পৃথিবীটা এত ছোট করে রেখেছি যে এর বাইরেও যে একটা বিরাট পৃথিবী আছে, আমাদের ভাবনার বাইরেও যে অন্য ভাবনা আছে সেটা অনুধাবন করতে পারি না। আর তাই যখন বাস্তবতার মুখোমুখি হই সেটাকে নিজেদের দুর্বলতার পরিবর্তে প্রতিপক্ষের দুর্নীতি ভেবে আত্মশ্লাঘা বোধ করি। বিগত নির্বাচনগুলোয় সিপিবি তথা বাম দলগুলোর ফলাফল দেখে একটাই সিদ্ধান্তে পৌঁছুন যায় যে তাদের নিজেদের নির্বাচনী রণনীতি সম্পূর্ণ বদলাতে হবে। এখানে শুধু কারচুপিকে দোষ দিয়ে বসে থাকলে কোন দিনই এরা পার্লামেন্টে ঢোকার ম্যান্ডেট পাবে না।

২০১৮ সালের ০১ নভেম্বর ২০১৯ সালের নির্বাচন নিয়ে লিখেছিলাম। মনে হয় এখনও তা প্রাসঙ্গিক। তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সিপিবির নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোটের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন “আসুন আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হই, মিনিমাম পয়েন্টে ম্যাক্সিমাম ইউনিটি গড়ে তুলি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন “আমরাও জাতীয় ঐক্য চাই। আমরা জাতীয় ঐক্য চাই সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে, নষ্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এ দেশের জন্মের যে চেতনা, এই চেতনা নিয়ে আমরা জাতীয় ঐক্য চাই।” সিপিবি নেতা রুহিন হুসাইন প্রিন্স এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে  বলেন, “উনি যে সব বিষয় উল্লেখ করেছেন, তার সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি সাংঘর্ষিক অবস্থায় রয়েছে।” তার কথায় আওয়ামী লীগ নিজেই এখন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে লালন করছে। রাজাকারের বিচার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা নিষিদ্ধ হয়নি। তার মতে নষ্ট রাজনীতির অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ। এই সরকারের আমলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস আগের যেকোন সরকারের চেয়ে অনেক বেশি ছড়িয়ে গেছে।

ওবায়দুল কাদের যে সমস্ত সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলেন সে ব্যাপারে একমত না হয়ে উপায় নেই। এ সমস্যাগুলো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে প্রধান বাধা। এ সমস্যার সমাধান বাংলাদেশের মূলনীতিতে বিশ্বাসী প্রতিটি নাগরিকই চায়, বিশেষ করে বামপন্থী দলগুলো। এখানে বলে রাখা ভালো বাংলাদেশ অন্যান্য দশটা দেশের মত নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা লাভ করেছে। সেসব লড়াই ছিল মুলত বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের লড়াই ছিল আদর্শিক। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও অচিরেই মানুষ বুঝতে পারে এর ফলে শুধু মালিকই বদল হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা আসেনি। ১৯৪৮ সালের  ভাষার দাবি একের পর এক ইতিহাস রচনা করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। ২৪ বছরের এই নিরন্তর সংগ্রামে এ দেশের মানুষ শুধু দ্বিজাতি তত্ত্বকেই ত্যাগ করে না, ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে সামরিক শাসন, স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে বাহাত্তরের সংবিধানে। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এসব শুধু কথার কথা নয়, বাংলাদেশের জন্য এগুলো জন্মদাগের মত। এর যে কোনটাকেই বাদ দিলে আমরা যে বাংলাদেশ পাই, সেটা একাত্তরের চেতনার পরিপন্থী। এমন কি বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় সমাজতন্ত্র তার আগের আবেদন হারালেও আমাদের দেশের বিশেষ করে জনগনের সার্বিক উন্নয়নে সমাজতান্ত্রিক বণ্টন ব্যবস্থার অনেক কিছুই গ্রহণ করা যেতে পারে। সেদিক থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সেই সময়ের উপলব্ধি পজিটিভ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে সিপিবির বক্তব্য ফেলনা নয়। সিপিবি বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সাথে একই প্ল্যাটফর্মে কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগের সেই আগের চরিত্র আর নেই। দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার ফলে সুবিধাবাদীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে আজকের আওয়ামী লীগ। ফলে অনেক পরীক্ষিত বন্ধুরা আজ দূরে যেতে বাধ্য হয়েছে বা হচ্ছে। পঁচাত্তরে তাজউদ্দীন আহমেদ এ ভাবেই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরে গেছিলেন মোশতাকের মুজিব ভক্তির ঢেউয়ে ভেসে। আর সেটা না মুজিব, না তাজউদ্দীন, না আওয়ামী লীগ, না সিপিবি, না একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ – কারো জন্যই কোন সুফল বয়ে আনেনি। আজকের প্রজন্ম যদি একই ভুল করে তাহলে বলার কিছুই থাকবে না। মনে রাখতে হবে এই সময়ে শুধু আওয়ামী লীগই বদলায়নি, বদলিয়েছে সিপিবি। যখন আওয়ামী লীগ ও সিপিবি উভয়েই বিরোধী দল ছিল তখন তাদের অনেক লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। আজ যখন তারা ক্ষমতার ব্যারিকেডের দুই দিকে অবস্থান করছে তখন ঐক্যের চেয়ে অনৈক্য বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া তাদের পারস্পরিক অবস্থানও এখন ভিন্ন। সেটা মেনে নিয়েই ঐক্যের কথা ভাবতে হবে যদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের ভিত শক্তিশালী করতে চায় সিপিবি। এতে খারাপ কিছু নেই। রাজনীতিতে এসব অনৈতিক নয়, এসব কৌশলের অংশ মাত্র। তাছাড়া আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থার জন্য বিভিন্ন প্রশ্নে সিপিবির অনমনীয় মনোভাবও কমবেশি দায়ী। সিপিবি যখন আওয়ামী লীগের সাথে একই প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে অস্বীকার করেছে সেই জায়গা দখল করেছে স্বাধীনতা বিরোধীরা।

পাকিস্তান আমলে সিপিবির আন্দোলনের কথা এই ভূখণ্ডের ইতিহাসে সুবর্ণ অক্ষরে লেখা থাকবে। স্বাধীনতার পরে বাকশালে মিশে যায় এই দল। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে অনেক দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি সেভাবে। কিন্তু আশির দশকে, বিশেষ করে এরশাদের আমলে সিপিবির পালে নতুন হাওয়া লাগে। কৃষক সমিতি, ক্ষেতমজুর সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন থেকে শুরু করে অন্যান্য গণসংগঠনগুলো নতুন প্রাণ ফিরে পায়। কমরেড ফরহাদের নেতৃত্বে সিপিবি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিশেষ স্থান দখল করে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মত জন সমর্থন না থাকলেও সিপিবি বিশেষ করে ফরহাদ ভাই হয়ে ওঠেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ফরহাদ ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা পার্টিতে মেহনতি মানুষের ভ্যানগার্ডে পরিণত করে। ঐ সময়ে পার্টির দ্রুত বৃদ্ধির একটা অন্যতম প্রধান কারণ মনে হয় সিপিবির পার্লামেন্ট নির্বাচনে কতগুলো আসনে জয়ী হওয়া। রাস্তায় আন্দোলনের সাথে সাথে পার্লামেন্টের ভেতরে তাদের ভূমিকা গণমানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জানি না পার্লামেন্টের ভেতরের রাজনীতি নিয়ে সিপিবির নেতৃবৃন্দের মূল্যায়ন কী, তবে আমার বিশ্বাস ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে কতগুলো আসনে বিজয়ের সুবাদে সিপিবি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে পেরেছিল। আর এই বিশ্বাস থেকেই আমার মনে হয় সিপিবির উচিৎ নির্বাচনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নতুন পথে চলা এবং যেভাবেই হোক অন্তত কিছু আসনে বিজয় নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে সক্রিয় দল হওয়ার পরেও নির্বাচনের দৌড়ে সিপিবি অনেক পিছিয়ে। এমন কি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ নির্বাচন হলেও শুধুমাত্র নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে কোন আসনে জয়ী হওয়া তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এ জন্যে দরকার রাজনৈতিক জোট। কিন্তু বাম দলগুলোর সাথে গাঁটছড়া বেঁধে সে কাজ যে হবে না সেটা বলাই বাহুল্য। দরকার নির্বাচন ও ভোটের রাজনীতিতে চ্যাম্পিয়ন কোন দলের সাথে সমঝোতায় আসা। কিন্তু এখানে অপশন শূন্যের কাছাকাছি। বিএনপির সাথে গাঁটছড়া বাঁধার প্রশ্নই আসে না, সেটা করলে পার্টির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বিপুল। বাকি রইল শুধু আওয়ামী লীগ। কিন্তু আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হল কোন পদক্ষেপ রাজনৈতিক ভাবে কতটুকু যুক্তিযুক্ত সেটার ওপরে ব্যক্তিগত মান অভিমানকে স্থান দেওয়া। নেহেরু-জিন্নাহ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এ মনোভাব শুধু বাংলাদেশ কেন, উপমহাদেশের রাজনীতিকে বার বার ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। বিগত দিনগুলোতে একমাত্র সিপিবি ও তার নেতৃত্বাধীন বাম দলীয় জোটই রাজনৈতিক ভাবে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছে। ফলে আওয়ামী লীগ ও সিপিবির সম্পর্ক অনেকটা সাপে নেউলের মত দাঁড়িয়েছে। এমনকি সিপিবির অনেক নেতা, যারা বীর বিক্রমে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ হারানো, জনসভায় সিপিবির সভাপতির উপর আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের আক্রমণ করার মত ঘটনা ঘটেছে। এটাও সিপিবির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের আহ্বানে সাড়া দেবার পথে কণ্টকের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে রাজনীতি শুধু আবেগ নয়, পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নিকাশ। তাই সিপিবির নতুন করে ভাবতে হবে কখন কী শর্তে, কার সাথে তারা রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলবে। কারণ প্রশ্নটা এখন রাজনৈতিক ভাবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। এমনকি বিএনপির মত দল কয়েকবার নির্বাচনের বাইরে থেকে নিজেদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। অতীত অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে সংসদীয় দল হিসেবে সিপিবি শুধু নিজেকেই শক্তশালী করতে পারবে তা নয়, এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে শক্তিশালী তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার এক অনন্য প্ল্যাটফর্ম পাবে।

এর মধ্যে অবশ্য দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেকটাই বদলে গেছে। আওয়ামী লীগ আরও বেশি দক্ষিণপন্থী। কিন্তু বিপদের সময় কারও সাথে হাঁটা অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। অনেক সময় মনে হয় আওয়ামী লীগের একাংশ দলের বর্তমান অবস্থায় অসন্তুষ্ট। তারাও পরিবর্তন চায়। তবে দলে তাদের অবস্থান দুর্বল বলে সেটা পারছে না। এই অংশ মূলত বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের অবশিষ্টাংশ। সিপিবি আওয়ামী বিরোধিতা করে এদের কাছে টানতে পারবে না কিন্তু কোন কোন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্য হলে সেটা সিপিবিকে যেমন ভোটের ক্ষেত্রে সাহায্য করবে তেমনি আওয়ামী লীগের সেই অংশ যারা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, সেখানে ফিরে যেতে চায় তাদেরও সাহায্য করবে আওয়ামী লীগের শুদ্ধি অভিযানে। আর সেটা হলে সবাই লাভবান হবে। একাত্তরে আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র চায়নি। সিপিবি চীনপন্থী বাম দলগুলোর মত পারত যুদ্ধে অংশ না নিতে। তারা তো সে পথে যায়নি আর যায়নি বলেই বাহাত্তরের সংবিধানের মত একটা সংবিধান আমরা পেয়েছিলাম। তাহলে আজ কেন এই বাচবিচার। সিপিবি এখন আর আগের মত মনোলিট পার্টি নেই, আওয়ামী লীগ তো নয়ই। তাই তাদের সাথে সমঝোতা করে সিপিবি দেশের রাজনীতিতে আবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। যেহেতু কংগ্রেস সামনে সিপিবি আবেগ দিয়ে নয়, রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে এ নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্তে আসবে এটাই আমরা কামনা করি।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো