ঢাকার রাস্তায় এক নারী।
ঢাকায় বায়ুদূষণ উদ্বেগজনক মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, সীমান্তের বাইরে থেকে ক্ষতিকর বিভিন্ন বস্তুকণা বাতাসে ভেসে বাংলাদেশে উড়ে আসার কারণে ঢাকার বায়ু আরো বেশি দূষিত হয়ে পড়ছে।

গবেষকরা বলছেন, রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্যে প্রায় ৩০ ভাগ দায়ী ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশি দেশ থেকে আসা এসব অতি সূক্ষ্ম পদার্থ।

এসব পদার্থের মধ্যে রয়েছে অ্যামোনিয়া, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, সীসা, কার্বন, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড, ওজন গ্যাস ইত্যাদি।

ঢাকায় পরিবেশক বিষয়ক একটি গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা এসডোর চালানো গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত তিন বছর ধরে এসব গবেষণা চালানো হয়।

সংস্থাটির মহাসচিব এবং পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, সীমান্তের বাইরে থেকে আসা এসব অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা ঢাকার পরিবেশ দূষণের জন্য ৩০ ভাগ দায়ী হলেও এগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর।

দিল্লিতে বায়ুদূষণ
দিল্লিতে ২০২১ সালে বায়ুদূষণের মাত্রা এতো খারাপ হয়েছিল যে স্কুল কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

“বাইরে থেকে আসা এই ৩০ ভাগের মধ্যে যেসব দূষণকারী পদার্থ থাকে সেগুলো পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি করতে পারে। অর্থাৎ ক্ষতির দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় সীমান্তের ওপার থেকে বাতাস যেসব বিষাক্ত পদার্থ বয়ে আনছে সেগুলো স্বাস্থ্যহানির জন্য ৮০ ভাগ দায়ী,” বলেন তিনি।

এসব বস্তুকণা মানুষ নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করছে এবং সে কারণে তাদের স্বাস্থ্য-জনিত নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কার্বন মনোক্সাইড বুকে ব্যথাসহ শ্বাসতন্ত্রের নানা অসুখের জন্য দায়ী। নিশ্বাসের সঙ্গে এটি গ্রহণ করলে হৃদরোগও হতে পারে। নাইট্রোজেন অক্সাইডের কারণে নানা ধরনের প্রদাহ হয়, সালফার ডাই অক্সাইডের কারণে হতে পারে হাঁপানিসহ হৃদরোগ, ওজন গ্যাস ফুসফুসের কার্যক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সীসার কারণে শিশু ও বয়স্ক মানুষেরা খুব দ্রুত শ্বাসকষ্ট-জনিত অসুখে এবং শ্রবণ ও স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া এমনকি ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারে।

তবে বায়ুদূষণের জন্য দায়ী এসব ক্ষতিকর পদার্থ বাংলাদেশে খুব কমই উৎপন্ন হয়।

কোন দেশ থেকে কী আসে

গবেষকরা বলছেন, মূলত সীমান্তবর্তী দুটো দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকেই এসব দূষণকারী পদার্থ বাতাসে ভেসে বাংলাদেশে চলে আসছে। ড. হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ভারত তিন দিক থেকে বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে। মিয়ানমারের সঙ্গেও আমাদের সীমান্ত রয়েছে। বায়ুদূষণের জন্য যেসব পদার্থ দায়ী তার অনেকগুলোই এ-দুটো দেশ থেকে আসছে।”

ঢাকায় বায়ুদূষণ
বায়ুদূষণের কারণে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ভারতের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম- এসব রাজ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে শিল্প ও কলকারখানা। এছাড়াও এসব অঞ্চলে আছে বেশ কিছু কয়লার খনি। এগুলো থেকে প্রচুর দূষণকারী পদার্থ বাতাসে নির্গত হচ্ছে যা বাতাসের সাথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মিয়ানমার থেকেও কিছু দূষণকারী পদার্থ বাংলাদেশে আসছে যার মধ্যে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানের ফলে তৈরি নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার।

এছাড়াও মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় প্রচুর পরিমাণে গাছপালা পোড়ানো হয় যার ফলে সেখানে যে ‘কার্বন ছাই’ তৈরি হয় সেটা বাতাসে ভেসে বাংলাদেশে চলে আসে।

কোন সময়ে আসে

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান এবং বাতাসের গতিপথ বিবেচনা করলে দেখা যায় যে এসব বস্তুকণা সাধারণত বছরের তিনটি সময়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

“ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথমভাগ পর্যন্ত এই বাতাস আসে মূলত উত্তর-পূর্ব দিক থেকে, অর্থাৎ আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরা থেকে। আরেকটি আসে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এবং তৃতীয় সময়টি হচ্ছে জুলাই থেকে অগাস্ট পর্যন্ত, একই দিক থেকে,” বলেন ড. হোসেন।

এসডোর গবেষণায় দেখা গেছে বায়ু দূষণকারী এসব পদার্থ সাধারণত ৫০ থেকে ১০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে। তবে এটা নির্ভর করে দূষণকারী পদার্থের ওজন এবং বাতাসের গতি ও দিকের ওপর।

ভারতে কয়লার খনি বায়ু দূষণের অন্যতম একটি উৎস।
ভারতে কয়লার খনি বায়ুদূষণের অন্যতম একটি উৎস।

এর মধ্যে ওজন গ্যাস সবচেয়ে বেশি দূর পর্যন্ত যেতে পারে।

“ওজন গ্যাস ১০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড এগুলো ৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে,” বলেন তিনি।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বায়ু দূষণের মাত্রা প্রায়শই মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছায়। গত বছর পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ হয়েছিল যে দিল্লি ও তার আশেপাশের এলাকায় কলকারখানা ও স্কুল কলেজ কয়েকদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।

কিন্তু সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে বায়ুদূষণের পরিস্থিতি কখনও এতোটা খারাপ হতে শোনা যায় না।

“এই পার্টিকেলগুলো যখন নির্গত হয় এবং সেসব বাতাসে ভেসে অন্য জায়গাতে চলে যায়, তখন মূল জায়গাতে কিন্তু বাতাসের মান তুলনামূলকভাবে ভাল থাকে। উদাহরণ হিসেবে আসামের গৌহাটিকে যদি ধরি তাহলে দেখা যাবে যে গৌহাটির অবস্থা ঢাকার চেয়ে ভাল। এর কারণ হচ্ছে বাতাসের গতিপথ,” বলেন পরিবেশ বিজ্ঞানী শাহরিয়ার হোসেন।

কিন্তু ঢাকায় জমছে কেন

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জরিপে প্রায়শই দেখা যায় যে ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা বিশ্বের অন্যান্য শহরগুলোর তুলনায় সবচেয়ে খারাপ। বাতাসের গুণগত মান যাচাই করে যে সূচক তৈরি করা হয় তার একেবারে শীর্ষে স্থান করে নেয় এই শহর।

গত কয়েক বছর ধরেই এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

নির্মাণ খাত ঢাকার বায়ু দূষণের একটি উৎস।
নির্মাণ খাত ঢাকার বায়ু দূষণের একটি উৎস।

সম্প্রতি সারা বিশ্বে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে শীর্ষস্থানে ঢাকার সঙ্গে রয়েছে প্রতিবেশি কলকাতাও।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সীমান্তের বাইরে থেকে দূষণকারী পদার্থ বাতাসের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও সেগুলো রাজধানীতে এসে জমা হচ্ছে কেন?

বিজ্ঞানী ড. হোসেন বলেন, “এই ডেপোজিশন বা জমা হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এসব পদার্থ যখন উড়ে আসে তখন বাতাসের গতিবেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকা এবং ময়মনসিংহের কাছে এসে বাতাস দুর্বল হয়ে নেমে যায়। একারণে দূষণকারী পদার্থগুলো ঢাকা এবং তার আশেপাশে বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জে গিয়ে জমা হয়।”

এছাড়াও উত্তর দিক থেকে যখন বাতাস বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট বাতাস দক্ষিণ দিক দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে বাধার সৃষ্টি করে। বাতাসের দূষণকারী পদার্থগুলোর ঢাকায় জমা হওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ বলে গবেষণায় দেখা গেছে।

শাহরিয়ার হোসেন বলেন, “কখনো কখনো বাতাসের প্রবাহ আরো দূরে চলে গেলেও উঁচু উঁচু পাহাড়ের কারণে সিলেটের কাছে গিয়ে শেষ হয়ে যায়। সেজন্য সিলেটের বায়ুদূষণও বিপজ্জনক মাত্রায় গিয়ে পৌঁছায়।”

ভারত ও মিয়ানমারে যায় না কেন

বাতাসের সঙ্গে ভেসে এসব পদার্থ যদি সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তাহলে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের জন্য দায়ী যেসব পদার্থ তৈরি হয় সেগুলো ভারত কিম্বা মিয়ানমারের দিকে যায় না কেন?

“এর কারণ বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান। আমরা ডাউনে আছি এবং ভারী উপাদানগুলো নিচ থেকে খুব কমই উপরের দিকে যায়,” বলেন ড. হোসেন।

গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের ভেতরে বায়ু দূষণকারী যেসব পদার্থ রয়েছে তার মধ্যে শিল্প কলকারখানায় তৈরি পার্টিকেলের সংখ্যা অনেক কম। সবচেয়ে বেশি তৈরি হচ্ছে নির্মাণ খাত থেকে তৈরি পার্টিকেল যেগুলো ওজনে ভারী হওয়ার কারণে খুব বেশি দূর পর্যন্ত উড়তে পারে না।

গবেষকরা বলছেন, ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস ধুলাবালি, ইটভাটা, যানবাহন ও নির্মাণকাজের সময় তৈরি ধুলা।

সমাধান কী

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন তারা মনে করেন ঢাকার বায়ু দূষণের জন্য বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ কারণগুলো ৭০% দায়ী আর বাকি ৩০% আসছে সীমান্তের ওপার থেকে।

তারা বলছেন, এই সমস্যার সঙ্গে অনেক দেশ জড়িত থাকার কারণে বাংলাদেশের একার পক্ষে এটি সমাধান করা সম্ভব নয়।

এজন্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন।

“এর সঙ্গে চীন, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এমনকি থাইল্যান্ডেরও সম্পর্ক রয়েছে। ভারত, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানসহ এসব দেশকে নিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে দূষণকারী পদার্থ বাতাসে না ছড়ায়। শুধু বাংলাদেশের স্বার্থে নয়, ওই দেশগুলোর স্বার্থের কথাও এখানে বিবেচনা করতে হবে,” বলেন এসডোর মহাসচিব শাহরিয়ার হোসেন।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা