শিল্প সাহিত্য

সুধাংশু এখন 

– ইকবাল জুয়েল 

 

“একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই  সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।”

কবিতার অনুশীলন করছি, কিছুক্ষন পর স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানএ – কবিতা পাঠ  শুরু হবে। হঠাৎ, দর্শকদের মাঝে, প্রথম সারিতে বসা প্রৌঢ় এক ভদ্রলোককে দেখে চমকে গেলাম। 

কৃষ্ণেন্দু মামা! কিন্তু মিসৌরি’র এই ছোট্ট শহরে এলেন কিভাবে? আর কখনই বা এলেন?  বয়স আশি(!?)…তারও বেশি হবার কথা! 

“নমস্কার কৃষ্ণেন্দু মামা, ভালো আছেন? আমি শাহেদ। চিনতে পেরেছেন? আপনার সাথে প্রায় চল্লিশ বছর পর দেখা?! রওশন মামী কেমন আছেন? “

আমাকে অবাক করে বললেন, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না? 

পরিচয় দিয়েও যখন কোনো লাভ হলোনা, তখন হতাশ হয়ে ফিরে এলাম। কে যেন একজন বললেন, উনার নাম রেজা চৌধুরী। উনি কিন্তু বারবার আমাকে দেখছিলেন, হয়তো স্মৃতির এলবামে আমার ছবি খুঁজছেন? 

কৃষ্ণেন্দু মামা, মানে কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের একসময়ের নামকরা মঞ্চ অভিনেতা, আবৃত্তিকার, নাট্যকার! চিনতে পারছেন? রওশান আরা চৌধুরীর স্বামী। এবার চিনতে পারছেন? রওশান আরা চৌধুরীকে  কে না চেনে বলেন? বিশিষ্ট টিভি ব্যাক্তিত্ব।নাটক, চলচ্চিত্র, পহেলা বৈশাখএর রমনা-বটমূলএ , একুশের সভায়  – জাতীয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। কোথায় ছিলেননা তিনি? 

তারই স্বামী, কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী।  

কৃষ্ণেন্দু-মামাকে সেই ছোটবেলা থেকেই আমরা চিনি। আমার নানাজীর বেস্ট-ফ্রেন্ড এর ছেলে। আমাদের পারিবারিক বন্ধু। আমাদের বাড়ি এলে, উনি যেমন আমার মায়ের হাতের রান্না না-খেয়ে যাবেননা, আমরাও তেমনি উনার একটি কবিতা বা গান, না শুনে ছাড়তামনা।

মায়ের কাছে শুনেছিলাম, পঞ্চাশের দশকে, যখন নোয়াখালীতে রায়ট লেগেছিলো, চৌধুরী পরিবার তাদের জমিদারির সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণেন্দু মামা যাননি। তিনি এক মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে বাংলাদেশেই থেকে যান।

সেই মুসলমান মেয়েই হলেন, আমাদের মামী, রওশন-আরা চৌধুরী। শুনেছি, উনি হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং সেজন্য উনাকে কঠিন পরীক্ষায় পাশ হতে হয়েছিল। মামাকে তাঁর ধর্ম বদলাতে হয়নি, চমৎকার ব্যাক্তিত্বৰ জন্য শশুর বাড়ির সবাই তাকে আপন করে নিয়েয়েছিলেন। 

এবার ফিরে আসি মিসৌরির গান্ধী সেন্টার-এ. 

কেউ একজন আজান দিয়েছেন, মাগরেবের নামাজের জন্য ডাকছে। ঘোষণা আসছে – “ভাইরা, কাতার ঠিক করে নিন”

কৃষ্ণেন্দু মামার মতো দেখতে, সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোককে কেউ একজন চেয়ার এগিয়ে দিলেন। তিনি এক কাতারে বসে মাগরিবের নামাজ আদায় করলেন, পকেট থেকে তসবিহ বের করে দরূদ পড়লেন। আমি দূরে বসে দেখছি আর ভাবছি, দুই ধর্মের দুইজন মানুষ, অথচ কি আশ্চর্য মিল?! 

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত প্রায় এগারোটা বাজলো। সবকিছু গুছিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। সেই সকাল সাতটা থেকে কাজ করছি, ক্লান্ত শরীর। কত তাড়াতাতি বাড়ি ফিরে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেব, সেই চিন্তা করছি। এমন সময় দেখি, তিনি! গান্ধী সেন্টারের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। 

বললাম, “সেকি, আপনি এখনো বাড়ি ফেরেননি? রাইড লাগবে?”

তিনি হঠাৎ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন – “বুলি-বু ভালো আছেন?” 

আমি চুপ হয়ে গিয়েছিলাম, অনেক্ষন, তারপর কে যেন আমাকে দিয়ে বলিয়ে দিলো 

  – “আম্মা মারা গেছেন প্রায় দশ বছর হলো”।

 

ইকবাল জুয়েল: লেখক,  বাচিক ও সংগীত শিল্পী। সাংস্কৃতিক কর্মী ।  আমেরিকার বাসিন্দা।