বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (২৬)

-বিজন সাহা

বিগত অনেকগুলো লেখায় আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের কারণ খুঁজেছি। আগেই বলেছি আমি ইতিহাসবিদ বা সমাজতাত্ত্বিক নই, তাই এসব লেখা কোন মতেই গবেষনাপত্র হিসেবে দেখা ঠিক হবে না।  আমি শুধু আমার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে গেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন এক বিশাল ঘটনা আর তার কারণ অনেক। এসব কারণগুলো যখন একত্রে মিলিত হয়েছে তখনই ঘটনা ঘটেছে। দেশে একটা কথা বলে, “বোঝার উপর শাঁকের  আটি।“ অর্থাৎ যখন বিভিন্ন কারণে কোন কিছু সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন সামান্য কিছুই কফিনে শেষ পেরেকটা গাঁথতে পারে। তবে অনেক সময় ছোটখাটো ঘটনা রক্ষাকর্তার ভুমিকাও পালন করতে পারে। মনে পড়ে সেই শালগমের গল্প? দাদুর বাগানে বিশাল বড় এক শালগম হয়েছে। দাদু তুলতে পারছেন না। এরপর তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন দাদী। এরপর একে একে নাতনি, কুকুর, বিড়াল – কিন্তু শালগমের ওঠার নাম নেই। শেষপর্যন্ত যখন ইঁদুর এসে ওদের সাথে যোগ দিয়েছে – শালগম বিনা বাক্যে উঠে এসেছে মাটির ঘর থেকে। আর এ কারণেই আমি বিভিন্ন ছোটোখাটো, একেবারে নগন্য বিষয় নিয়ে কথা বলেছি, যা আপাত দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও কোন না কোন ভাবে এই পতনে অবদান রাখতে পারে। আর একথা যদি আমরা মনে রাখি তাহলে ভবিষ্যতে এসব ঘটনাকে অবহেলা করার সুযোগ কম থাকবে।

তখন স্কুলে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। ভারত থেকে তখন পেন্সিল, ব্লেড কত কিছু আসত। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরে চীন থেকে আসা পণ্যে দেশ সয়লাব হয়ে যায়। আমরা প্রায়ই বলতাম, কি দেশ যে একটা আলপিন পর্যন্ত বানাতে পারে না! ১৯৮৩ সালে মস্কো আসার পর দোকানে যখন বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের অভাব দেখলাম তখন বিশেষ করে সোভিয়েত বন্ধুদের সাথে আলাপে যে কথাটা বলতাম তা হল, “যে দেশ মহাকাশে মানুষ পাঠাতে পারে, বিভিন্ন গ্রহে রকেট পাঠাতে পারে, বিভিন্ন রকম ক্ষেপনাস্ত্র তৈরি করতে পারে তারা কেন ভাল পোশাক আশাক, কম্পিউটার এসব তৈরি করতে পারে না? এটা কি কোন কথা হল?” ঘটনাটা সত্যিকার অর্থেই আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগত। কিন্তু বাস্তবতা ছিল এটাই। বিপ্লবের পর পর এদেশে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, বিভিন্ন দেশ রুশ দেশের উপর আক্রমণ করে তখন ছিল ভায়েন্নি কমিউনিজম বা যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ যেটা ১৯১৮ থেকে ১৯২১ সাল, মানে ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের আগ পর্যন্ত বজায় ছিল।  এরপরে আসে স্তালিনের সন্ত্রাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি। ফলে সে অর্থে দেশ সব সময়ই গেছে জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে। সেই অবস্থায়, বিশেষ করে দেশকে কৃষি নির্ভরতা থেকে বের করে আনার জন্য ভারি শিল্প বা হেভী ইন্ডাস্ট্রির দরকার ছিল। আর এ কারণেই সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে বা যুদ্ধ পরবর্তী কয়েক বছর পরে যখন শান্তি এল তখন তো মানুষ আর সেই কৃচ্ছ্যতার মধ্যে যেতে চাইলো না, তার দরকার হল শান্তিকালীন সময়ের বিভিন্ন সামগ্রীর। সেটা দিতে পারে লাইট ইন্ডাস্ট্রি যা এদেশে তেমন করে গড়ে তোলা হয়নি। এ বিষয়ে অনেকেই বলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন শত্রু পরিবেষ্টিত ছিল, ইচ্ছা অনিচ্ছায় তাকে সামরিক খাতে ব্যয় করতে হয়েছে। আর এ কারণেই ভারি শিল্পের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে হয়েছে। এটা ঠিক, আপনার চারিদিকে শত্রু থাকলে দেয়াল তুলতেই হবে। কিন্তু দেয়াল তোলার সাথে সাথে সৈন্যদের প্রস্তুত করতে হবে, কারণ শুধু দেয়াল দিয়ে শত্রু মোকাবিলা করতে পারবেন না। কিন্তু সৈন্য বাদেও আরও যেসব লোকজন আছে তাদের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। তাদের মধ্যে যাতে অসন্তোষ তৈরি না হয়, যাতে ঘরে বিভীষণের জন্ম না হয়, সে জন্য এই সব মানুষের কথা ভাবতে হবে, তাদের ভাল রাখতে হবে। তার মানে আত্মরক্ষা এক জটিল পদ্ধতি যেখানে এক সাথে অনেকগুলো সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হয়। এটা ঠিক পশ্চিমা বিশ্ব চেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নামিয়ে এর অর্থনীতিকে স্থবির করে দিতে। প্রতিপক্ষ সব সময় চাইবে নিজের খেলাটা খেলতে, আমরা তাতে পা দেব নাকি নিজেদের মত করে খেলে উল্টা প্রতিপক্ষকে আমাদের মত করে খেলায় বাধ্য করব – সেটা একান্তই আমাদের ব্যাপার। সোভিয়েত নেতৃত্ব সেটা পারেনি। সময়ের সাথে তারা নিজেদের বদলাতে পারেনি। পরিবর্তনই একমাত্র সত্য – মার্ক্সবাদের এই মূল কথাটা ভুলে তারা ডগমায় বিশ্বাস করেছে। ফলে অর্থনীতির ইঁদুর দৌড়ে তারা অনবরত পেছনে পড়ে গেছে।

পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্ত নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, তাই সেদিকে না গিয়ে একটা ছোট ঘটনার দিকে নজর দিতে চাই। আমি যখন এদেশে আসি বিভিন্ন স্লোগানের সাথে একটা স্লোগান ছিল পার্টি ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ। আমার ধারণা বিপ্লবের সময় এই স্লোগান ছিল মূলত এটা বলার জন্য যে পার্টি জনগণের স্বার্থেই কাজ করবে, জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে। এক সময় সেটাই ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটার পরিবর্তন হয়েছে। কথায় বলে “প্রথমে আমরা নামের (যশের) জন্য কাজ করি, পরে নাম আমাদের জন্য কাজ করে।” এখানেও সেটাই ঘটেছিল। এক সময় পার্টি জনগণের স্বার্থে কাজ করলেও পরবর্তীতে জনগণের কথা বলে পার্টি বা পার্টির অনেকেই নিজেদের স্বার্থই উদ্ধার করেছে। তাই এই ঐক্যে জনগণের কতটুকু সায় ছিল সেটা জানি না, তবে পার্টি সেটাই মনে করত আর নিজের সিদ্ধান্ত জনতার সিদ্ধান্ত বলেই সবার উপর চাপিয়ে দিত। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারিই ছিলেন দেশের প্রধান ব্যক্তি। গরবাচভ ক্ষমতায় এসে পশ্চিমা ধাঁচে প্রেসিডেন্টের পদ প্রবর্তন করেন। দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন আন্দ্রেই গ্রোমিকো। এটা আসলে সাধারণ সম্পাদক পদে গ্রোমিকোর গরবাচভকে সমর্থন করার পুরস্কার হয়তো। কিছুদিন পরে গরবাচভ অবশ্য নিজেই সেই পদে অধিষ্ঠিত হন। যদিও প্রেসিডেন্ট পদ অনেকট নামমাত্রেই ছিল, গরবাচভ সেই দায়িত্ব নেবার পর থেকে প্রেসিডেন্টের গুরত্ব বেড়ে যায়, বিশেষ করে যখন তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হিসেবেই পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃবৃন্দের সাথে বিভিন্ন সামিটে মিলিত হন। এই দ্বৈত শাসন গরবাচভকে শক্তি না জুগিয়ে দুর্বল করেছে বলেই আমার ধারণা আর এর সুযোগ নিয়ে ইয়েলৎসিন তাঁকে সহজে ঘায়েল করতে পেরেছেন। বিভিন্ন স্থানীয় নেতারা প্রেসিডেন্ট গরবাচভের বিরুদ্ধে যেভাবে সোচ্চার হতে পেরেছেন, জেনারেল সেক্রেটারি গরবাচভের বিরুদ্ধে ততটা পারেননি। এ থেকেও বুঝি অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত কতটা ভুল ছিল। অথবা সত্তর বছর নিজস্ব স্টাইলে (বলতে গেলে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়া বা পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন একই স্টাইলে চলেছে, শক্তিশালী কেন্দ্রের অধীনে) হুট করে পশ্চিমা বিশ্বকে অনুসরণ করার ফলও হয়তো পতনের অনেকগুলো কারণের একটা। তবে একই সাথে দুই পদে অধিষ্ঠিত হওয়া গরবাচভের ক্ষমতার প্রতি লিপ্সার কথাই বলে।

ঐ সময় এ দেশে খবর শুরু হত «আজ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটব্যুরোর» সংবাদ দিয়ে। আমার মনে হত ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমিনির সেই বাণী প্রচারের কথা। সোভিয়েত বন্ধুদের এ নিয়ে টিপ্পনী কাটতাম। যদিও ঐ সময়ের বিভিন্ন বইপত্রে, এমনকি ক্লাসে স্তালিনের সাথে ত্রতস্কি, বুখারিনসহ অনেকের মত বিরোধের কথা আর পরিণামে মৃত্যুর কথা আমাদের বলা হত, তবে সেটা যতটা না পার্টির ভেতরে ভিন্ন মতের উপস্থিতি হিসেবে দেখানো হত তার চেয়ে বেশি স্তালিনের সন্ত্রাস হিসেবেই প্রকাশ করা হত। যাই হোক এসব থেকে মনে হতে পারে যে সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি খুবই ঐক্যবদ্ধ ছিল। আসলে পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ মনে হলেও সেখানে বিভিন্ন স্রোত ছিল, ছিল বিভিন্ন মত। ইয়েলৎসিনের সাথে গরবাচভের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সর্বজনবিদিত। পলিটব্যুরোর একজন শক্তিশালী ও জনপ্রিয় মেম্বার ছিলেন গ্রেগরি ভাসিলিয়েভিচ রোমানভ। তিনি লেনিনগ্রাদের পার্টি নেতা। অনেকেই বলত রোমানভ রাজবংশের সাথে তাঁর সম্পর্ক আছে, যদিও তাঁর জন্ম এক কৃষক পরিবারে। অন্দ্রোপভের মৃত্যুর  পরে রোমানভ আর গরবাচভ দুজনের নামই শোনা গিয়েছিল পরবর্তী জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে। বাদ সাধেন কনস্তান্তিন চেরনেঙ্কো। কিছুদিনের মধ্যে চেরনেঙ্কো মারা গেলে রোমানভকে, যিনি সে সময় বাল্টিকে ছিলেন পার্টির কাজে, খবর দেওয়া হয় ১০ ঘন্টা পরে। ঐ সময় মনে হয় ইচ্ছাকৃত ভাবেই গুজব  রটানো হয় যে মেয়ের বিয়েতে হেরমিতাঝের বাসনপত্র ব্যবহার করেছিলেন যার কিছু কিছু ভেঙ্গে ফেলেন। যাই হোক, নির্বাচিত হওয়ার পরই গরবাচভ ১৯৭৬ সালে থেকে পলিটব্যুরোর সদস্য রোমানভকে পলিটব্যুরো থেকে অব্যাহতি দেন। বর্তমানে প্রকাশিত বিভিন্ন গোপন ডকুমেন্ট থেকে জানা যায় গরবাচভ ছিলেন সেই সমস্ত কমিউনিস্টদের এমন একজন যারা পার্টিকে ব্যবহার করেছেন নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে। আসলে এক্ষেত্রে গরবাচভ অনন্য নন। সে সময় অনেকেই এটা করত। এমনকি অনেক বিজ্ঞানী, লেখক, কবি, সৃজনশীল মানুষ এটা করতে বাধ্য হতেন। ব্যাপারটা এই নয় যে তারা পার্টির আদর্শে বিশ্বাস করতেন বা পার্টিকে ব্যবহার করে নিজেরা ব্যক্তিগত সুবিধা লাভ করতে চাইতেন। যেহেতু পার্টি মেম্বার না হলে নিজের প্রতিভা বাস্তবায়নের সমস্ত পথই রুদ্ধ ছিল, তাই অনেকেই পার্টি মেম্বার হতেন। এরা সাধারণত কারও ক্ষতি করতেন না, শুধু নিজেদের সৃজনশীল কাজ করে যেতেন। বিখ্যাত অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক আলেগ এফ্রিমভ এ কারণেই পার্টি মেম্বার হন। বলা যায় এরকম অনেক সত্যিকার অর্থেই প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন পরিস্থিতির শিকার। অন্য দিকে অনেক অযোগ্য মানুষ পার্টির হাত ধরে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তেন, পার্টির মেম্বার না হলে জীবনে তেমন কিছু করার যোগ্যতা তাদের ছিল না। আসলে এরাই ছিলেন সত্যিকারের ক্ষতিকর এলিমেন্ট। এটা আমরা বিভিন্ন দেশেই দেখি। আমাদের দেশেও একদল লোক সব সময় সরকারি দল করে। এদের লক্ষ্য একটাই, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আশেপাশে থেকে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়া। তাই এটা এই সব মানুষের দোষ নয়, দোষ পার্টির, কারণ পার্টি নিজেকে প্রশাসনের সাথে একাকার করে ফেলেছিল, অনেক সময় প্রশাসনের চেয়ে পার্টিই ছিল শক্তিশালী। আর এটাই অনেক অযোগ্য, অনেক দুই নম্বরি মানুষকে পার্টিতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করত। এভাবেই গরবাচভ আন্দ্রোপভ, চেরনেঙ্কো ও অন্যান্য পার্টি নেতাদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেন। এটা ছিল তখন সোভিয়েত সমাজে ভাল ক্যারিয়ার গড়ার অন্যতম প্রধান উপায়। ফলে দেশকে বদলানোর সদিচ্ছা থাকলেও সাংগঠনিক দক্ষতা না থাকায় তিনি সেটা করতে ব্যর্থ হন। অনেকের ধারণা তিনি বিদেশীদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, তাদের হাতের পুতুল ছিলেন। আমার মনে হয়, সাংগঠনিক দক্ষতা নয়, বিভিন্ন ভাবে নেতৃত্বের সুনজরে এসে উপরে ওঠার কারণেই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ তোষামোদ করে বসদের খুশি করে উপরে ওঠা যায়, কিন্তু নিজে বস হলে কাজ আদায় করা যায় না। খ্রুশেভকে যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় তা থেকেও আমরা পার্টিতে বিভিন্ন স্রোতের আঁচ পাই। একই কথা বলা যেতে পারে ব্রেঝনেভের আমলে যা এখন ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে। অনেক দক্ষ, জনপ্রিয় পার্টি নেতা মস্কোর ক্ষমতার বলয়ের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন। ভিন্ন মতের উপস্থিতি থাকলেও সেটা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারাটা হয়তো সোভিয়েতের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। এক্ষেত্রে কি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা দায়ী? আমার মনে হয়ে লেনিনের সময়ে পার্টি যখন আত্মগোপনে ছিল বা যুদ্ধাবস্থার মধ্য দিয়ে দেশ চালাচ্ছিল তখন গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর, বিশেষ করে শান্তির সময়ে সেটা প্রাসঙ্গিকতা হারায়। যখন দল ক্ষমতার বাইরে থাকে তখন তার কাজকর্মের সিংহ ভাগ পার্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। পার্টিকে শক্তিশালী করা, কর্মীদের ভালমন্দ দেখা এসব প্রধান কাজ। ফলে তখন যেকোনো সিদ্ধান্ত সঠিক ভাবে, অনেক সময় গোপনীয়তার সাথে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপার থাকে, প্রয়োজন হয় লৌহ কঠিন শৃঙ্খলার। সে সময় পার্টির কাজকর্ম অনেকটাই নির্ভর করে ক্ষমতাসীনদের ব্যবহারের উপর যা কিনা আগে থেকে কমবেশি আঁচ করা যায়। কিন্তু পার্টি ক্ষমতায় এসে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। পার্টির বাইরের সাধারণ মানুষের ভালমন্দের জন্য তাকে কাজ করতে হয় আর সেটা নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর যা প্রতিনিয়ত বদলায়। যার ফলে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে নমনীয়তা বা ফ্লেক্সিবিলিটি দরকার। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতায় সেটা থাকে না। একবার সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে সেটাকেই বাস্তবায়িত করতে হয়। সত্যিকারের নেতা, সত্যিকারের রাজনীতিবিদ তখন বিপদে পড়েন, কেননা তিনি বুঝতে পারেন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভিন্ন পথে এগুনোর প্রয়জনীয়তা, কিন্তু তার হাত পা বাঁধা। যদি লেনিন না হয়ে অন্য কেউ নেপ মানে নিউ ইকোনমিক পলিসির কথা বলতেন তাকে নিঃসন্দেহে সংশোধনবাদী অপবাদ নিয়ে পার্টি থেকে বিদায় নিতে হত। তাই আমার বিশ্বাস পার্টিতে গণতন্ত্রের চর্চা খুবই দরকার। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা থেকেও গণতন্ত্র অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ পার্টির জন্য। তাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ভারি শিল্পের পাশাপাশি হালকা শিল্পের উন্নতি দরকার, দরকার পার্টির নেতৃত্ব সেই সব লোকদের হাতে দেওয়া যাদের আছে সাংগঠনিক দক্ষতা আর সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তাকে বাস্তবায়ন করার মত মনোবল আর প্রতিনিয়ত পার্টির রণনীতি ও রণকৌশল পর্যবেক্ষণ করা, আর সেটা করার জন্যে দরকার গণতন্ত্র। কমিউনিস্ট পার্টিকে বলা হয় বিপ্লবের ভ্যানগার্ড। বিপ্লব যাতে সফল ও দীর্ঘস্থায়ী হয় সেজন্য পার্টিকে অনবরত নিজেকে বদলাতে হবে, অনবরত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব যদি পার্টির থাকে দক্ষ নেতৃত্ব আর থাকে আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র। আরও একটা ব্যাপার, দেশ, জাতি, সমাজের স্বার্থেই ধর্মের মত পার্টিকেও রাষ্ট্র থেকে  আলাদা রাখতে হবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো