চলমান সংবাদ

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পর আবার পশ্চিমবঙ্গে জমির লড়াই?

বীরভূমে কয়লাখনি তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে চায় রাজ্য সরকার। জমি দিলে আর্থিক প্যাকেজের পাশাপাশি পরিবারের একজনকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। একাংশের মানুষ নিজেদের সম্মতি প্রকাশ করলেও বড় অংশ বিরোধিতা করছেন।

বীরভূমের মহম্মদবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকায় মাটির নীচে রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খনি এলাকা। এক দশক আগে জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া জানায়, মহম্মদবাজার ব্লকের ডেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা এলাকায় ভূগর্ভে ২১০ কোটি টন কয়লা রয়েছে। ১২ বর্গ কিমির বেশি এই এলাকায় খনি তৈরির উদ্যোগ এর আগে নেওয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার চাইছে এখানে খনি তৈরি করতে যার মাধ্যমে রাজ্যের সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে তাদের দাবি। খনির পক্ষে জনমত গড়তে সম্প্রতি স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব মিছিলের আয়োজন করেছিল। এলাকার মহিলাদের প্রবল প্রতিরোধে মিছিল ভেস্তে যায়।

মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর চারটি দল নিয়ে এলাকা পরিদর্শন করে। সংগঠনের ৩০ জন সদস্য ১০-১২টি গ্রামে ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। সংগঠনের পক্ষে রঞ্জিত শূর বলেন, “আমাদের চারটি দল যা রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে একজন গ্রামবাসীও খনির পক্ষে মত দেননি। কিছুটা অবস্থাপন্ন তরুণরা খনির বিরুদ্ধে না হলেও সরকারের দাবি সম্পর্কে তাদের মধ্যে অবিশ্বাস রয়েছে।” মানবাধিকার কর্মী হিসেবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, “আমরা যেখানে যাচ্ছি, প্রতি মুহূর্তে আমাদের উপর নজর রাখা হয়েছে। স্বাধীনভাবে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারিনি।”

প্রতিবাদী জনতার পাশে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলি সংগঠন। তারা খনি প্রকল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে দাবিপত্র পেশ করা হয়। কী অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে? প্রতিবাদী মানুষের পাশে দাঁড়ানো অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিৎ বসু বলেন, “২০১৩ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন মানছে না রাজ্য। প্রকল্প রূপায়ণের আগে সামাজিক প্রভাব খতিয়ে দেখে রিপোর্ট জনসমক্ষে আনার কথা। তা নিয়ে গণশুনানি হওয়ার কথা। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে হবে। কিন্তু সেসব না করে সরকার আগেই প্যাকেজ ঘোষণা করে দিয়েছে। খনি হলে বড় অংশের মানুষ যেমন কাজ পাবেন, তেমনি অনেক মানুষ কাজও হারাবেন।”

খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে যারা, তাদের সকলের উদ্বেগ পরিবেশকে ঘিরে। সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “এতটা এলাকায় খননকাজ করা হলে পুরো ভূমিরূপ বদলে যাবে। এর কী প্রভাব পড়বে পরিবেশের উপর, তা নিয়ে কোনো সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনেনি রাজ্য। খনি প্রকল্পের ফলে প্রকৃতির ভারসাম্যে যে ক্ষতি হবে, তার মাসুল দেবেন স্থানীয়রা।” পরিবেশের সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রসেনজিৎ বসু বলেন, “বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে চিন্তা বাড়ছে। পরিবেশ দূষণ রুখতে যেখানে বিকল্প শক্তির ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানিতে জোর দেওয়া হচ্ছে কেন? অর্থাৎ প্রকল্পের এনভায়রনমেন্টাল কস্ট দেখতে হবে।”

সিঙ্গুর- নন্দীগ্রামের বিতর্ক আদালতে গড়িয়েছিল। ডেউচার ক্ষেত্রে আইনি লড়াই হলে কী পরিণতি হবে? সেভ ডেমোক্রেসি সংগঠনের পক্ষে আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় বলেন, “জল জমি জঙ্গলের উপর আদিবাসী মানুষের অধিকার মৌলিক অধিকারের সামিল। তা লঙ্ঘিত হলে আদালত নিশ্চয়ই সংবিধান রক্ষার কাজ করবে। একই সঙ্গে পরিবেশের যে ক্ষতি, সেটাও দেখা হবে আইনের চোখে।”

মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, ইতিমধ্যে ৫০টি মৌজায় জমি কেনা-বেচা বা হস্তান্তর বন্ধ করা হয়েছে, যা নাগরিকের ‘রাইট টু প্রপার্টি’ অধিকারকে খর্ব করে। সে জন্যও ক্ষুদ্ধ কিছু মানুষ। আদিবাসীদের জমির কাগজপত্র নেই, এ নিয়ে চেতনাও নেই। সে ক্ষেত্রে তাঁরা জমির বিনিময়ে কিছুই পাবেন না বলে শঙ্কিত মানবাধিকার কর্মীরা।

সিঙ্গুরের জমির লড়াই ছিল তৃণমূলের হাতিয়ার। সেই অস্ত্র কি তবে এখন বিরোধীদের হাতে? তৃণমূল নেতা, কলকাতার মেয়র পারিষদ বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সরকার কারো থেকে জোর করে জমি নেবে না। বিরোধীরা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তা ছাড়া সিঙ্গুরে সিপিএম উর্বর জমি নিয়েছিল। নন্দীগ্রামে গুলি চালিয়েছিল। এক্ষেত্রে জোর-জুলুমের প্রশ্ন নেই।” এ নিয়ে বিকাশরঞ্জনের জবাব, “সিঙ্গুরে শিল্প হচ্ছিল, খনি আদৌ শিল্প নয়। সেখানে অধিকাংশ মানুষ স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছিলেন। পরিবেশ ধ্বংস করা হয়নি। কারখানা ৯০ শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর প্রকল্প বাতিল হয়েছিল।”