চলমান সংবাদ

স্বাধীনতার ৫০ বছর: উন্নয়ন কার কাছে যায়?

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই বড় অর্জন৷ এর চেয়ে বড় অর্জন একটি জাতির জীবনে আর কিছু থাকতে পারে না৷ কিন্তু তাতে কী সব কিছু বলা হয়ে যায়? অবশ্যই না৷ তাহলে বাংলাদেশের অগ্রগতির গতিপথ কী?

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী, নারী নেত্রী ও অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণের নানা দিক ও মাত্রা আছে৷ কিন্তু সুশাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে তাদের অভিমতে অনেকটাই মিল৷ অর্জনের পথে বাধা কোথায়, কার দায় তা নিয়ে নানা মত৷ কিন্তু অর্জনটা আরো বড় হতে পারত বলে মনে করেন তারা৷

অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক বড়৷ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যেতে যোগ্যতা অর্জন করেছে৷ মানুষের আয় বেড়েছে৷ বেড়েছে জীবনযাত্রার মান৷ নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে৷ শিক্ষার হার বেড়েছে৷ কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবনতি হয়েছে, অবনতি হয়েছে মানবাধিকারের৷ মানবাধিকার কর্মী নূর খান তাই গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী মনে করেন এটা মধ্যবিত্তের সমস্যা৷ মধ্যবিত্ত তার ক্ষমতা হারিয়েছে৷ কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষ এটাকে পাত্তা দেয় না৷ তাদের অবস্থান আরো সংহত হয়েছে৷ মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের এই সাধারণ মানুষই বেশি অংশগ্রহণ করেছেন৷ তার কথা, ‘‘বিশ্বে এখন রাজনৈতিক রাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ছে৷ এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক রাষ্ট্র৷ বাংলাদেশ সেদিকেই যাচ্ছে৷ ফেসবুকের হাহাকার দিয়ে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা বোঝা যাবে না৷ সেটা বুঝতে হলে গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলতে হবে৷ আমি তাদের কাছে যাই৷ তাদের সাথে কথা বলি৷’’

অর্থনেতিক বৈষম্য বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিকে শ্লথ করছে: ড. নাজনীন আহমেদ

কিন্তু সেটাই কি পর্যাপ্ত? অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ  মনে করেন, ‘‘উন্নয়ন হয়েছে৷ সেটার বড় প্রমাণ আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে৷ কিন্তু বৈষম্যও বেড়েছে৷ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বেড়েছে৷ কিন্তু এর সুফল সবাই পাচ্ছে না৷ অর্থনেতিক বৈষম্য বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিকে শ্লথ করছে৷ আর এর জন্য দরকার সুশাসন, বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সাম্য৷’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়ন করা গেছে তার ওপর নির্ভর করে দেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরে কতটা এগিয়েছে৷ তার সেটা বিবেচনা করলে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আরো অনেক বাকি৷ তিনি বলেন,‘‘একটি উদার গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র নির্মাণে তার যে স্বপ্ন তা বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে৷ দেশ এগিয়েছে৷ কিন্তু দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিও সক্রিয়৷ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা তাদের অবস্থান তৈরিতে এখনো সক্রিয়৷ ফলে জাতির মধ্যে একটা বিভাজন স্পষ্ট৷ এটার অবসান ঘটা প্রয়োজন৷ তবে সেটা আপোস করে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবখানে প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সম্ভব৷’’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার মনে করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে৷ যুদ্ধাপরাধের বিচার চলমান৷ এগুলো খুব বড় প্রাপ্তি রাজনৈতিক দিক থেকে৷  তার কথা, ‘‘একটি ছোট দেশে বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে যে অর্থনৈতি অগ্রগতি হচ্ছে সেটা বড় ধরনের সাফল্য৷” তবে তিনি মনে করেন,”বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে ঘাটতি সেটাকে বিশ্ব প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হবে৷ বাংলাদেশে বিগত দুইটি নির্বাচন ভালোভাবে হয়নি৷ কারা এর জন্য দায়ী তার চেয়ে বড় কথা হলো এখন আমাদের প্রয়োজন রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক উন্নয়ন৷ আমাদের মনে রাখতে হবে এই ৫০ বছরে আমরা দুইবার দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক শাসনের মধ্যে ছিলাম৷’’

তার মতে, ‘‘বাংলাদেশের কিছু মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধটাও নেগোশিয়েবল৷ তারা ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা কমিয়ে তিন লাখ করতে পারলে খুশি হয়৷ এই মানসিকতা জাতীয় ঐক্যের পথে অন্তরায়৷’’

মধ্যবিত্ত তার ক্ষমতা হারিয়েছে: আফসান চৌধুরী

বাংলাদেশে গণতন্ত্র,মানবাধিকার এবং বিচার ব্যবস্থার এ অবস্থা  একদিনে হয়নি৷ বিভিন্ন সময় যারা দেশ শাসন করেছেন তারা কম বেশি দায়ী৷ তবে এই সময়ে সঙ্কট সবচেয়ে বেশি বলে মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নূর খান৷ তার মতে,‘‘এখন মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও বাক স্বাধীনতা খুব খারাপ পর্যায়ে রয়েছে৷ এগুলোর উন্নয়ন না হলে আর কোনো উন্নয়ন টেকসই হয় না৷’’

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে৷ তাদের শিক্ষার হার বাড়ছে৷ নারীরা শুধু চাকরি করছেন না , তারা উদ্যোক্তাও হচেছন৷ নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন,‘‘নারীদের এইসব বিষয়ে উন্নয়ন হচ্ছে৷ তবে এখনো আমরা উন্নত পর্যায়ে পৌঁছতে পারিনি৷ নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন বরং আরো বেড়েছে৷ নারী উন্নয়নের স্বাধীন চলকে এখনো পরিণত হতে পারেনি৷ তাকে এখনো ঠেলে এগিয়ে নিতে হয়৷ তাই এটাকে আমরা উন্নত অবস্থা বলতে পারি না৷’’

দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা,চিকিৎসা খাতেরও উন্নয়ন হয়েছে৷ কিন্তু এইসব উন্নয়নের বিপরীতে দুর্নীতি আর অর্থ পাচারও বেড়ছে  বলে জানান বিশ্লেষকেরা৷ আর সুশাসনের সংকটের মূলে এটাও বড় কারণ৷ আফসান চৌধুরী মনে করেন, এটা আগেও ছিলো৷ এখন অর্থনীতি বড় হয়েছে তাই দুর্নীতি আর অর্থ পাচারের পরিমাণও বেড়েছে৷ তারপরও গ্রাম শক্তিশালী হয়েছে৷ করোনায় এক কেটি মানুষ গ্রামে গিয়েছে৷ গ্রাম তাদের আশ্রয় দিয়েছে৷ শহর কিন্তু পারেনি৷

কিন্তু ড. নাজনীন আহমেদের মতে, ‘‘বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে সুশাসনের অভাবই এখন সবচেয়ে বড় বাধা৷ আর এটার পেছনে রাজনৈতিক নয়, বরং অর্থবিত্তের ক্ষমতাই বেশি সক্রিয়৷ সব কিছু তাদের কাছে যায়৷ উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের যেভাবে পাওয়ার কথা ছিলো তারা সেভাবে পাচ্ছে না৷”