চলমান সংবাদ

শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চির নিদ্রায় মুশতারী শফী

 মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফীকে চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সর্বস্তরের মানুষ। বুধবার (২২ ডিসেম্বর) সকাল সকাল ৯টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে প্রয়াত বেগম মুশতারী শফীকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৯টায় নগরীর এনায়েতবাজারের মুশতারী লজ থেকে প্রয়াতের মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত হন। উদীচী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা ও সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য রমেন দাশগুপ্তের পরিচালনায় শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরিন আক্তার ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেণু কুমার দে, বীর মুক্তিযোদ্ধা বালাগাত উল্লাহ, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, সিপিবি, চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা, উদীচী চট্টগ্রামের সহ-সভাপতি ডা. চন্দন দাশ, বেগম মুশতারী শফীর সন্তান মেহরাজ তাহসান শফী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির চট্টগ্রামের সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার, কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল ও ওমর কায়সার, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু, প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসান, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি তপন দত্ত, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের শৈবাল চৌধুরী, মহিলা পরিষদের লতিফা কবীর, সাবেক সাংসদ চেমন আরা তৈয়ব, সাবেক ছাত্রনেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী, আইনজীবী ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক এস এম মোস্তফা সরওয়ার, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের শ্যামল কুমার পালিত, বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি আব্দুল হালিম দোভাষ, ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত। কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘বেগম মুশতারী শফীর জীবন ত্যাগ ও সংগ্রামের জীবন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বামী ও ভাইকে হারিয়েছেন। এরপরও দমে যাননি। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন, নিজে সেখানে অংশ নিয়েছেন শব্দসৈনিক হিসেবে। ষাটের দশকে এদেশের পিছিয়ে থাকা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরীব পরিবারের নারীদের সংঘটিত করে তাদের অধিকার আদায়ে কাজ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি লেখালেখি করেছেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছেন। উনার সবচেয়ে বড় অবদান ঘাতক-দালালদের বিচারের আন্দোলন। সাহসী ভূমিকা নিয়ে তিনি এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। তাঁকে হারিয়ে আজ আমাদের অত্যন্ত শোকের দিন।’ শহীদজায়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরিন আক্তার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুধু বেগম মুশতারী শফীর স্বামী-ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করেনি, উনার বাড়িঘর লুটপাট করে ধ্বংস করে দিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই ধ্বংসাবস্থা থেকে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এদেশের সকল সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি সবসময় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’ বীর মুক্তিযোদ্ধা বালাগাত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম, আমাদের অনেকের যুদ্ধ একাত্তর সালের ষোলই ডিসেম্বর শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বেগম মুশতারী শফীর যুদ্ধ শেষ হয়নি। তিনি আজীবন যুদ্ধ করে গেছেন। যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করে গেছেন।’ চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘আমরা যারা নিজেদের প্রগতিশীল হিসেবে দাবি করি, বেগম মুশতারী শফী ছিলেন আমাদের বাতিঘর। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এদেশের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে ছিল উনার সরব উপস্থিতি। আমরা দেশের নানা সংকটে, ক্রান্তিকালে উনাকে রাজপথে পেয়েছি। উনি কখনোই মানুষকে ছেড়ে যাননি, একইভাবে মানুষও উনাকে শ্রদ্ধার আসনে রেখেছেন। বেগম মুশতারী শফীর শেষযাত্রায় শ্রদ্ধা জানাতে আসা এত মানুষের উপস্থিতি সেটাই প্রমাণ করে।’ সিপিবি, চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা বলেন, ‘বেগম মুশতারী শফীর পুরো পরিবার ছিল কমিউনিস্ট পার্টির অত্যন্ত সুহৃদ। পাকিস্তানে আমলে যখন বারবার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়, তখন উনার বাসা ছিল গোপন পার্টির নেতাদের আশ্রয়স্থল। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা উনার বাসায় অস্ত্র রেখে এসেছিলেন। সেই অপরাধে উনার স্বামীকে হত্যা করা হয়। উনার ভাইকেও হত্যা করা হয়। স্বামী-ভাইয়ের বিয়োগব্যাথা বুকে নিয়ে উনি ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশে সমাজ-প্রগতির সংগ্রাম করে গেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে লড়েছেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়েছেন, লুটেরা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও লড়েছেন। সংস্কৃতির সংগ্রামে তিনি নিজেকে নিবেদিত করে বিদায় নিয়েছেন। তিনি আমাদের হৃদয়ে থাকবেন।’ উদীচী চট্টগ্রামের সহ-সভাপতি ডা. চন্দন দাশ বলেন, ‘বেগম মুশতারী শফীর নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন করেছিলাম। এমনকি যখন গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হল, উনি এসে লাখো তরুণকে শপথবাক্য পাঠ করালেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে আপসের বিরুদ্ধে উনি বারবার গর্জে উঠেছেন। সংস্কৃতির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গরীব-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি উদীচীতে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। যে আদর্শের পতাকা তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন, আমরা সেটা আমৃত্যু বহন করে নিয়ে যাব।’

বেগম মুশতারী শফীর সন্তান মেহরাজ তাহসান শফী বলেন, ‘আমার বাবাকে আমরা একাত্তরে হারিয়েছি। আমার মা অনেক কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন। তিনি শুধু পরিবারের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকেননি। লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কোনো পদক কিংবা পুরস্কারের জন্য করেননি। কিন্তু জীবিত অবস্থায় তিনি যদি রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হতেন, আমরা শান্তি পেতাম। আমার মা যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে যদি বাংলাদেশ অবিচল থাকে, আমার মায়ের আত্মা শান্তি পাবে।’ বেগম মুশতারী শফীর মেয়ে রুমানা শফী শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচির মধ্যে একটি শপথবাক্য পাঠ করেন। তিনি জানিয়েছেন, জীবদ্দশায় তার মায়ের রেখে যাওয়া শপথবাক্যটি তিনি পেয়েছেন। এতে বলা হয়, ‘যারা ১৯৭১-এ নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে এবং নৃশংসভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, সে খুনিদের সাথে কোনো আপস হতে পারে না। অতীতের সব ত্রুটি বিচ্যুতি ঝেড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশে প্রতিষ্ঠিত হোক।’

# ২২.১২.২০২১ চট্টগ্রাম #