চলমান সংবাদ

চীনকে নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ

চীনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই একটা মেরুকরণ হয়ে গেছে। ‘ঐতিহাসিক বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত বিরোধী বিএনপি বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনের সমালোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সম্ভবত এতেই ক্ষুব্ধ হয় বিএনপি।

১১ই ডিসেম্বর রাতে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চীনা রাষ্ট্রদূতের দেয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, আমরা ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত।

বিবৃতিতে বলা হয়, চীন তার নিজ দেশে কি ব্যবস্থা বহাল রাখবে তা একান্তই তার অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ ঐতিহ্যগতভাবে অবাধ নির্বাচন ও প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার চর্চার মাধ্যমে তাদের রাষ্ট্রীয় অধিকারের চর্চা করছে এবং করবে। কারণ প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার প্রয়োগই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাণ। এটাই জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণতন্ত্র চর্চার সর্বজনীন পন্থা।

চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং তার ভিডিও বার্তায় বলেন- চীন বিশ্বাস করে যে, একটি দেশ গণতান্ত্রিক কিনা তা নির্ভর করে তার জনগণ সত্যিকার অর্থে সে দেশের মালিক কিনা তার ওপর।

বাংলাদেশের গল্পটিও এক। দেশটি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের পথে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। একটি সরকারসহ একটি দেশ যার ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে তা যদি গণতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃত না হয় তাহলে হয়তো গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। অথবা সংজ্ঞার পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।

১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা সবার জানা। তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানকেই সমর্থন করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া থেকেও বিরত থাকে। ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ৩১শে আগস্ট চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। নানা ঘটনাবলির মধ্যে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর চীনের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিবিড় হয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার আমলে এই সম্পর্কে বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটে। ঢাকায় তাইওয়ানকে ট্রেড মিশন খোলার অনুমতি দেয়ায় চীন ক্ষুব্ধ হয়। এতেই দু’দেশের সম্পর্কে অবনতি ঘটে। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক উচ্চতায় পৌঁছে। বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত সম্পর্ক অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।

বিএনপির এই বিবৃতির পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানামুখী আলোচনা চলছে। বলা হচ্ছে- বিএনপি কি তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই ঝুঁকছে?

কাকতালীয় হলেও সত্য যে, বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনের পরপরই বিএনপি চীনবিরোধী অবস্থান নিয়েছে।

বিএনপির এই অবস্থান কি সঠিক? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, “আমি বিস্মিত নই। কারণ এটা হঠাৎ করে হয়নি। আমরা বেশ কয়েক বছর যাবৎ লক্ষ্য করছি চীনের সাথে এই সরকারের ঘনিষ্ঠ মৈত্রী গড়ে উঠেছে । চীন শুধু অর্থনৈতিক সাহায্য করেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা কিন্তু ২০১৮ সনের বিতর্কিত নির্বাচনকেও সমর্থন করেছে। কিছুদিন আগে তারা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়েছে- এরকম একটা বিবৃতিও দিয়েছে”। তিনি বলেন, “চীন যখন বিএনপির সবচাইতে বড় রাজনৈতিক শত্রুর পক্ষে অবস্থান নেয় তখন স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এতে অনেকেই অবাক হয়েছেন। কিন্তু আমি মনে করি, এটা প্রত্যাশিত ছিল”।

“এই বিবৃতির মাধ্যমে আমার মনে হয় বিএনপি আমেরিকাকে দেখাতে চেয়েছে যে, গণতন্ত্র সম্মেলনে দাওয়াত না দেয়া এবং অন্যকিছু বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে তারা খুশি”।

আসিফ নজরুল আরও বলেন , “ বিএনপি এটাও দেখাতে চেয়েছে তারা আমেরিকার ঘনিষ্ঠ হতে চায় বা আমেরিকার ঘনিষ্ঠ আছে। এতে আমেরিকার আস্থা অর্জনের চেষ্টাও এই বিবৃতিতে রয়েছে”।

ও দিকে বেইজিংয়ে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ মনে করেন, বিএনপির সমালোচনা এসেছে চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের পর। আর এটা চীনা রাষ্ট্রদূত কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলন নিয়ে। সুতরাং, প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে।

তিনি বলেন, “ আমাদের দেশে দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুব কমই চিন্তাভাবনা করে কথা বলেন। কোনো অবস্থানে তারা স্থির থাকতে পারেন না। বিএনপি চীনের সমালোচনা করে বলে বলছি না”।

রাষ্ট্রদূত ফয়েজ বলেন, “বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলন নিয়ে খোদ আমেরিকাতেই প্রশ্ন রয়েছে। টাইম ম্যাগাজিন কড়া সমালোচনা করেছে। তারা এটাকে ভন্ডামি বলে আখ্যা দিয়েছে। আমেরিকার মিডিয়ার এমন সমালোচনার মুখে ঢাকাস্থ চীনা রাষ্ট্রদূতের কথা বলার প্রয়োজন ছিল না। তবুও তিনি যখন কথা বলেছেন তখন তার সমালোচনা করার মতো কিছু থাকলে তারা করতেই পারেন। তবে সে সমালোচনা হতে হবে গঠনমূলক”।

সূত্রঃ ভয়েস অব আমেরিকা