বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (২১)

-বিজন সাহা

গত সপ্তাহে আমি সোভিয়েত সমাজের বিভিন্ন ছোটোখাটো ঘটনার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলাম কীভাবে সমাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কি শুধুই এই নেগেটিভ দিক ছিল? সেখানে কি কিছুই পজিটিভ ছিল না? যখন দেশ থেকে প্রথম আসি দেখি কীভাবে মানুষ নিশ্চিন্ত মনে কাজ শেষে ঘরে ফিরছে বই পড়তে পড়তে। যেখানে আমাদের সব দেশে মানুষ সব সময় কিছু না কিছুর পেছনে ছুটছে, এদের শান্ত, ধীরস্থির গতি দেখে অবাক হতাম। হ্যাঁ, তখন এদের মনে স্বস্তি ছিল, আগামী দিনের জন্য তারা তেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিল না। তারা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কমবেশি নিশ্চিত ছিল। জানত লেখাপড়া শেষে সবারই একটা না একটা চাকরি জুটবে। ছিল ফ্রী চিকিৎসা। স্কুলের বাইরে নামমাত্র খরচে ছেলেমেয়েরা নাচ, গান, ছবি আঁকা, মিউজিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় শিখতে পারত। পরিবার পরিজন নিয়ে মাঝে মধ্যে সরকারি খরচে কোথাও বেড়াতে যেতে পারত। হয়তো অপেক্ষাকৃত অলস বা অনুদ্যোগী মানুষের জন্যে সেটা ছিল সোনায় সোহাগা আর মিডিওকারদের জন্য চলনসই, তবে উদ্যোগী মানুষের জন্য সেসব কোন মতেই সুখকর ছিল না। লেভ গুমিলিওভের মতে এই উদ্যোগী বা পাসিওনারি মানুষই সমাজের চালিকা শক্তি। সুযোগ পেলে এরাই পারে সমাজ বদলাতে, পারে শত শত মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে। সবাইকে সমান করতে গিয়ে তাই এদের উপরেই নেমে এসেছিল সমাজতন্ত্রের খাড়া। না, এদের হত্যা করা হয়নি। এদের সৃজনশীলতাকে বিভিন্ন ভাবে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপরেও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল এক অভূতপূর্ব এক্সপেরিমেন্ট যা সত্যিকার অর্থেই সমস্ত বিশ্ব ব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছে, পুঁজিবাদকে দিয়েছে কিছুটা হলেও মানবিক রূপ।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যদি সমাজতন্ত্র প্রতিভাকে এতটাই দমন করে রাখে তাহলে সে দেশে বিজ্ঞানের এমন অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটলো কী করে? আসলে এর জন্য আমাদের বুঝতে হবে বিজ্ঞানীদের মনস্তত্ব। এরা কাজ করে কাজের আনন্দে, ম্যাটেরিয়াল লাভের জন্য নয়। যেমন ধরুন কারালিওভের কথা, যিনি ছিলেন সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রামের রূপকার। তাঁকেও কিন্তু অনেক বছর গুলাগে কাটাতে হয়েছে। তার পরেও যখন তাঁকে রকেট টেকনোলোজি এগিয়ে নিতে বলা হয়, তিনি সেটা করেছেন নির্দ্বিধায়। এমন উদাহরণ ভুঁড়ি ভুঁড়ি। নিজের জীবনেই এমন অনেককেই দেখেছি, এখনও দেখছি – যারা কাজ করার সুযোগটাকেই বিরাট পুরস্কার বলে মনে করেন, সেই আনন্দেই কাজ করেন। যার ফলে এই বিজ্ঞানীদের একটা বিরাট অংশ, এমনকি যারা এখন ইউরোপ, আমেরিকায় বাস করছে, এখনও সেই সময়ের কথা, রুটি রুজির চিন্তা না করে বিজ্ঞান চর্চার সুযোগের কথা স্মরণ করেন। এরকম লোক শুধু বিজ্ঞানীদের মধ্যেই নয়, অন্যান্য পেশাতেও দেখা যায়। আসলে সমাজতন্ত্র এদের কাজ করার ন্যুনতম সুযোগ করে দিয়েছিল আর এরাও রাজনীতি বা অন্য কিছুতে মাথা না ঘামিয়ে কাজ করে গেছে। যখনই এরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছে তাদের অবস্থা হয়েছে আন্দ্রেই শাখারভের মত।

যখনই সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়, বলা হয় ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে সমষ্টির কথা। কিন্তু আমার মনে সব সময়ই প্রশ্ন জাগে, এই যে সমাজতন্ত্রের হাত ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় শত ভাগ জনগণ শিক্ষিত হল, তারা কী ব্যক্তি নন? শুধু তাই বা কেন, এই যে আজ পশ্চিমা দুনিয়ায় বিভিন্ন ওয়েলফেয়ার স্টেটের আবির্ভাব – সেটাও কিন্তু সোভিয়েত ব্যবস্থাকে মোকাবেলা করার জন্যই। সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও সভ্যতার ইতিহাসে এক অনন্য ব্যবস্থা বলে মনে করা হয়, এখনও ফিনল্যান্ডসহ অনেক পশ্চিমা দেশ সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থার অনুকরণে নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তাই অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল ব্যর্থতাও। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশ হিসেবে আজ কালের গহ্বরে হারিয়ে গেলেও বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন আঙ্গিকে তা বেঁচে আছে পৃথিবীর আনাচে কানাচে, কোটি মানুষের চিন্তায়। আর এখানেই অক্টোবর বিপ্লবের সার্থকতা। তবে আগে যদি সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলা করার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব এদের ভাল দিকটাই নিজেদের মত করে কার্যকরী করার চেষ্টা করত, বর্তমানে তারা সোভিয়েত আমলের খারাপ দিকগুলোও যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করছে। এখন সেই সোভিয়েত আমলের মত পশ্চিমা বিশ্বেও প্রায়ই কাউকে বিচারের আগেই দোষী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রোপ্যাগান্ডা চালানো হচ্ছে। লোক দেখানো গণতন্ত্র বা জনতার শাসন থাকলেও দেশ বা বিশ্ব শাসন করছে গুটিকয়েক মানুষ বা কর্পোরেশন, যেটা সিপিএসইউ এর পলিটব্যুরোর আধুনিক রূপ। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতই দেশে দেশে বাড়ছে ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা। আগে সেই প্যারেডের কম্যান্ডে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, এখন আমেরিকা।

সরকারি ভাবে কিছু করা না হলেও রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ২০১৭ সালে বিপ্লবের শত বর্ষ পালন করছে বেশ ঘটা করেই আর সেই সুত্র ধরে বিভিন্ন দেশের বাম দলগুলোর সাথে বাংলাদেশ থেকেও প্রতিনিধিরা যোগ দেন সেই উৎসবে। ফলে আমাদেরও সুযোগ হয় অনেক দিন পরে দেশের উচ্চ পর্যায়ের বাম দলের নেতৃত্বের সাথে দেখা করার। আমরা যারা দেশে বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম তাদের অনেকেই মিলিত হই সিপিবি আর ওয়ার্কার্স পার্টির ডেলিগেটদের সাথে এক মত বিনিময় সভায়। এটা ছিল সত্যিকার অর্থেই মত বিনিময় সভা যেখানে সবাই নিজের মতটা প্রকাশ করেছে, অন্যের মত গ্রহণ করার কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। দেশ থেকে আসা ডেলিগেটরা ছিলেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক কমরেড শাহ আলম, সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড দিবালোক সিংহ আর ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। ওনারা প্রথমে আমাদের কথা শুনলেন, আমরা যারা অনেক দিন এ দেশে আছি, যাদের চোখের সামনে ঘটে গেছে এ দেশের যুগান্তকারী পরিবর্তন, যারা রাশিয়ার সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে ফিরে যাওয়ার সাক্ষী তাদের মতামত, তাদের অনুভুতির কথা জানতে চেয়েছেন। একই সাথে মনোযোগ সহকারে শুনেছেন দেশের রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়ন, রাজনীতির সাম্প্রদায়িকরণে আমাদের উৎকণ্ঠার কথা। তারা বলেছেন দেশের বর্তমান রাজনীতির কথা, রুশ দেশে সমাজতন্ত্রের পতনের পর দেশে বাম রাজনীতির সার্বিক পরিস্থিতির কথা। সিপিবির কমরেডরা দৃঢ় গলায় ব্যক্ত করেছেন মার্কসবাদ – লেনিনবাদের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের কথা, সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের কথা। টুটুল দার কণ্ঠে সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের কথা শুনে এক দিকে যেমন খুশি হয়েছি লক্ষ্যের প্রতি তাদের অবিচলতা দেখে তেমনি ভয়ও পেয়েছি। মনে পড়ে গেছে সেই বুড়ো ইহুদীর গল্প। এক বুড়ো ইহুদীকে প্রশ্ন করা হয়

– সুখ কী?
– আমি যে সমাজতান্ত্রিক দেশে জন্ম নিয়েছি, এটাই আমার বড় সুখ।
– আর দুঃখ কী?
– আমার এই সুখই আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ।

হ্যাঁ, কারও একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করলে সেই সুখটা অনেকের জন্য দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যদিও এক সময় তারাও এই আদর্শের জন্য লড়াই করেছিল।

অনেক দিন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, নেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তবে নব্বুইয়ের দশকে এদেশের শাসক শ্রেণীর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে যে বিরোধী মনোভাব ছিল এখন সেটা নেই। ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্রের পজিটিভ দিকগুলোকেও এরা নতুন করে মূল্যায়ন করছে। আসলে যে আশা নিয়ে এরা পশ্চিমা পুঁজিবাদকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল, পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সেই আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে তাদের নিজস্ব পথে হাঁটতে হচ্ছে। ফলে সবার মত তারাও তাদের গৌরবময় অতীতের কথা স্মরণ করছে। লক্ষ্য করার বিষয় যে যে সব দেশই অতীতকে মনে রেখে, অতীতের উপর ভিত্তি করে সামনে চলার চেষ্টা করেছে তারাই এগিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া নব্বুইয়ের দশকে সব কিছু অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে, সর্বোত ভাবে চেষ্টা করেছে অতীত থেকে মুক্তি পেতে, ফলে হারিয়েছে সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন বিজয়কে। আজকে তাদের যে ঘুরে দাঁড়ানো, সেটা কিন্তু সোভিয়েত অতীতকে ঘিরেই। সেদিক থেকে ইউক্রাইন, বাল্টিকের দেশগুলি ক্রমশ অর্থনৈতিকভাবে তলিয়ে যাচ্ছে। সোভিয়েত আমলে সেখানে যে শিল্প ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল সেটা অস্বীকার করার কারণেই হয়তো এটা ঘটেছে। অন্য দিকে ভিয়েতনাম তার সমাজতান্ত্রিক ভিত্তি, বিশেষ করে শতভাগ শিক্ষার উপর দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যাই করুক, অন্তত তার রিপাবলিকগুলোর সার্বিক উন্নয়নে সচেষ্ট ছিল, এদের এরা কখনই উপনিবেশ হিসেবে দেখেনি। আর এ কারণেই অন্যান্য রিপাবলিকগুলো শুধু রাশিয়ার জন্য কাঁচামাল সরবরাহের খনি ছিল না। ভাল লাগুক আর নাই লাগুক কোন দেশের টাইমলাইন থেকে কোন পর্যায় বাদ দেওয়া যায় না, কারণ সেটাও তার বর্তমানে পৌঁছানোর পথে একটা মাইলফলক। সেটা গ্রহণ করে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েই সামনের দিকে এগুতে হবে, সেটা যারা পারে না, তারা আজ হোক কাল হোক – এর জন্য উচ্চ মূল্য দিতে বাধ্য।

সমস্যা হল যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের শুধু ভাল দিকটাই শুনতে চায়, আর যারা বিরোধী তারা খারাপ দিকটাই বলে। কিন্তু বাস্তবতাটা হল সেখানে ভাল মন্দ দুইই ছিল। এক শ্রেণির হাতে সব ক্ষমতা দিয়ে অন্য শ্রেণিকে করেছে নিঃস্ব। পুঁজিবাদও সেটাই করে। পার্থক্য হচ্ছে অনুপাতে, সংখ্যায়। যে সমাজে মানুষকে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়, সেখানে কোন শ্রেণিই অবহেলিত হোক সেটা কাম্য নয়। বলতে পারেন সাম্যবাদ তো শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থায়ই চায়। তাহলে? আবারও সেই কথা – অন্য শ্রেণিকে ধ্বংস করে এক শ্রেণির আধিপত্য স্থাপনের মাধ্যমে শ্রেণিহীন নয়, বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে দূরত্ব ধীরে ধীরে কমিয়ে এনে শ্রেণিহীন সমাজ গড়ার দিকে অগ্রসর হওয়া।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো