মতামত

ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯ প্রসংগে

– ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

১৯৮০ সালে বাংলাদেশ রপ্তানী প্রক্রিয়াকরন অঞ্চল কতৃপক্ষ (BEPZA) গঠিত হয়। ১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম গঠিত হয় চট্টগ্রাম রপ্তানী প্রক্রিয়াকরন অঞ্চল (CEPZ)। বর্তমানে বাংলাদেশে ৮টি সরকারী ইপিজেড এবং ২টি বেসরকারী ইপিজেড আছে। ইপিজেড সমূহে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়োগ, মজুরি, ছুটি, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ইত্যাদি শ্রমমান নিশ্চিত করার জন্য ১৯৮৯ সালে ইপিজেড নির্দেশিকা ১ ও ২ প্রনয়ন করা হয়। ইপিজেড নির্দেশিকা ১ ও ২ পুর্নাংগ আইন ছিলনা। তাই ইপিজেড নির্দেশিকা ১ ও ২ পরিবর্তন করে একটা পুর্নাংগ শ্রম আইন প্রনয়ন খুব জরুরি ছিল। সে প্রয়োজন মিটানোর জন্য বাংলাদেশে শ্রম আইন ২০০৬ এর আদলে ২০১৯ সালে ইপিজেড শ্রম আইন প্রণয়ন করা হয়।
অন্যদিকে শুরুতে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর নানবিধ ত্রুটি বিচ্যুতির কারনে সমালোচনার মুখে পড়েছিল। ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে বড় ধরনের সংশোধনী হওয়া সত্বেও বাংলাদেশ শ্রম আইনের ত্রুটি বিচ্যুতি সমূহ রয়ে গেছে তাই বাংলাদেশ শ্রম আইন নিয়ে সমালোচনার তালিকা এখনো অনেক দীর্ঘ। সে রকম একটি  ত্রুটিপূর্ণ এবং সমালোচিত আইনের আদলে প্রণীত ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯ ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকদের শ্রমমান নিশ্চিত করতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।
ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯ এর ধারা ৪ এ উল্লেখ আছে, ইপিজেডস্থ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকগনের নিয়োগ এবং তৎসংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়াদি এই আইনের বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হবে তবে আইনে প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা হতে বেশি সুবিধা দিয়ে কোন প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করলে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের অনুমোদন সাপেক্ষে শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত নিজস্ব চাকরি বিধিও প্রনয়ন করতে পারবে। অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের আদেশে কেউ সংক্ষুদ্ধ হলে ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাহী চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করা যাবে এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান ৪৫ দিনের মধ্যে তার সিদ্ধান্ত জানাবেন। কিন্তু নির্বাহী চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে এবং তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আপীল করা যাবেনা। এভাবে কোন ব্যক্তিকে একক ক্ষমতা দিয়ে আইন প্রনয়ন গনতন্ত্র ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থী।
ধারা ১২(২) বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩ ধারার অনুরূপ। এ ধারাটিতে উল্লেখ আছে, কোনো শাখা বা বিভাগের বেআইনি ধর্মঘটের কারণে প্রতিষ্ঠানের অন্য কোনো শাখা বা বিভাগও যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং উহা চালু রাখা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে উক্ত শাখা বা বিভাগও বন্ধ করে দেয়া যাবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকগণকে ৩ দিন পর্যন্ত লে-অফ এর নিয়মে প্রদেয় ক্ষতিপূরণের সমপরিমাণ মজুরি প্রদান করতে হবে, তবে ৩ দিনের অতিরিক্ত সময়ের জন্য তারা আর কোনো মজুরি নাও পেতে পারেন। এই ধারাটির মাধ্যমে কোন প্রতিষ্ঠানের এক বিভাগের শ্রমিকদের অপকর্মের দায়ভার অন্য বিভাগের শ্রমিকদের উপর চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হল। তাছাড়া কোন মালিক তার কারখানা বন্ধ করে দিতে চাইলে যেকোন ঠুনকো অজুহাতে কারখানা বন্ধ করে দেয়ার জন্য তাকে সুযোগ করে দেয়া হল। এই আইনের ২২ ধারায় কোন কারন ছাড়াই যেকোন শ্রমিককে কারখানা থেকে বিতারনের অসীম ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে যা বাংলাদেশ শ্রম আইনের ২৬ ধারার অনুরুপ হলেও ধারা ৩৩ এ ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের যে ন্যুনতম সুরক্ষা দেয়া হয়েছে ইপিজেড শ্রম আইনে তাও দেয়া হয়নি। এ আইনের ১৯, ২০ এবং ২১ ধারায় শ্রমিক অতিরিক্ততার কারনে ছাঁটাই, শ্রমিকের শারীরিক অক্ষমতার কারনে ডিসচার্জ এবং শৃংখলা ভংগের কারনে বরখাস্ত বা অপসারন করার সুযোগ থাকা সত্বেও ২২ ধারায় কোন কারন ছাড়া শ্রমিকের চাকুরির অবসানের সযোগ থাকা উচিৎ নয় বলে আমি মনে করি।
৩৪ ধারার শিরোনাম “কতিপয় ক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিকের চাকরির অবসানে বাধা” লিখা থাকলেও বাস্তবে ৩৪ ধারার মাধ্যমে প্রসূতি নারী শ্রমিকদের প্রসূতিকালীন চাকুরি অবসানে বাধার বিষয়টি খুব জোরালোভাবে উপস্থাপিত হয়নি। ৩৬ ধারায় বাধ্যতামূলক বিমার কথা বলা হলেও বিমার পরিমান ও পরিধি স্পষ্ট করা হয়নি। ফলে একজন শ্রমিক মারা গেলে কত টাকা বিমা সুবিধা পাবেন এবং আহত হয়ে সম্পূর্ণ বা আংশিক পংগু হলে ভূক্তভোগি শ্রমিক আদৌ বিমা সুবিধা পাবেন কিনা তাও অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
ইপিজেড নির্দেশিকা-১ এর ৩৬ ধারায় টার্মিনেটেড শ্রমিকদের টার্মিনেশন হওয়ার তারিখ হতে ৭ দিনের মধ্যে চ’ড়ান্ত হিসাবের টাকা পরিশোধের কথা উল্লেখ আছে অন্যদিকে ইপিজেড শ্রম আইনের ৫৬ ধারায় “মজুরি পরিশোধের সময়” শিরোনাম দিয়ে অবসর গ্রহণ, ছাঁটাই, ডিসচার্জ, বরখাস্ত বা চাকরির অবসান, ইত্যাদি যে কোনো কারণে শ্রমিকের চাকরির অবসান ঘটবার পরবর্তী ১৫ (পনেরো) কর্মদিবসের মধ্যে উক্ত শ্রমিকের সকল পাওনা পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ চ’ড়ান্ত হিসাবের টাকা পরিশোধে পূর্বের তুলনায় সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। যা বিদ্যমান সুবিধা কমিয়ে দেয়ার নামান্তর। সাধারনত বিদ্যমান সুবিধার কম সুবিধা দিয়ে কোন আইন পরিবর্তন বা সংশোধন করা আইন এবং প্রথা বিরোধী।
ধারা ৯৪(৬) এ উল্লেখ আছে, পৃথক নিগমিতকরণ সনদসহ (Certificate of Incorporate) কোম্পানি হিসাবে নিবন্ধিত কোনো মালিক কোনো জোনে কার্যরত থাকলে উক্ত জোনে উক্ত কোম্পানির অধীন একটি শ্রমিক কল্যাণ সমিতি থাকবে এবং কোম্পানি হিসাবে নিবন্ধিত একই মালিকের অধীন কোনো জোনে ২ (দুই) বা ততোধিক শিল্প ইউনিট থাকলে উহারা এই ধারার উদ্দেশ্যপূরণকল্পে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য হবে। এই ধারাটি একাধিক ইউনিটের মালিকের প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। ১১৩(১) ধারায় উল্লেখ আছে, কোনো এলাকায় গঠিত শ্রমিক কল্যাণ সমিতিসমূহের ৫০% (পঞ্চাশ শতাংশ) এর অধিক শ্রমিক কল্যাণ সমিতি সম্মত হলে, উহারা উক্ত এলাকায় শ্রমিক কল্যাণ সমিতিসমূহের একটি ফেডারেশন গঠন করতে পারবে। যেখানে ইপিজেডের বাইরে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ২ বিভাগের ৫টি বেসিক ইউনিয়নের সমন্বয়ে সেক্টর ফেডারেশন এবং ২০টি বেসিক ইউনিয়নের সমন্বয়ে জাতীয় ফেডারেশন করা যায় সেখানে ইপিজেডের ভিতরে ফেডারেশন গঠনের জন্য ৫০% (পঞ্চাশ শতাংশ) এর অধিক শ্রমিক কল্যাণ সমিতির সম্মতির শর্ত যুক্ত করে ফেডারেশন গঠনে প্রতিবন্ধকতা এবং নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। আবার ১১৩(৩)ধারায় “কোনো এলাকায় গঠিত কোনো শ্রমিক কল্যাণ সমিতির ফেডারেশন অন্য কোনো এলাকার ফেডারেশন অথবা এলাকা বহির্ভূত অন্য কোনো ফেডারেশনের সহিত অধিভুক্ত হতে কিংবা অন্য কোনো প্রকারের সংযোগ রক্ষা করতে পারবে না” শর্ত যুক্ত করায় ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ এবং আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ এর সাথে সাংঘর্ষিক।
ইপিজেড সমূহের বাইরে কর্মরত প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং রপ্তানীমুখি পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জন্য শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল এবং কেন্দ্রীয় তহবিল গঠিত হলেও ইপিজেড সমূহে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য কোন কল্যাণমূলক তহবিল আছে কিনা তার কোন তথ্য জানা নেই অথচ ইপিজেড শ্রম আইনের পঞ্চদশ অধ্যায়ে মালিক-ক্রেতা-শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিলের কথা উল্লেখ আছে।
জাতিসংঘ ২০১৬ সাল হতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়কালকে টেকসই উন্ন্য়ন লক্ষমাত্রা (SDA) অর্জনের জন্য নির্ধারন করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৮ নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে শোভন কাজ। তাই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে শোভন কাজ আন্তর্জাতিকভাবে সর্বজন গ্রহনযোগ্য মাণদন্ড। শোভন কাজ বাস্তবায়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমমাণ অনুসারে জীবনধারনের মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত বিকাশ ও বাক স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত হওয়া জরুরি। ইপিজেড শ্রম আইনে উপরোক্ত চিহ্নিত ত্রুটি সমূহ দ্রুত সংশোধন করে শোভন কাজ বাস্তবায়নে রাষ্ট্র উদ্যোগী হবে এমনটিই প্রত্যাশা।

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি