মতামত

মোঃ ফরহাদ কিভাবে ‘মোঃ ফরহাদ’ হলেন? (৩য় পর্ব)

-এম. এম. আকাশ

মোঃ ফরফাদ (ফাইল ছবি)

রণকৌশলবিদ কমরেড ফরহাদ

কমরেড ফরহাদকে আমি একজন “Great Strategist” (মহৎ রণকৌশলবিদ) হিসাবে অভিহিত করেছি। এর অজস্র রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। অনেকে তাঁর এ ধরণের উজ্জ্বল ভূমিকার জন্য নানারকম উপাধিও তাঁকে দিয়েছেন। তাঁর ভক্ত ছাত্র নেতৃবৃন্দ প্রায়ই তাকে “৬২-র ছাত্র আন্দোলনের মস্তিষ্ক” হিসাবে অভিহিত করে থাকেন! তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী কমরেড নুরুল ইসলাম কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্বে থাকাকালে তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু দেখেছেন এবং শিখেছেন বলে স্বীকার করে নিয়ে লিখেছেন,
“পার্টির সদস্য বৃদ্ধি, জনগণের মধ্যে পার্টিকে প্রসারিত করার ধারণা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য সমগ্র পার্টিকে ঐক্যবদ্ধভাবে নামানো সহজ কাজ ছিল না। অতীতের অবস্থার সাথে পার্থক্য উপলব্ধি এবং নতুন অবস্থায় পার্টির প্রসার ঘটানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ ফরহাদের ভূমিকা ও অবদান পার্টির বিকাশের ধারার সাথে অবিচ্ছেদ্য। আন্দোলনের পটভূমিতে যে হাজার হাজার মানুষ পার্টির পক্ষে সমবেত হচ্ছেন তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে প্রভাবিত করা এবং কোন ধরণের সাংগঠনিক প্রভাবে আনার জন্য ” গনগ্রুপ গঠন ও গনক্লাস” চালুর সুস্পষ্ট ধারণা মোহাম্মদ ফরহাদের সৃজনশীল সাংগঠনিক কাজের এক বিশেষ দৃষ্টান্ত”। [মোঃ নুরুল ইসলাম, “পার্টির সংগঠক মোঃ ফরহাদ”, প্রাগুক্ত, ১৯৮৮, পৃ:-৮৮]

সৃজনশীল গণ-লাইন ছাড়াও, “টেবিল টকেও” বিরোধী রাজনৈতিক ধারাগুলির সঙ্গে আলোচনাকালে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন মোহাম্মদ ফরহাদ। অকমিউনিস্টরা অনেকেই সে জন্য তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর এমনি একটি লেখায় দৈনিক খবরের সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান লিখেছেন,
“বিপ্লবী পুরুষ কমরেড ফরহাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল পাঁচ দফা আন্দোলন ও পনের দলীয় জোট। এখানে “ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর” হিসাবে তার অবদান তুলনাহীন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে ‘সুষম ভারসাম্য’ বজায় রাখার দুরূহ ভূমিকাটি যে বিশাল ব্যক্তিত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি কমরেড ফরহাদ”। [মিজানুর রহমান মিজান, শ্রদ্ধার সাথে মনে রাখবো, প্রাগুক্ত, ১৯৮৮, পৃ:- ৬০]

এবার আমার নিজের একটি সামান্য অভিজ্ঞতার দৃষ্টান্ত দিতে চাই। বিপ্লবের প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল। শুধু ভারসাম্য রক্ষা করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিলেই চলবে না, পাশাপাশি বামপন্থীদের পক্ষে শক্তির ভারসাম্যও বদলাতে হবে, ক্ষমতায় এবং নেতৃত্বে বামপন্থীদের অধিষ্ঠিত হতে হবে। সেটা ছাড়া বুর্জোয়া নেতৃত্বে বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল কর্তব্যগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, আপোষের চোরাবালিতে আটকে যাবে লেনিনের এই তত্ত¡টি প্রথম ভালভাবে আমি বোঝার সুযোগ পাই আমাদের পার্টির চতুর্থ কংগ্রেসের প্রাক্কালে পার্টির অর্থনীতি বিভাগের সদস্য হিসাবে মোঃ ফরহাদের সঙ্গে নানা আলোচনার সূত্রে। সে জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। এই সময়ই পার্টির চতুর্থ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই চতুর্থ কংগ্রেসেই আমাদের পার্টি প্রথম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে বিপ্লবী মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশের বুর্জোয়া গণতন্ত্র সংকটহীন বা সংহত আকার ধারণ করতে পারবে না। চতুর্থ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টের শেষ প্রান্তে এসে এই শিক্ষাটি চমৎকার ভাবে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন মোহাম্মদ ফরহাদ। তিনি লিখেছেন,
“সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সামনে যে মূল্যবান রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাটি এ সময়ে আরেকবার উপস্থিত হয়েছে তা হলো এদেশে গণতন্ত্র অর্জন ও তাকে স্থায়ী করার বিষয়টি সমাজ বিপ্লবের প্রশ্নের সাথেই জড়িত হয়ে গেছে।” [বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ কংগ্রেস, ১৯৮৭, ঢাকা, পৃ:- ১০৮]
সেই সময় এই বিশেষ ইস্যুতে আমাদের পার্টির “অর্থনীতি বিভাগে” কিছু বিতর্ক উপস্থিত হয়েছিল। মোহাম্মদ ফরহাদ বারে বারে আমাদেরকে যে প্রশ্নটি করতেন তা হচ্ছে জাতীয় বুর্জোয়ারা কি সাম্রাজ্যবাদের বিশেষ ‘কনসেশান’ নিয়ে এ দেশে মোটামুটি একটি স্থায়ী বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও স্থিতিশীল পুঁজিবাদ কায়েম করে ফেলতে সক্ষম হবেন? এর উত্তর দিতে গিয়ে আমাদের সাধারণ অভিমত ছিল যে সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল পুঁজিবাদের ধারা দেশের জনগণের সমস্যার যে ঘনীভবন ঘটাবে তাতে বিপ্লবী আন্দোলন উচ্চমাত্রায় বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা এ দেশে থাকবে। পার্টি যদি তা ব্যবহার করতে পারে তাহলে গণতন্ত্রের ইস্যুটি বিপ্লবের মাধ্যমে মিমাংসিত হবে। আর তা না হলে এ দেশে গণতন্ত্রের মাধ্যমে বেশিদিন নির্ভরশীল পুঁজিবাদী ধারা অগ্রসর হতে পারবে না এবং দেশে কখনো গণতন্ত্র, কখনো সামরিক শাসন বারে বারে পুনরাবৃত্ত হতে থাকবে। এইভাবে দেশের অসমাপ্ত জাতীয় বিকাশের কর্তব্য বহুদিন পর্যন্ত বাম নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক বিকল্পের অভাবে অসমাপ্তই থেকে যাবে। মোঃ ফরহাদ সহ তদানীন্তন পার্টি নেতৃবৃন্দ আমাদের এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি প্রায়ই আমাকে বলতেন “দেখুন কমরেড, আপনাদের কথা মত কিন্তু আমরা গণতন্ত্রকে বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত করে দিচ্ছ ঠিক আছে তো?” তার এই কথার মধ্যে দুর্বলতা ছিল না। ছিল এই লাইনের পেছনে অর্থনৈতিক যুক্তি ভিত্তিগুলি বারে বারে নিরন্তর যাঁচাই করে নেওয়ার তীক্ষ্ণ সতর্ক প্রজ্ঞা। চতুর্থ কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে (যা রচনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কমরেড মতিউর রহমানের নেতৃত্বে আমার কতিপয় তরুণ বন্ধু) তাই লেখা হয়েছিল,
“সমাজতন্ত্র অভিমুখিন জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতি সামনে রেখে পার্টির আশু করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। নিজেদের আধিপত্য ও শোষণ বজায় রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন উপায়ে আমাদের দেশে নির্ভরশীল পুঁজিবাদের যে ধারা প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট রয়েছে, তা বিবেচনায় রেখেই কমিউনিস্ট পার্টিকে নি:সন্দেহে তার বর্তমান রাজনীতি নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ এই সমস্যাকে অতিক্রম করে সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশে পুঁজিবাদী রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে শেষাবধি একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে, না কি তার আগেই এই রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় যে সব শ্রেণীদ্বন্দ ও সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে সেগুলিকে সঠিক রাজনৈতিক খাতে প্রবাহিত করে দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিকে সাথে নিয়ে বামপন্থী শক্তিসমূহ একটি কার্যকর বিকল্পে পরিণত হবে। এর উপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারা! সে জন্য বিপ্লবের বিষয়ীগত উপাদানই গড়ে তোলার উপর পার্টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে। তবে বিপ্লবের উপযুক্ত বিষয়ীগত উপাদান গড়ে তোলা সহজ নয়। নানা ঐতিহাসিক কারণে এ পথে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। এ শক্তি ব্যতীত বিপ্লব হয় না, সমাজবিপ্লব ব্যতীত আকাংখিত গণতন্ত্র অর্জিত হবে না। তাই, এই শক্তির অনুপস্থিতিতে বিদ্যমান রাজনৈতিক শূন্যতা ও অস্থিতিশীলতা টিকে থাকার অর্থাৎ “সীমিত গণতন্ত্র” কিংবা বিভিন্ন মাত্রার প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরশাসনের আশংকা থেকে যাচ্ছে।” [বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ কংগ্রেস, ১৯৮৭,পৃ: ২৩]
এই বিপ্লবী দলিলটি গ্রহণের পর বেশিদিন মোহাম্মদ ফরহাদ জীবিত ছিলেন না। ১৯৮৭ সালের ৭ই এপ্রিল আমাদের গৌরবদীপ্ত চতুর্থ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। আর তার মাত্র ৬ মাস পর ১৯৮৭ সালের ৯ই অক্টোবর তারিখে মস্কোর নিউ অক্টোবর হোটেলে মোঃ ফরহাদের মৃত্যু হয়। “আকণ্ঠ বিপ্লব পিপাসা” নিয়েই তিনি মুত্যৃ বরণ করেন।

কিন্তু আমি নিশ্চিত যে মৃত্যুর শেষ মুহুর্তেও তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন কিভাবে কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিকে বাড়িয়ে গণতন্ত্রের সংগ্রামকে বিপ্লবী ধারায় বিকশিত করার সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করা যায়। এই চিন্তাটাই কংগ্রেসের পর থেকে তাঁকে সমসময় নাড়া দিত। তিনি ভাবতেন কিভাবে জেলা থেকে প্রতিটি ইউনিয়নে পার্টিকে প্রসারিত করা যায়। তিনি একজন সুদক্ষ জেনারেলের মত কল্পনা করতেন বঙ্গভবনের বাবুর্চিখানা থেকে শুরু করে সেক্রেটারিয়েট থেকে, রাষ্ট্রযন্ত্রের আনাচে-কানাচে থেকে, কল-কালখানায় সর্বত্রই কি ভাবে পার্টির অবস্থান নিশ্চিত করে সুড়ঙ্গ যুদ্ধ (Trench War) গড়ে তোলা যায়। কিভাবে ঠিক লোকটিকে ঠিক জায়গায় বসানো যায়। কার কাছ থেকে কতটুকু প্রত্যাশা করা যায় সেই হিসাবটা ছিল তাঁর নিখুঁত এবং তার কাছ থেকে ঠিক ততটুকু আদায় করে নেওয়ার দক্ষতাও ছিল তার অপরিসীম। এ জন্যই তার আমলে ক্ষেতমজুর, শ্রমিক, কর্মচারী, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুবক, মহিলা, জাতীয় বুর্জোয়া ইত্যাদি সকল ফ্রন্টেই পার্টির একটি সুপরিকল্পিত বিকাশের সূচনা হয়েছিল। তাঁর এই অতুলনীয় সাংগঠনিক প্রতিভার শেষ একটি উদাহরণ দিয়ে “রণকৌশলবিদ মোঃ ফরহাদ” অধ্যায়টি শেষ করতে চাই। এই বিষয়টি একজন প্রকৃত সামরিক পেশাজীবীর স্মৃতিচারণ থেকে আমি উধৃত করছি। সামরিক পেশাজীবী নৌবাহিনীর কমোডর আব্দুর রউফ ছিলেন ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা বাহিনীর সামরিক শাখার অন্যতম পরিকল্পক। তিনি মোহাম্মদ ফরহাদের সঙ্গে একত্রে আমাদের গেরিলাবাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে পরিচালনা করেছেন। তিনি মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যুর পর লিখেছেন,
“ ৭১ সালের মার্চে যে সময়ে সমগ্র বাংলাদেশ জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের আকাক্সক্ষায় টালমাটাল তখন কয়েকটা গুরুতর বিষয়ে আলাপ করার জন্যে আমাকে ‘ছোটলোক’ সাহেব একবার ঢাকায় ডেকে পাঠান। পাক সামরিক বাহিনীর আসন্ন আক্রমণের মুখে কি করে ঢাকা শহরে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় সেটাই ছিল আলোচনার বিষয়। ঢাকা শহরের বিস্তারিত একটি মানচিত্র মেলে ধরে সম্ভাব্য আক্রমণের এবং প্রতিরোধের খুঁটিনাটি বিষয়সমূহ তিনি আলাপ করেছিলেন। সশস্ত্র প্রতিরোধ সম্পর্কে তাঁর অধ্যয়নের গভীরতা, বাস্তবতার সঠিক উপলব্ধি এবং প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। কেন জানি আমার মনে হয়েছিল এ লোকটিই একদিন এ অভাগা দেশের রাজনীতিতে দক্ষ ও কার্যকর নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারবে।” [আবদুর রউফ, “ছোটলোক সাহেব”. প্রাগুক্ত, ১৯৮৮, পৃ:- ৩৯]

লেখকঃ রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশেবিদ্যালয়

পড়ুনঃ মোঃ ফরহাদ কিভাবে ‘মোঃ ফরহাদ’ হলেন? (২য় পর্ব)