শিল্প সাহিত্য

পাহাড়ের শব্দ  

-শাহীন আকতার হামিদ

চারিদিকে সন্ধ্যা নেমেছে আমরা ছুটে চলছি মহাল ছড়ির দিকে।  মামাত বোন শিলাকে ফোন করে বললাম  আমি যদি ফিরি ভাল না ফিরলে সব দায়িত্ব তোর, দেখে রাখিস আমার যা আছে। গভীর  জঙ্গলে যাবো, ফোনে কথা বলতে পারবো না হয়তো।

সুনসান রাস্তায় ছুটে চলছি। কখনও পাহাড়ে  উঠছি  কখনও নীচে  নামছি।  গভীর রাতে আমরা পৌঁছুলাম মহালছড়ি উপজেলা রাস্তার  কাছে। ড্রাইভার বলল ম্যাডাম আপনার তাবুটা দিন আমরা এখানেই কোথাও ঘুমাবো। ওরা আমাকে পাউরুটি, কলা ও ফ্লাস্কে করে আনা চা দিল। জীপটা উপজেলায় যাওয়ার রাস্তার  একপাশে রাখল যাতে গাছের আড়ালে সবুজ জীপটি চোখে না পরে।  বললাম তোমরা কোথায় ঘুমোবে? ওরা উত্তর দিল আপনি গাড়িতে আমরা  তাবুতে, আগে মশা মারার ঔষধ দিয়ে নিন।  এখানকার মশা গুলো অনেক বড় বড় ম্যাডাম, কামড়ালে জ্বর হবে।

ভাবলাম এ লোকদুট আমাকে মেরেও ফেলতে পারে, কিন্তু কি যত্ন করে সব  কিছু করছে, ওদের তুলনা ওরাই। বললাম ইঞ্জিন বন্ধ করে দাও, গাড়ী অনেক ঠান্ডা আমার এসি লাগবে না। ওরা খাবার নিয়ে তাবুতে গেল, আমি গাড়িতে ঘুমালাম।

মোরগের ডাকে ঘুম ভাংল। ভাবলাম বনমোরগ হবে। আবোল তাবল ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভেঙ্গে দেখি ইঞ্জিন ও এসি চলছে। জানলা  দিয়ে তাকিয়ে দেখি ড্রাইভার ও কুক আরো কয়েকজন মোল্লা মত লোকের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

আমি জীপ থেকে নেমে আসলাম। একটি লোক এসে বললেন, ম্যাডাম চলেন আমার বাড়িতে, চা নাস্তা খেয়ে তারপর দুপুরের ভাত খাবেন। আমি বললাম আপনি কে? আমি এখানকার এ গ্রামের মেম্বার।  বললাম ওরা আপনাকে কোথায় পেল? ওরা রাস্তার পাশে বসে গল্প করছিল, আমি একটা কাজে যাচ্ছিলাম উপজেলায়। এ গ্রামের সবাইকে আমি চিনি, তাই বললাম আপনারা কোথা থেকে এসেছেন। ওরা আপনার কথা বলল, আপনি  বেড়াতে বেড়িয়েছেন পার্বত্য এলাকায় এবং এভাবেই আপনি গাড়িতে থাকেন ওরা গাড়ির কাছাকাছি তাবুতে থাকে।

আমি ভাবলাম, এ লোকের  মাথায় কত বুদ্ধি। কি সুন্দর করে কথাগুল বানিয়ে বলল।  বলল পিছন দিকে তাকিয়ে দেখুন এটাই আমার বাড়ী।

বললাম আপনার মোরগ আছে, তাইতো ডাক শুনছিলাম।

আসেন আজ সেটাই আপনাকে জবাই করে খাওয়াবো।

আমি বললাম না চা খেয়েই চলে যাই আমি মহালছড়ি লেক দেখতে চাই। সে বলল আপনার জন্য গেস্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা করে দিব, আপনি মন ভরে মহালছড়ি ঘুড়ে  দেখবেন। এখানে বেশি জংলী নেই।

আমি বললাম জংলী কারা, ওইযে  পাহাড়িগুলা।

রাগ হল, কিন্তু  কিছু বললাম না। ভাবলাম তোমার কথার এই ছিরি বাবাধন, না জানি মানুষগুলোর  উপর কি অত্যাচার চালাচ্ছ। আমার গেষ্ট হাউজ লাগবে না। তার কথা বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল, আমি খুব বিরক্ত হচ্ছিলাম।

দেখলাম এ লোকের পাকা বাড়ি, বাথরুমের সব ব্যবস্থা ভিতরে। খাবার  খেতে খেতে জানতে চাইলাম আপনাদের আদি বাড়ি কোথায়? বলল নোয়াখালী।  আমরা  একগ্রাম থেকে প্রায় ২০০ ঘর এখানে এসেছি। নদীতে সব ভেঙ্গে গেছে তাই। সরকার যা দিয়েছিল তা অল্পই ছিল বাকিটা আমি কিনে নিয়েছি। মনে মনে বললাম না বাকিটা তোমরা ছিনিয়ে নিয়েছ তা আমি জানি।

মহালছড়ির লেকের কাছাকাছি একটি জায়গায় এসে গাড়ি থামালাম। ড্রাইভার বলল ম্যাডাম আমি যতটা পারি লেকের কাছাকাছি যাবো, আপনার গাড়ি থেকে নামার দরকার নেই।  এখানে জোঁকের খুব উপদ্রব। মহালছড়ি উপজেলায় যেতে পথেই পরে লেক। চারিদিকে পানি, পাশ ঘেষে রাস্তা। মনটা ভরে গেল। ভুলে  গেলাম বাড়ির কথা, ভুলে গেলাম আফ্রিকায় বেড়াতে গিয়ে মা, বাবা , ভাই বোন সবাইকে হারিয়ে ফেলার কথা। কষ্টগুলো মন থেকে হাওয়াই মিলিয়ে গেল।

এখানে বেশ ঘনবসতি, তাই ড্রাইভারকে বললাম আর একটু ভিতরে যেতে।  আমরা যে দিকেই রাস্তা পাচ্ছিলাম সে দিকেই যাচ্ছিলাম।  যেতে যেতে পেয়ে গেলাম হাসপাতাল রোড। যে দিকেই যাই শুধু পানি আর গাছ। পথে মাঝে মাঝে কিছু লোকের দেখা মিলছে। মনে হলনা এরা কেউ খুব খারাপ। শান্তিপ্রিয় মানুষ, সভ্যতার ছোয়া বেশি লাগেনি। এদিকে বেশিরভাগই  পাহাড়ি মানুষ, সমতলের মানুষদের মত এদের চোখে মুখে অতি চালাকি ভাব নেই। আমরা হাসপাতালের মধ্যে গাড়ি রেখে  কিছুটা হাঁটলাম। হাসপাতালটার ভিতরে ঘুরে দেখলাম।   কিছুই তেমন  নেই, একটা প্রেসার মাপার যন্ত্র ছাড়া। একজন ডাক্তার, একজন নার্স, কয়েকজন আয়া।

ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। ভাল মানুষ মনে হল। বলল পাহাড়িদের  সব  অজানা রোগ, ধরতে পারিনা। বললাম আপনারতো কিছু নেই, কি দিয়ে  রোগ  ধরবেন। বলল তাও ঠিক আপা। বললাম আমার জানামতে একজন লোক আছে যে হাসপাতালে যন্ত্রপাতি দেয়, আমাকে একটা লিষ্ট দিন। দেখি কি করতে পারি।  বলল টাকা দিবেনা ।   বললাম দেখি কি করা যায়। আজ রাতে তার বাড়িতে খেতে বলল।  বললাম আপনি আমাদের এ হাসপাতালের মধ্যেই  রাতের থাকার  ব্যবস্থা করতে পারবেন? কাল চলে যাব। ডাক্তার  একা থাকে, বউবাচ্চা চট্টগ্রামে। বলল আমার বাসায় থাকেন, আমরা রাজি হয়ে গেলাম। আমি মহালছড়ির লেকের এ বিকালটা হারাতে চাইনা।

বিকালে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। আমি গাড়ি থেকে নামলাম না। আমার  ড্রাইভার আকাবাক কাঁচা রাস্তা দিয়ে  জীপ অনেকদূর চালিয়ে নিয়ে এল। সবুজ পানির উপরে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে   কিচিরমিচির করে যাচ্ছে। এ এক অপার্থিব জায়গা। আমাদের জীপটা একটু   গাছের পাতার আড়ালে থাকলে তাকে আর চেনা যায়না। আমি এক স্বপ্নের মধ্য  দিয়ে যাচ্ছি। এরকম একটা জায়গায় জন্মালে কি এমন ক্ষতি হত। আহা জীবন কত সহজ এখানে। কাঠের, বাঁশের আটি মাথায় ছেলেমেয়ে ঘরে ফিরছে, কারো সাথে গরু বা ছাগল আছে। কেউ কেউ হাঁস নিয়ে যাচ্ছে। দু’একজনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম, বাংলা বুঝতে পারে মনে হলনা।  মনে হচ্ছে ওরা এতেই অভ্যস্ত। জীবন আসলে অভ্যাসের বিষয়।

আমরা মহালছড়ি বাজারে গিয়ে দেখি সন্ধ্যায় জমজমাট বাজার তবে বেশ  নোংরা। আমার নামতে ইচ্ছা হলনা। ধুলা ও কাঁদা রাস্তায় খোলাখুলি অনেক কিছু   বিক্রি হচ্ছে। মেয়েদের বোরখা থেকে ব্রা পর্যন্ত সবই খোলা জায়গায় বিক্রি করছে। গুড় মুড়ি সবই ঢাকনা ছাড়া, ভন ভন করে মাছি উড়ছে। দেখে কেমন যেন খারাপ লাগল। ড্রাইভারকে বললাম চল হাসপাতালে চলে যাই।

রাতে হাসপাতালের ডাক্তারের বাসায় ফিরে দেখি বেশ কয়েকজন লোক বসে  আছে। এরমধ্যে সেই মেম্বারও আছে। বললাম কেমন আছেন। বলল আপা এখানেই ভাল হল আমাদের ডাক্তার সাহেব খুব ভাল মানুষ। কয়েক বছর ধরে  এখানে থাকেন। আপনাকে খাওয়াবে তাই আমাদের ও দাওয়াত করলেন। মেম্বার একজনকে দেখিয়ে বললেন আমাদের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। দেখলাম ইনিও বাঙ্গালী। বুঝলাম এ মহালছড়ি বাংগালিদের অধিকারেই চলে গেছে।

আমাকে বেশ বড় একটা ঘরে থাকতে দেয়া হল। বললাম আমার ড্রাইভার ও  কুক কোথায় থাকবে। জানালো ওরা সামনের একটা ঘরে থাকবে। আপনি ভয় পাবেন  না। আমার কাজ করে দেয় যে চাকমা মেয়েটি সে আপনার ঘরে মাটিতে বিছানা  করে থাকবে। বললাম ওর বাড়ি কোথায়? বলল আর একটু ভিতর দিকে। এখানে  অনেক কাজের মেয়ে পাওয়া যায়। আপনার লাগলে বলেন। বললাম বাচ্চা মেয়ে  নয় একটু বয়স্ক, যেমন আমার বয়সি হলে ভাল হয়, কাজ তেমন নয়, শুধু  আমার সাথে থাকবে। বলল যে মেয়েটা আসবে তার সাথে কথা বলে দেখবেন এরকম অনেক পাওয়া যায়।

রাতে আমার কাছে ঘুমাতে আসল ফুটফুটে সুন্দর আঠার উনিশ বছরের একটি মেয়ে। বললাম তুমি ডাক্তার সাহেবের বাসায় কাজ কর, বলল হ্যা আমার মা  হাসপাতালের আয়া। আমি ডাক্তার সাহেবের ভাত রান্না করি। আজ আমার মা সব রান্না করে দিয়েছে। বললাম তুমি রাতে এখানে থাক, বলল হ্যা মাঝে মাঝে ডাক্তার আমাকে যেতে দেয়না, তখন থাকি। তানা হলে মা আর আমি বরপুলে নানার বাড়ি চলে যাই সন্ধ্যাবেলা। বললাম বাংলা কিভাবে শিখলে, বলে আমি স্কুলে পড়েছি। দেখি একটা মোবাইলে কার সাথে যেন কথা বলল। আমায় বলল একটু আসি,   ডাক্তার তার ঘরে যেতে বলেছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ  মেয়েটার কোন খবর নেই, আমি ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে উঠে দেখি মেয়েটা মাটিতে ঘুমিয়ে আছে। বললাম সেকি তুমি মাটিতে শুয়ে কেন, বলল না উঠে যাব,  আপনাদের নাস্তা দিবো, তাকে খুব ক্লান্ত মনে হল। আমার মশারি খুলে বলল শুয়ে থাকেন আমি চা নিয়ে আসি। চা দিতে আসাতে দেখলাম তার হাতের উপরটা ও গলায় নীল হয়ে রক্ত জমে আছে।

 

বললাম তোমার বাড়িতে কি কেউ আছে যে আমার বাসায় যেতে পারবে,  আসলে এই আমার সাথে থাকবে, আমি যেখানে যাব সেখানে যাবে। মেয়েটা বলল আমায় নিবেন, আমি যাব। আমার এ জীবন ভাল লাগেনা। বললাম খুলে বল ঘটনা কি।

বলল,   মা অনেকদিন থেকে এ হাসপাতালে কাজ করে, আমি তখন ছোট, আমার বাবা  নেই। আমরা নানাবাড়ি থাকি। একদিন মা আমাকে এখানে এনে কাজে দিল। সাত বছর আগে মা আমাকে ডাক্তারের বাসায় কাজে দিল। প্রথম প্রথম মা ও থাকত আমার সাথে। এরপর মা আমাকে রেখে চলে যেত। বললাম তোমার  মায়ের বয়স কত বলল পয়ত্রিশ হবে, তোমার কত । বলে পনের। দেখতে মনে হয় আর একটু  বড় লাগে।  ডাক্তার দারু খেয়ে আমার উপর অত্যাচার করে, কাল রাতেও তাই করেছে।  মা অনেক কেঁদেছে, ডাক্তার বলেছে মাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিবে  ও আমাকে আর্মীদের কাছে দিয়ে দিবে, এরকম ভয় সে প্রায় দেখায়। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম একজন শিক্ষিত লোকের অধঃপতন দেখে। বললাম  যাও নাস্তা বানাও,   আমাকে এসব বলেছ কাউকে বলবেনা। নাস্তা বানিয়ে  আমাদের  খাইয়ে তুমি তোমার মাকে নিয়ে উপজেলার রাস্তায় কোথাও দাঁড়িয়ে  থেক। সাথে কিছু নিবেনা। মাকে বল আমি বলেছি তোমাদের সাথে কথা বলব।

ডাক্তার বেশ খুশী মনে নাস্তা খেলেন আমাদের সাথে। বললেন সীমা তোর  খালাকে ডেকে নিয়ে আয় ম্যাডামের সাথে যাবে। সীমা বলল স্যার মাকে ছুটি দিন একা যেতে ভয় করে। বললাম ও ওর মাকে আগে ডেকে নিয়ে আসুক।  আমি মহালছড়ির আশপাশ ঘুড়ে দেখি, ওরা মা মেয়ে গিয়ে লোক নিয়ে  আসুক। বললাম সীমা তোর ফোন নাম্বারটা আমায় দে, দেরি হলে ফোন করব।  ডাক্তার সাহেব কে বললাম আমি ওদের কিছু টাকা দিতে চাই, এতো কষ্ট করে গ্রামে যাবে এ পাহাড় ভেঙ্গে। খুশি হয়ে ডাক্তার বললেন দিন ম্যাডাম দিন, ওরা মা মেয়ে দুজনেই খুব ভাল,কথা শুনে।

সীমাকে বললাম চল রুমে, আমি তোকে টাকা দিব ও তোর ফোন নাম্বারটা নিব। আমি এক হাজার টাকা দিয়ে বললাম, রাঙ্গামাটি যাওয়ার রাস্তায় মাথায় গিয়ে দাঁড়াবি আমি তুলে নিব। যত দেরি হউক না কেন আমরা আসবো। কেউ যেন তোদের না দেখে। মাকে  বলবি আমি যা যা বলেছি। মেয়েটা অবাক করে দিয়ে  আমায় জড়িয়ে ধরে  বলল আমি আপনাকে বিশ্বাস করলাম। বললাম একটু গাছের আড়ালে থাকিস, সহজে যাতে কারো চোখে না পড়িস।উপজেলা থেকে টেম্পু ধরে চলে যাবি।

আমি ডাক্তারের সাথে হাসপাতালে গিয়ে যন্ত্রপাতির তালিকা নিলাম । আমার  ম্যানেজারের সাথে কথা বলিয়ে দিলাম। ম্যানেজার আমাকে বললেন ম্যাডাম যা করছেন ঠিকতো, বললাম হ্যা চিন্তা করবেন না। একটা এক্সরে মেশিন দিতে  পারলে ভাল হয় আপনি মেডিকেলে কাউকে পাঠিয়ে সব দেখে অর্ডার করে দিন। ডাক্তার মনে হয় আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবে এমনই খুশি সে এখন। বলল ম্যাডাম  আমার সারাজীবনের জন্য একটা সুনাম হবে।

আরো কিছুক্ষণ হাসপাতালে  কাটিয়ে রোগীদের সাথে কথা বলে সময় কাটালাম। বাথরুমে যাওয়ার ছলে সীমাকে ফোন করে বললাম তোরা  কোথায়, বলল রাঙ্গামাটির রাস্তার কাছে চলে এসেছি। আমি বললাম একটু ঘুরে আসি। ওরা যদি ইতিমধ্যে এসে যায় তো ভাল তা না হলে পরে কাউকে পাঠিয়ে নিয়ে যাব। ডাক্তার বলল না হয় আজ থেকে যাবেন, বললাম দেখি, ওরা সন্ধ্যা নাগাদ এসে যাবে কি  বলেন।

ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছুটে চললাম বড় রাস্তার দিকে। এখন উপজেলার রাস্তায় গাড়ি চালান বেশ কঠিণ, অনেক টেম্পু ও চাঁদের গাড়ির আনাগোনা। যতটা সম্ভব পাশ কাটিয়ে খুব সাবধানে  গাড়ি চালিয়ে চলে আসলাম রাঙ্গামাটি যাওয়ার রাস্তায়। ফোন করে বললাম সীমা তোরা রাস্তায় মুখে চলে আয়। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে ওদের তুলে নিল। পিছনের সিটে বসিয়ে বললাম  মাথা নীচু করে থাক।

রাস্তা বেশ ভাল আমাদের রাঙ্গামাটি আসতে বেশি সময়  লাগল না। ড্রাইভারকে  বললাম চলেন ঢাকা চলে যাই। ভাটিয়ারি দিয়ে বেড়িয়ে গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া  যাবে। কাল সকালের মধ্যে ঢাকা পৌঁছাতে পারবনা। বলল ম্যাডাম আমরা  রাতেই যেতে পারব । কিন্তু আমি ভাবছি আপনি এটা কি করলেন। বললাম পরে বলব।

ভাটিয়ারি গলফ ক্লাবের কাছে এসে আমরা বিকাল নাগাদ পৌঁছুলাম আমি  ক্যাফেতে গিয়ে সবার জন্য খাবার আনলাম। মেয়েটি কয়েকবার বমি করে  মায়ের কোলে নেতিয়ে পরে আছে। বললাম ভয় পেয়ো না সব ঠিক হয়ে যাবে। অপেক্ষা না করে আমরা আবার ছুটে চললাম। রাত ১২টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম  বাসায়।

সীমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে জানলাম সে মা হবে, আমি দাঁতে দাঁত চেপে সব শুনলাম। আহারে এতটুকু বাচ্চার ক্ষতি করেছে।

আমি ফিরে ডাক্তারকে ফোন করে বললাম ওরা কি এসেছে, বলল না আসেনি,  আরে বুঝেন না ছোটলোকের বাচ্চা। বললাম আমি আলুটিলায় গুহা দেখতে এসে দেখলাম দেরি হয়ে গেছে তাই খাগড়াছড়ি আছি।  আমি ডাক্তারের সাথে  মিথ্যা বলে ও বেইমানী করে অনেক আনন্দ পেলাম।

সীমার মায়ের নাম নমিতা চাকমা। তারা মহালছড়িতেই ছিল, কিন্তু বাংগালিদের অত্যাচার এতোটাই মারাত্মক হয়ে উঠেছিল যা সহ্য করতে না পেরে নব্বইয়ের দিকে  নমিতার সাত ভাইবোনকে নিয়ে মা  বাবা  চলে গেছে  মহামুনি বৌদ্ধবিহার ছাড়িয়ে আরো ভিতরে বরপুল বাজারের কাছে। ছাপড়া  নৌকায় লেক পাড়ি দিয়ে নানিয়ার চরের দিকে  মাঝপথে তাদের বাড়ি। নানিয়ার চর মডেল প্রাইমারি স্কুলে সীমা পড়েছে সাত বছর বয়স পর্যন্ত, এরপর হাইস্কুলে পড়েছে।

মামা মামি মামাত বোন ও বাড়ির সাহায্যকারীদের কাছে সীমাকে রেখে চলে গেলাম নমিতাকে সাথে নিয়ে  মহালছড়ি। এবার জীপের ড্রাইভার বলল আপা কেন যাবেন ওখানে আবার বললাম কাজ আছে। আমি এবার ক্যামেরা নিয়ে গেলাম।  সীমা হাসপাতালের মোড়ে নেমে  গেল বলল আমি চেং নদিতে নৌকায় থাকব কাল আপনার  অপেক্ষায়।  আমরা অনেক শুকনো খাবার ও পানি নিলাম। ডাক্তার  সাহেব আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন মনে হয়না।  বললাম নানিয়ারচর যাব। ডাক্তার সাহেব অবাক হয়ে বললেন আপনার মাথা খারাপ ওখানে শান্তিবাহিনী ও মিলিটারি একসাথে থাকে, কার হাতে মারা পড়বেন ঠিক নেই। বললেন যদি যেতেই হয় আমি লোক দিচ্ছি। বললাম না স্বাধীনতায় হাত দিবেন না। ডাক্তার রাগ ধরে রাখতে না পেরে বললেন জানেন, আপনি আসার পর থেকে সীমা আর ও মা নমিতা কোথায় চলে গেছে। আমি তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললাম আমি ওদের নিয়ে গেছি। আপনার কোন আপত্তি আছে। বলল কেন নিলেন আমার কাজের লোক। আমি ডাক্তারের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম সীমা আপনার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে ডাক্তার সাহেব, সাবধানে কথা বলবেন। ডাক্তার বলল আপা মাপ করে দিন, কাউকে   বলবেন না, আমার সম্মান যাবে। বললাম আপনারা সমাজকে কলুষিত করেন, আবার সম্মানের কথা চিন্তা করেন।

হাসপাতালে জীপ রেখে আমরা চলে গেলাম লেকের পাড়ে। সেখান  থেকে নৌকায় উঠে গেলাম যার ছাউনির মধ্যে দেখি নমিতা বসে  আছে। আমরা লেকের শেষ মাথায় নেমে হাঁটতে শুরু করলাম,  বড়পুল বাজারে এসে থামলাম। এখানেও বাঙালি আছে তবে মহালছড়ির তুলনায় কম। বড়পুল বাজার লাগোয়া  নমিতাদের বাড়ি। ওর শশুর বাড়ি আরো অনেকটা দূরে। এখানে বেশিক্ষণ বসলাম না। নমিতা কিছু  বাজার করল ও তা সাথে নিল। আমরা নমিতার শশুর বাড়ি যাওয়ার পথ ধরে হাঁটতে থাকলাম। পাহাড়ের কোল ঘেষে সরু রাস্তা। কিছু রাস্তা হাঁটলেই দেখা মিলল চৌকির। নমিতা বল্ল এগুলো মিলিটারির চৌকি, এখানে শান্তি বাহিনী ও মিলিটারিরা সমানে সমান। জানিনা  কারা আমাদের রক্ষা করে, সেটেলার অনেক কম।

সন্ধ্যা নাগাদ আমরা একটি  ছনের ঘরে এসে থামলাম। বললাম নমিতা এটাতো শুধু একটা ঘর, মাচাংযের উপর।  বলল আপা এখানে সবই ছিল, কাছে স্কুল, বাজার কাছে, কিন্তু কপাল পুড়লে যা হয়, সীমার এক ফুফুকে কেউ রেপ করে বাড়ির চাতালে মেরে রেখে গিয়েছিল বছর  তিনেক আগে, কেউ বলে সেটেলার, কেউ বলে মিলিটারি। আমরা কিছুই জানিনা। রাগে দুঃখে সীমার বাবা চলে গেল শান্তিবাহিনীতে।  মিলিটারিরা সন্দেহ করে বাড়িঘর সব ভেঙ্গে দিল। আমার শশুর শাশুড়ি এখান থেকে যেতে চাইলেন না। পরে মিলিটারিরাই আমাদের এ মাচাং তুলে দিয়েছে।

আমরা ঘরে উঠতে যাব, তখনি কুঁচকে যাওয়া চোখমুখের দুজন  মানুষ বেড়িয়ে নমিতাকে জড়িয়ে ধরল।  বড় পুল বাজার থেকে নমিতা অনেক কিছু খাবার বয়ে এনেছে তা তাদের দিল।  রান্না করার জায়গাটাতে দেখলাম আর এক মহিলা নমিতার বয়সি রান্না করছে, বলল আমার জা, ভাসুর কয় বছর হল মারা গেছে, বাচ্চা নেই। আসলে উনিই শশু্র শাশুড়িকে দেখে রাখেন। নমিতার এক ভাইয়ের দোকান আছে  বড়পুল বাজারে তিনি খাবার দিয়ে যান। তা ছাড়া মিলিটারিরাও খাবার দেয় মাঝে মাঝে। মিলিটারিদের সাথে নমিতার শশুড় শাশুড়ির চুক্তি হয়েছে, নমিতার বর আসলে তারা ধরিয়ে দিবে।  না নমিতার বর আসেনি, ওরা জানেনা সে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। তাই নমিতা সবাইকে বলে সে মরে গেছে। মেয়েও তা ই বলে সবাইকে।

রাতে খাবারের পরে আমরা যখন মাচাংযের খোলা জায়গায় বসে আড্ডা দিতে দিতে আকাশ দেখছিলাম ও চা খাচ্ছিলাম, তখন নমিতার  শশুড় বললেন, মা তুমি আমার নমিতাকে নিয়ে যাও, সবার ওদের দিকে চোখ, সে মিলিটারি ই হউক আর সেটেলার হউক। আমার নিজের মেয়েটা চলে গেছে, কোন বিচার নেই, এই যে দুটো মেয়েকে আমি পেয়েছি একটা আমাদের সাথে থাকে, চোখে চোখে রাখি। অন্যটাতো চাকরি করে, সে টাকা আমাদের দেয়, কিন্তু ও মহালছড়ি হাসপাতালে যাওয়া আসা করে, কোন দিন কাজে গিয়ে আর ফিরবে না, হয়তো শরিরটাও  খুঁজে পাবনা।আপনি সীমাকে নিয়ে গেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি।

সকাল বেলা আমরা নাস্তা খেয়ে নৌকায় উঠে গেলাম, মহালছড়ি এসে পৌঁছুলাম দুপুর নাগাদ। লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম ড্রাইভার গিয়ে জ্বীপ নিয়ে আসল, আমরা দুপুর থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত জার্নি করে ফিরে আসলাম ঢাকাতে। নমিতা এখন থেকে আমার সাথে থাকবে, যা বেতন দিব, তার থেকে কিছু টাকা তার ভাইকে  প্রতি মাসে  পাঠাবে।  নমিতার ভাই সেই টাকায় নমিতার শশুর বাড়িতে খাবার কিনে পাঠাবে। নমিতা আমার বোন হয়ে আমার ঘরে থাকল। সীমার একটি ছেলে হল, নমিতাই দেখাশুনা করে। সীমা স্কুলে ভর্তি হয়েছে অষ্টম শ্রেনীতে, ওর উকিল হওয়ার ইচ্ছা।