বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৪)

-বিজন সাহা

জানালার বাইরে রোদ হাসছে। শরতের মেঘলা আকাশ ভেদ করে সূর্য আজকাল তেমন আর বেড়াতে আসতে পারে না আমাদের পাড়ায়। তবুও যখন রোদ উঠে আর সূর্যকে স্বাগত জানায় লাল-হলদে পূজার পোষাকে সজ্জিত প্রকৃতি, মনটা ভরে যায়। মনে হয়, শারদীয়া উৎসবটা বঙ্গ দেশে না হয়ে এই রঙে রঙে রঞ্জিত মস্কোয় হলেই বেশ হত।

অনেক আগে, যখন ছোট ছিলাম, সারা বছর অপেক্ষা করতাম পূজার দিনগুলোর জন্য। ছোট ছিলাম বলেই হয়ত করতাম। বিশ্বাস করতাম নির্মল আনন্দকে। বড় হলে মানুষ যখন প্রশ্ন করতে শেখে, প্রশ্নাতীত বিশ্বাসগুলো যখন একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করে, তখন আনন্দের নির্মলতায় খাঁদ পরে।

আমার ছোটবেলায় আমাদের বাড়ীতে দূর্গা পূজা হত। ওটা হত বাড়ী থেকে একটু দূরে বড় খালের অন্য দিকে রামার ভিটায়। রাম বসাক অনেক আগেই ভারত চলে গেছিল, তার কাছ থেকে বাড়ীটা বাবা কাকারা কিনে রেখেছিলেন, তবে ওটা কখনই আমাদের বাড়ী হতে পারে নি, রামার ভিটাই রয়ে গেছিল। দক্ষিণের চক দিয়ে বড় খালে যখন জল আসত, বুঝতাম পূজা আসন্ন। বদু ভাই, নালু ভাই সবাই লেগে যেত খালের উপর কাঠের সাঁকো মেরামতে। তারপর একদিন নিয়ে আসত এঁটেল মাটি, শন, কুচি কুচি করে কাটতো পাট। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কুমোর এক দিকে শন দিয়ে তৈরী করত প্রতিমার কাঠামো আর বলতো কিভাবে মাটি আর পাট মিশিয়ে তৈরী করতে হবে দেবতাদের মাংস। এর মধ্যেই সালাম ভাই অন্যদের নিয়ে লেগে পড়ত কাঠাম তৈরীর কাজে। আমরা ছোটরা ঘুরতাম আশেপাশে, কখনও মাটি দিয়ে খেলতাম। এক সময় শুরু হতো রং করার কাজ আর সব শেষে চোখ ফুটান অর্থাৎ চোখের মনি আঁকা হত। একে বলা হত চক্ষুদান। তবে এখন ঠিক মনে নেই সেটা মা দূর্গার কপালে তৃতীয় নয়ন সম্পর্কে বলা হত কিনা। এর মধ্য দিয়ে যেন বা দেবী জাগ্রত হয়ে উঠতেন। এর পর থেকে আমাদের আর ঢুকতে দেয়া হত না মণ্ডপে, পুরোহিত নিজেই ভার নিতেন ঠাকুরের দেখাশুনার। তাকে সাহায্য করতেন মা, মেজমা, খুড়িমা।

শৈশব পেরিয়ে যখন কৈশোর এল দেবতা হারালেন তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা। ততদিনে বুঝে গেছি নিজে পড়াশুনা না করলে সারা জীবন সরস্বতী মায়ের পায়ে ধরনা দিলেও পাশ করা যাবে না। তারপর এইসব দেশীয় ঠাকুর দেবতাকে পাশে ঠেলে মার্ক্স  এঙ্গেলস আর লেনিন দখল করে নিলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বরের জায়গা, শুনালেন বিপ্লবের বাণী। পূজার মণ্ডপে যাওয়া তখন হয়ে উঠল পশ্চাৎপদতার প্রতীক। দেশের শেষ দিনগুলো কাটল ছাত্র ইউনিয়ন, খেলাঘর, উদীচী করে। ঠাকুর দেবতারা নিজেরাই চলে গেলেন অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্য হারিয়ে। এরপর শুরু হলো নতুন জীবন – নতুন দেশে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ পর্য্যন্ত পূজার কথা মনেই ছিল না। ১৯৮৯ এ যখন দেশে গেলাম অনেক দিনের জন্য, মায়ের পীড়াপীড়িতে ঘুরলাম মণ্ডপে মণ্ডপে – মূলতঃ ছবি তোলার জন্য। ১৯৮৯ সাল থেকেই শুরু হলো মস্কোয় দূর্গা পূজা, আবার শুরু হলো অপেক্ষার পালা, যতটা না পূজার জন্য, তার চেয়েও বেশি এই উপলক্ষ্যে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের দেখা পাবার সম্ভাবনার কথা ভেবে।

ইদানিং অবশ্য পূজার দিনগুলোর অপেক্ষা করতে গিয়ে শুধু যে খুশির অপেক্ষা করি তাই নয়, অপেক্ষা করি দুঃসংবাদের। খবরের কাগজ ভরে থাকে গ্রামে গঞ্জে মূর্তি ভাঙার সংবাদ। ধর্ম নিয়ে মাথা ব্যাথা না থাকলেও এটা আমাকে ব্যথিত করে। ভাঙা মন্দির বা মসজিদ বা গির্জা দেখে ভাবি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তার ভক্তদের অন্ধ বিশ্বাসের ধাক্কায় এতই দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে নিজেকেও ভক্তদের রোষানল থেকে রক্ষা করতে পারছেন না। এই প্রতিটি ভাঙ্গা প্রতিমা, প্রতিটি ভাঙ্গা মন্দির বা মসজিদ বা গির্জা ছোট বেলায় পড়া ঈশ্বরের মাহাত্ম্যের ভিত ভেঙে দেয়।

ধর্ম বইয়ে লেখা ছিল, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু আজ যখন ভগবান, আল্লাহ আর গডকে নিয়ে এত হানাহানি, তখন কি মনে হয়না এগুলো শুধু ঈশ্বরের বিভিন্ন নামই নয়, বিভিন্ন স্বত্বাও?

১৯৮৩ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি, দিকে দিকে লেনিনের মূর্তি দেখে আমার মনে হয়েছে শিবলিঙ্গের কথা। তীর্থ স্থানগুলোতে সারি সারি শিবলিঙ্গ থাকত – মাকে বলতাম, তুমি যদি সবার মাথায় এক ফোঁটা করে দুধও ঢাল, কয়েক লিটার লেগে যাবে। সোভিয়েত দেশ থেকে তখন ঈশ্বর নির্বাসিত ছিলেন। কিন্তু লেনিনের মূর্তি দেখে আমার মনে হত, এটাও তো এক ধরণের পূজা। আশির দশকে, যখন ছাত্র ছিলাম, আমার রুমমেট ছিল ইয়েভগেনি। ও একদিন বলেছিল, “যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতাম, লেনিনই হতেন আমার ঈশ্বর।” আমার মনে হয় শুধু ইয়েভগেনি নয়, সোভিয়েত দেশের অনেক মানুষই এমনটা ভাবত। আর শুধু ভাবতই না, নিজেদের অজান্তেই লেনিনকে ঈশ্বর বলে মানত, শুধু অন্য নামে। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের পার্থক্য হল এই যে বিজ্ঞান কোন কিছু অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করে না, সব কিছুতেই প্রশ্ন করে। এর উল্টো দিকে ধর্ম অন্ধভাবে বিশ্বাস করে। তাই বিজ্ঞান যদি হয় ভবিষ্যতের দিশারী, ধর্ম অতীতমুখী – ভবিষ্যৎ বিহীন। হয়তো এ কারণেই বার বার দেখি তার মরণ ছোবল।

আমাদের ছোটবেলায় প্রতিমা হত মায়ের মত, সবাই মাকে দেখতে যেত। কোন মা সুন্দর, কোন মা অসুন্দর এ নিয়ে কারও তেমন মাথা ব্যথা ছিল না। যুদ্ধের পর পর আমাদের পাশের গ্রাম বানিয়াজুরীর মালাকার বাড়িতে যে প্রতিমা তৈরি হয় তা দেখার জন্য মানুষের ঢল নামে। এই প্রথম মা দূর্গা তাঁর সন্তানদের নিয়ে কেতাদুরস্ত পোশাক পরে বাপের বাড়ি আসেন নায়রে। এরপর থেকেই শুরু হল প্রতিযোগিতা কার প্রতিমা কত সুন্দর। এতে ভাল বা মন্দের কিছু নেই। পূজা হল রিচুয়াল তাই যুগের সাথে পায়ে পা রেখেই যে সে চলবে তাতে সমস্যা নেই। তবে দেখতে হবে এতে করে যেন সেটা যেন আদি অর্থ হারিয়ে না ফেলে – পূজা যেন শুধু প্রতিমা তথা কুমোরদের শৈলী প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় পরিণত না হয়। এটা শুধু পূজা নয় সব ক্ষেত্রেই সত্য। অনেক সময় অনেক ওয়াজ শুনে মনে হয় এটা যত না ধর্ম তাঁর চেয়ে বেশি পর ধর্ম নিন্দা, পরনিন্দা, পরচর্চা। পরমত অসহিষ্ণুতার অবাধ প্রচার যা পরিণামে অনেক মানুষের দুঃখ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ হারায় তার বাসস্থান, হারায় তার দেশ, কখনও বা তার জীবন। আসলে সমস্যা আইডিয়া বা আদর্শে নয়, সমস্যা সেই আইডিয়াকে ব্যবহার করে অন্যদের ক্ষতি করায়। বর্তমানে সরকার ধর্মকে প্রমোট করা জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করে, অনেক মসজিদ তৈরি করে, পূজার জন্য অনেক অনুদান দেয়, কিন্তু মানুষ গড়ার স্কুল তৈরি হয় সে তুলনায় অপ্রতুল। মসজিদ মন্দির তৈরি করে হয়তো তৎক্ষণাৎ বাহবা পাওয়া যায়, হয়তো ভোটও পাওয়া যায় – শান্তি মেলে না। শান্তির জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার, দরকার ধর্মীয় গোঁড়ামির বদলে মানুষকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করা। মানব জীবন সংক্ষিপ্ত। আরও সংক্ষিপ্ত ক্ষমতার মেয়াদ। দেশকে, মানুষকে খুব বেশি ভালবাসতে না জানলে এত দীর্ঘ প্রতীক্ষা করা যায় না। ফলে দেশেও শান্তি আসে না। ধর্মের নামে অধর্ম বাড়ে, বাড়ে বিশৃঙ্খলা। মূর্তি ধ্বংসের সাথে সাথে ধ্বংস হয় লাখ লাখ স্বপ্ন, ধ্বংস হয় নাগরিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার আশা আকাঙ্ক্ষা।

বরাবরের মতই এবারও মূর্তি ধ্বংসের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে পূজার সিজন। এরই মধ্যে কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার গুজব রটিয়ে হামলা হয়েছে পূজা মণ্ডপে। গুজব বলছি এ জন্যে যে বর্তমানে দেশে হিন্দুদের যে অবস্থা তাতে কোরআন বা ইসলাম ধর্ম অবমাননার মত সাহস তাদের নেই। অতীতে দেখা গেছে হিটলারি কায়দায় উগ্র মুসুল্লিরাই বার বার ভুয়া আইডি থেকে এসব স্ট্যাটাস দিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে। যারা এসব করে তারা সন্ত্রাসবাদী আর সেভাবেই তাদের আইনের আওতায় আনা উচিৎ। আমাদের ছোটবেলায় পূজা, ঈদ এসব ছিল সার্বজনীন উৎসব যেখানে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই অংশ নিত। গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে এগুলো ছিল নির্মল আনন্দের বিরল উৎস। যে পূজা, যে ঈদ হতে পারত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ার উত্তম সুযোগ আজ সেখানে সেই পূজাই হচ্ছে উত্তেজনার ছড়ানোর উৎস। এমনকি ঢাকার একজন মেয়র পর্যন্ত ওপেন স্টেজে পূজা করার অনুমতি দেননি। যেহেতু পূজা এলেই মূর্তি ভাঙ্গা শীত গ্রীষ্মের মতই একটা অবধারিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যেকোনো দায়িত্বশীল সরকারের, বিশেষ করে সেই সরকার যদি নিজেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার হোল সেলার বলে প্রচার করে, উচিৎ অনেক আগে থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে পুলিশী পাহারার ব্যবস্থা করা। সরকার যদি শক্ত হাতে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে দুর্বল প্রজাদের রক্ষা করার সাহস দেখায় তবে দেশে সত্যিকার অর্থেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য। কথায় চিড়া আর কত ভেজাবেন, কাজ দিয়ে দেখানোর সময় অনেক আগেই এসে গেছে।

এই যে আমরা কথায় কথায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলি সেটা কি দেশে আদৌ আছে? থাকলে কার জন্য? সংখ্যালঘুদের এটা দরকার অস্তিত্বের জন্য, সরকারের বলা দরকার ভাবমূর্তির (মূর্তি নয় শুধুই ভাব) জন্য। যতদিন না দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এটার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে ততদিন পর্যন্ত এই সম্প্রীতি অধরাই থেকে যাবে। আর যেদিন তারা সেটা উপলব্ধি করবে তখন নিজেরা নিজেদের তাগিদেই দুর্বৃত্তদের হটিয়ে সম্প্রীতি রক্ষা করবে। আপাতত সেটা হচ্ছে না মানে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন এটাকে প্রয়োজনীয় মনে করে না নাহয় এতে তাদের মৌন সমর্থন আছে। সরকার যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সত্যি আন্তরিক হয় তবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, বিদ্যালয় গড়তে হবে, সিলেবাসে পরিবর্তন আনতে হবে, শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে শিশুর মন। মনে রাখতে হবে আরবের মরুভূমিতে সোনার বাংলার চাষ হয় না।

প্রায় চৌদ্দ বছর পর ২০১১ সালে যখন দেশে বেড়াতে যাই, অবাক হয়েছিলাম দেশের প্রতিটি কোণে কোণে একদিকে শেখ মুজিব – শেখ হাসিনা – জয়, অন্যদিকে জিয়াউর রহমান – খালেদা জিয়া- তারেক জিয়া ছবি সম্বলিত পোষ্টার দেখে। এ যেন নতুন ট্রিনিটি, নতুন ব্রহ্মা- বিষ্ণু – মহেশ্বর। তখন আমার মনে হত ইয়েভগেনির কথা আর ভাবতাম, আচ্ছা এরা তো ঈশ্বর বিশ্বাস করে, ইয়েভগেনির মত এরাও কি নিজেদের নেতাদের ঈশ্বরের মতোই শক্তিশালী মনে করে? এটাও কি এক ধরণের পূজা নয়? কে জানে, হয়তো এমন এক দিন আসবে, যখন শুধু ছবি নয়, লেনিনের মতই এদের মূর্তিতে ছেয়ে যাবে দেশ? কে যেন তো বলেইছিল, খালেদা জিয়া নাকি দূর্গার মত দেখতে। তাই কোনো এক দিন যদি এইসব মানুষ তাদের নেত্রীদের আদলে প্রতিমা তৈরী করে, অবাক হবার কিছুই থাকবে না। যে মানুষ প্রশ্ন করতে জানে না, ভালো-মন্দ বিচার করতে জানে না, জানে শুধু অন্ধভাবে নিজেকে সমর্পন করতে – তাদের পক্ষে সবই সম্ভব।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো