বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা(১৩)

– বিজন সাহা

সেদিন আমার এক স্ট্যাটাসে একজন প্রশ্ন করল ভগবান কে? নিজের বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের উপর ভর করে হয়তো এক কথায় উত্তর দেওয়া যেত কিন্তু ভেবে দেখলাম এসব উত্তর কোন উত্তর নয় আর তাইই বারবার এই প্রশ্ন আসে। ঘটনাটা কি? এটা বুঝতে হলে আমাদের একটু অন্য ব্যাপারে কথা বলতে হবে।

আচ্ছা যে কেউই তো প্রশ্ন করতে পারেন মার্ক্স কে? নিউটন কে? আইনস্টাইন কে? এর উত্তরটাও কি ভিন্ন রকম হবে? আর যদি হয়ই তার কারণ এই কি যে এরা ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্ব? আসুন একটু ভাবি। আমার বিশ্বাস এই পৃথিবীতে হাজার হাজার মার্ক্স, নিউটন, আইনস্টাইন জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু যখনই আমরা এই নামগুলো উচ্চারণ করি তখন কিন্তু হাজার হাজার নয় নির্দিষ্ট কোন মার্ক্স, নিউটন বা আইনস্টাইনকে বুঝি। কারণ? এরা আর দশটা মানুষের মত শুধু নিজেরদের জন্যে বা নিজেদের সময়ের জন্য বাঁচেননি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য   কিছু আইডিয়া, কিছু ধারণা রেখে গেছেন। এই আইডিয়া, এই ধারণা মানুষকে যেমন অন্য জীবদের চেয়ে আলাদা করেছে তেমনি নিউটন, আইনস্টাইনদের করেছে অন্য মানুষদের থেকে আলাদা।

ছোটবেলার কথা মনে আছে? কেবল অংক কষতে শিখেছি। কি বলা হত আমাদের? ছোট সংখ্যা থেকে বড় সংখ্যা বিয়োগ করা যায় না। কেন? কারণ সেক্ষেত্রে আমরা ঋণাত্মক সংখ্যা পাই। আর ওই বয়সে ঋণাত্মক সংখ্যার ধারণা আমাদের ছিল না। হ্যাঁ, ধারণা। কেননা আমরা সেটা দেখি না, তার ভৌতিক অস্তিত্ব নেই। পকেটে দশ টাকা থাকলে আমরা সেটা দেখাতে পারি, কিন্তু আমি যদি দশ টাকা ঋণী থাকি, সেটা দেখাতে পারি না, শুধু মুখে বলতে পারি, কাগজে লিখতে পারি। এরকম অনেক কিছুই আমরা প্রতিদিন ব্যবহার করছি যেগুলো শুধুই ধারণা। আপনার হাতের মোবাইল সেটটার দাম দশ হাজার টাকা। সেটাও তো ধারণা। আপনি রাজী হয়েছেন সেটা সেই দামে কিনতে। অন্য দোকানে কিনলে হয়তো একটু কমে কিনতে পারতেন। একই ঘটনা ঘটে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। বাজারে গিয়ে যখন কোন কিছু দামাদামি করে কেনেন, একই ঘটনা ঘটে। কোন জিনিষের চাহিদা বেশি থাকলে তার দাম বেশি আর চাহিদা কম থাকলে কম। এসব বলার একটাই কারণ। আমাদের গোটা জীবনটাই বিভিন্ন ধারণা, বিভিন্ন শর্ত দিয়ে ভরা। কিন্তু সেসব আমাদের জীবনে এমন ভাবে ঢুকে গেছে শারীরিক অস্তিত্ব না থাকলেও আমরা তাদের অস্বীকার করতে পারি না, করি না। এসব আজ জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।

পৃথিবীতে ধারণার ঘাটতি ছিল না কখনোই। কিছু ধারণা কালজয়ী হয়েছে, বাকিরা হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে। কোনটা টিকবে আর কোনটা টিকবে না সেটা নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। একসময় আমার ঘর ভর্তি বই ছিল, হাতে ঘড়ি ছিল। কোথাও ঘুরতে গেলে কম্পাস সাথে নিতাম। পকেট রেডিও থাকত। আর আজ? শুধু একটা স্মার্ট ফোন এসবের কাজ করে। চাইলে ক্যামেরাও বাসায় রেখেই চলে যাওয়া যায়। তার মানে প্রয়োজন বা চাহিদা থাকলে অনেক ভৌতিক জিনিসকে, যেমন ঘড়ি, বই, রেডিও, টেপ রেকর্ডার বা ভিসিআর ইত্যাদির অভাব একটা মাত্র স্মার্টফোন দিয়ে পূরণ করা যায়। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন যে আমরা ডিভাইস বদলিয়েছি ঠিকই কিন্তু ধারণা বা আইডিয়া বদলাইনি। এখনও আগের মত আমরা সময় দেখি, দিক দেখি, গান শুনি, সিনেমা দেখি। এসব কিছু আমাদের সাথেই রয়ে গেছে। ধারণার অস্তিত্ব আমাদের মাথায়, হয়তোবা হৃদয়েও (আবেগ) – একে চাইলেই কলম, পেন্সিল, কাগজ, বই – এসবের মত সরিয়ে রাখা যায় না, সরিয়ে ফেলা যায় না। এরা বার বার ফিরে আসে। আর যদি কোন ধারণা কারও ঘাড়ে ভূতের মত চেপে বসে তাহলে তো কথাই নেই। কাগজ কলম বা অন্য কোন বস্তু যা ম্যাটেরিয়ালাইজ করা যায় তা বদলানো যত  সহজ, ধারণা বদলানো ততই কঠিন। কারণ এ জন্যে মানুষটারই খোলনলচে বদলাতে হয়। আর সেটা করা শুধু কঠিনই নয়, বিপজ্জনকও বটে। এতে করে মানুষ যে শুধু ভালোর দিকে বদলাবে তাই নয়, খারাপের দিকেও বদলাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে কীভাবে আদর্শ বা ধারণার বিপর্যয়ে যেসব মুক্তচিন্তার মানুষ প্রতিক্রিয়াশীল হয়েছে তাদের কথা।

আমাদের সমস্যা হল, আমরা কোন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সবকিছু বিচার করি। এবং আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেই। আর আমরা প্রায়ই কোন আইডিয়া অন্ধভাবে গ্রহণ বা ত্যাগ করি। হ্যাঁ, এমনকি যদি সেটা আমরা অনেক ভেবেচিন্তেও গ্রহণ বা ত্যাগ করি, একবার তা করার পর আমাদের সিদ্ধান্তকে অন্ধভাবে অনুসরণ করি। সময়ের সাথে সেসব যে নতুন করে পরীক্ষা করা দরকার অনেক সময় সেটা বুঝতেই চাই না। আচ্ছা আমরা কি ভুলে গেছি সমাজতন্ত্রের নামেই স্ট্যালিনের গুলাগের কথা বা পলপটের খেমাররুজের কথা? তাই বলে তো আমরা সমাজতন্ত্রকে, মার্ক্সবাদকে ত্যাগ করিনি। গণতন্ত্রেরর নামেই কিন্তু দাস ব্যবসা চলেছে। আবার গণতন্ত্রের নামেই আজও পৃথিবীর বহু দেশ পশ্চিমা শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ায় মারা গেছে লাখ লাখ মানুষ। ধর্মের নামে মানুষ মারা যাচ্ছে সেই আদি কাল থেকেই। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে নাৎসিদের হাতে যাদের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক ছিল না। তাই ধর্মই হোক, ফ্যাসিবাদই হোক, সমাজতন্ত্রই হোক আর গণতন্ত্রই হোক যেকোনো ধারণা সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আমাদের কোন কিছুকেই অন্ধভাবে ভালবাসা যেমন চলবে না তেমনি চলবে না অন্ধভাবে ঘৃণা করা। আমাদের  মনে রাখতে হবে যে যে ধারণা শত শত বছর ধরে মানুষের মনে গেঁথে গেছে শুধুমাত্র আমাদের স্বীকার বা অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে সেটা একদিনে দূর হবে না।

এখন তাহলে আমরা আসতে পারি সেই প্রশ্নে, ভগবান কে? ভগবান – এটা একটা ধারণা। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বিভিন্ন ভাবে তাঁকে কল্পনা করে আর একারণেই বিভিন্ন ধর্মে তিনি বিভিন্ন। এমনকি একই ধর্মের মধ্যেও ভগবানের আইডিয়া বা ধারণা বিভিন্ন হতে পারে। আবার অনেক মানুষের কাছে তাঁর কোন অস্তিত্বই নেই। কিন্তু এই যে অস্তিত্ব না থাকার ধারণা সেটাও একটা আইডিয়া। অন্য ভাবে বললে বিশ্বাস যেমন একটা বিশ্বাস বা আইডিয়া, অবিশ্বাসও একটা বিশ্বাস বা আইডিয়া। ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকুক আর নাই থাকুক, ঈশ্বরের ধারণাটা প্রচণ্ড জীবন্ত। আর সে কারণেই ধর্ম নিয়ে এত হানাহানি। সে কারণেই ধর্ম নিয়ে শত দলাদলি। আসলে কোন কিছুর অস্তিত্বের  জন্য তার শারীরিক উপস্থিতি সব সময় দরকার নেই, অনেক সময় প্রভাবও তার উপস্থিতি প্রমাণ করে। এখন বিজ্ঞান জগতে, বিশেষ করে কসমোলজিতে ডার্ক এনার্জি বলে একটা ধারণা প্রচলিত আছে। তেমনি প্রচলিত আছে ডার্ক ম্যাটারের ধারণা। যেহেতু স্বাভাবিক পদার্থের সাথে এরা মিথষ্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয় না, তাই আমরা এদের সরাসরি সনাক্ত করতে পারি না। তবে তাদের প্রভাব আমরা টের পাই। একই ভাবে আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ বা অপ্রমাণ করতে পারি না। তবে এই ধারণা এক বিশাল সংখ্যক মানুষকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে সেটা আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হাড়ে হাড়ে টের পাই। তবে আমরা যেহেতু নিজেদের মানবিক বলে মনে করি তাই এই ধারণার অস্তিত্ব স্বীকার করেই আমাদের সামনে এগুতে হবে। পৃথিবীর বুক থেকে আবরিজিনদের  নিশ্চিহ্ন করে নিজেদের আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার দিন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে বিভিন্ন মত ও পথের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের। কিন্তু চাইলেই তো আর সেটা করা যাবে না। এ জন্যে দরকার শিক্ষা।

কি সেই শিক্ষা? মুক্ত ভাবে চিন্তা করার শিক্ষা। কিন্তু সেটা কোথায় পাওয়া যায়? সেটা সর্বত্র। প্রতিদিন আমরা চারিদিকে কত কিছু দেখি। কত ঘটনা ঘটে চারিদিকে। মুক্ত চিন্তার শিক্ষা পেতে হলে আমাদের সব কিছু সম্পর্কে শিশুর মত আগ্রহ দেখাতে হবে, সব বিষয়ে প্রশ্ন করতে হবে। জানার ইচ্ছা, সত্যকে আবিষ্কার করার ইচ্ছাই একমাত্র মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম দেয়। আর যেখানে প্রশ্ন সেখানেই সন্দেহ। সন্দেহ জন্ম দেয় কৌতূহলের। কৌতূহল থেকে মানুষ শিখতে চায়, জানতে চায়। এভাবেই সে অর্জন করে জ্ঞান। আর জ্ঞান মানুষকে আরও আরও বেশি করে ভাবতে শেখায়, আরও আরও বেশি করে প্রশ্ন করতে শেখায়। এ যেন একটার পর একটা সিঁড়ি ভেঙ্গে ক্রমাগত উপরের দিকে ওঠা। প্রতিটি সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর আমাদের সামনে আরও বেশি করে অজানার দিগন্ত উন্মোচিত হয়, বাড়ে জ্ঞান পিপাসা। আমাদের যেটা করতে হবে তা হল নিজের ভেতর, নিজেদের বন্ধু বান্ধব, সন্তানদের মধ্যে এই পিপাসাটা জাগিয়ে রাখা। জ্ঞান মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে, তাকে পরমত সহিষ্ণু করে। শুধুমাত্র পরমত সহিষ্ণু হলেই দু’দিন আগে হোক আর দু’দিন পরে হোক আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে এমন একটা পৃথিবী গড়ে তোলা যেখানে জাতি ধর্ম বর্ণ আদর্শ নির্বিশেষে সবাই সেখানে শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করতে পারবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো