মতামত

বাংলাদেশ  শিপব্রেকিং সেক্টর: সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় শ্রমিকের জীবনহানী, উদাসীনতার অবসান হবে কবে?

– মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম

সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং সেক্টরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দুর্ঘটনায় দুই শ্রমিক মারা গেছেন এবং কমপক্ষে তিনজন আহত হয়েছেন যা দেশের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডসমূহের ব্যাপক নিরাপত্তা সংকট এবং বিপজ্জনক কাজের অবস্থার সমাধান বা পরিবর্তনে সরকার-মালিকপক্ষের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করার ভয়াবহ ফলাফলকে নির্দশ করে।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মো: আলী নাজিম (৩৫) যিনি দেশের উপকূলে রিসাইক্লিংয়ের জন্য আসা বিভিন্ন জাহাজের টুকিটাকি অংশ কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত একজন স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঘটনার দিন অন্যান্য দিনের মতোই তিনি ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে কুমিরায় অবস্থিত মাস্টার অ্যান্ড ব্রাদার্স শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে যান। মালামাল কেনার জন্য তিনি অত্র ইয়ার্ডের একটি ট্রাকের কাছাকাছি ছিলেন যেটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে লোড করা হয়েছিল এবং স্থানীয় লোকজন মারফত জানা গেছে যে ঐসকল অক্সিজেন সিলিন্ডারসমূহ সঠিকভাবে শক্ত করে বাঁধা ছিল না বিধায় হঠাৎ কিছু সিলিন্ডার ট্রাকের উপর থেকে  সরাসরি তার গায়ের উপর পড়ে এবং তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।

মাত্র ৩ দিন পর অর্থাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৫.২৫ মিনিটের দিকে ভুক্তভোগী শ্রমিক তেঁতুলতল এলাকায় অবস্থিত জে এল শিপব্রেকিংয়ে কাটারম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন। ঘটনার দিন তিনি উক্ত ইয়ার্ডের একটি জাহাজের উপরের অংশ কাটার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি জাহাজের উপরের দিক থেকে পিছলে পড়েন এবং গুরুতর আহত হন। কিছু পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত  ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। জাহাজভাঙ্গা শিল্পে কর্মরত বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের প্রতিনিধি ও অন্যান্য শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা যায় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ঐ শ্রমিককে যথাযথ নিরাপত্তা সরঞ্জাম তথা হারনেস বেল্ট দেওয়া হয়নি যা শ্রমিকের জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারতো বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। মৃতের নাম লিটন পাল, বয়স (৩০)।

লিটন পালের মৃত্যুশোক কাটতে না কাটতেই ২০ সেপ্টেম্বর  সকাল ১১ টায় তিনজন শ্রমিক যথাক্রমে কাটার বাবুল (২২), হেলপার পিয়াস (২0) এবং হেলপার রাসেল (২৫) জোড়ামতল এলাকায় মেরিন/মার্স শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কাজ করছিল। শ্রমিকদের ফোরম্যান তাদেরকে একটি জ্বালানি ট্যাঙ্ক কাটতে বলেছিলেন যা আগে থেকে নিরাপত্তা অফিসার দ্বারা পরিদর্শন করা হয়নি যাতে নিশ্চিত করা হয় যে ট্যাঙ্কে কোন রাসায়নিক পদার্থ নেই। কর্তনকারী বাবুল ট্যাঙ্ক কেটে ফেলার জন্য অন্যদেরকে ট্যাঙ্কের কাছে নিয়ে যায় এবং কাটার কাজ শুরু করতেই হঠাৎ করে ট্যাঙ্কটিথেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ উন্মোচিত হয় এবং তিনজন শ্রমিককে গুরুতর আহত করে।

ইন্ডস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন এর শিপ-ব্রেকিং প্রকল্পের এ শিল্পের দুর্ঘটনার তথ্য জরিপ থেকে জানা যায় যে, ১ জানুয়ারি ২০২১ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবেদন তৈরির সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১০ জন জাহাজ ভাঙা শ্রমিক নিহত এবং আরও অন্তত ২৩ জন শ্রমিক আহত হয়েছে উল্লেখ্য, ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকের একটি বড় অংশ বয়সে তরুণ এবং সকলেই অস্থায়ী শ্রমিক।

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করে ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন এর সহকারী সাধারণ সম্পাদক কান মাতসুজাকি বলেন-

মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে অনেক দুর্ঘটনায় আমরা হতবাক। মালিকদের অবহেলায় এমনতর দুর্ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এটি সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য এবং এটি আরও জরুরী করে তোলে যে বাংলাদেশ সরকার হংকং কনভেনশনের অনুমোদন সহ সমস্যা সমাধানে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।“

শুধুমাত্র যে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নিয়ে জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন এবং আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনসমূহ উদ্বিগ্ন বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। বরং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ অনেক আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে মালিক ও সরকারের সাথে সময়ে সময়ে সভা-সেমিনার বা আলাপ আলোচানা চালু রেখেছে কিন্তু দুখঃজনক যে বিষয়টি এখানে লক্ষ্য করা গেছে সমস্যার স্থায়ী সমাধান তো দূর অস্থায়ীভাবে দুর্ঘটনাজনিত বিষয়ে মালিক ও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোন উদ্যোগই নেই। সরকার ও মালিকপক্ষ উভয়ই শুধু দুর্ঘটনা পরবর্তী করণীয় পরিপালনে সচেষ্ট, অবশ্য তা আইনগত বিধি-নিষেধের কারণেই তা তারা করে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু আমরা কমবেশি সকলেই তো জানি সমস্যা বা রোগ যে কোন ক্ষেত্রেই তার প্রতিরোধই উত্তম বা তাই হওয়া উচিৎ। তেমনি দুর্ঘটনা ঘটার আগে যদি তার সম্ভব্যতা যাচাই করে যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া যায় ‍তাহলে হয়তো অনেক অকাল মৃত্যু বা আমৃত্যু শ্রমিকের পঙ্গুত্ববরণের অভিশাপকে ঠেকানো যেত।

চল্লিশ দশকেরও অধিককাল ধরে চলা একটি অতিশয় অভিজ্ঞ সেক্টরটির কর্মপরিবেশের অবস্থা যেহেতু আজকের একুশ শতকে এসেও এমন বেহাল দশার মধ্যে দিয়ে শত শত শ্রমিকের প্রাণের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতিতে এই সামান্য মাত্র ১২ থেকে ১৫শ কোটি টাকার বাৎসরিক রাজস্ব আদায় করে অবদান রাখতে হয় সেখানে আরো কতকাল অপেক্ষা করতে হবে একটি মৃত্যুহীন বা দুর্ঘটনামুক্ত কর্মপরিবেশ গড়ে তুলতে তা কে-ই বা জানে!

তবে, আমরা যদি বিদ্যমান জাতীয় আন্তর্জাতিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, শ্রমিকের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে যথাযথ তদারকির পাশাপাশি সকল সুরক্ষা সরঞ্জামাদি প্রদান, বিপজ্জনক সামগ্রীর যথাযথ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নিয়মিত এসংক্রান্ত রিপোর্টিং নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকারিভাবে পরিদর্শন ব্যবস্থা জোরদার করা, এ শিল্পে কর্মরতদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ন্যূনতম মান নিশ্চিত করা সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানদন্ত অনুযায়ী তা পরিচালিত হচ্ছে কি না তার নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা, মালিক-সরকার মিলে প্রত্যেক ইয়ারডে শ্রমিকদের জন্য নিয়মিত সুরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু রাখার পাশাপাশি আইনের বিধান মতে শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক জীবন বীমার বিধান কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে হয়ত অনেক অপ্রত্যাশিত ও গাফিলতির ফলে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক দুর্ঘটনার হারকে রুখে দেওয়া সম্ভক হতো আর যদি ‘সকল মানুষের জীবনের মূল্য সমান’ এমন নীতেবোধে উদ্বুদ্ধ হতে পারতেন মালিক-সরকার তথা আর সকলে তবে হয়তো প্রত্যেক শ্রমিকের জীবনের মূল্য একজন মানুষের জীবনের সমান মূল্য পেত।

 লেখক : জাতীয় সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ শিপব্রেকিং সেক্টর, ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন – দক্ষিণ এশিয়া