শিল্প সাহিত্য

পুনর্জন্ম

– শাহীন আকতার হামিদ

শাহীন আকতার হামিদ (ফাইল ফটো)

ফাতেমা তার ব্যাগটা রাখল গাছের নিচে।  গাছের শিকড়গুলো সিঁড়ির মত হয়ে আছে। আস্তে আস্তে পা ফেলে সে নদির কাছাকাছি গেল। আঁজলা ভরে পানি তুলে তা পান করল। পা ডুবাল পানিতে, মনে হল মনটা জুড়াচ্ছে। সাঁতার কেটে এপাশ থেকে ওপাশে যেতে ইচ্ছা করছে, না সে পানিতে নামবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার অতীতকে  ভুলে যেতে না পারে।

মা বাবা নাম দিয়েছিল ফাতেমা, ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ে সে আর স্কুলে যেতে পারেনি। বাবা বলেছে বড় হয়ে গেছে, কি দরকার স্কুলে গিয়ে।  ফাতেমা তার শরীরে বড় হয়ে জায়গাগুলো আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে থাকে।  নবীন চাচা সারা গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল, কিরে ফাতেমা কলিদুটো তারাতারি ফুটিয়ে ফেল। প্রায়ই নবীন চাচার হাত ঘুরে তার দুপায়ের মাঝখানে, কাউকেই ফাতেমার একথা বলা হয় না।  নবীন চাচা মা বাবার কাছের মানুষ, যখন তখন ঘরে তার অবাধ গতি।

মায়ের কাছেই তার যত আবদার, বলত “মা আমি স্কুলে যাই!” ফাতেমাকে মা চুপি চুপি স্কুলে পাঠাল, বেশিদিন যাওয়া হলনা, একদিন সে বাপের সামনে পড়ে গেল। বাপ বলল বাড়ি যা, সে এসে রাঙ্গা চাচির কাছে পালাল, রাঙ্গা চাচি নবীন চাচার বউ। কিন্তু কোন লাভ হলনা, বাবা তাকে লাঠি দিয়ে মারতে মারতে ঘরে এনে মাকে সহ মারল। মা মেয়ে টুশব্দটি করেনি। মারের পরে একজন আর একজনের গায়ে হলুদবাটা লাগিয়ে দিয়েছিল।  আর কোনদিন ফাতেমা স্কুলে যেতে পারেনি। বাবা যখন ঘরে না থাকত তখন সে ক্লাস ফোরের বইগুলো বের করে পড়ত,  বাবা ঘরে আসার আগেই সে বইগুলো মায়ের পুরণ কাঁথার পুটলিতে লুকিয়ে রাখত।

পানির কাছ থেকে উপরে উঠে এসে ফাতেমা এক্মুঠ চাল চিবিয়ে খেয়ে পানি  খেল। ক্লাস ফোরের বাংলা বইটি বের করে পড়ল, ‘পাখি সব করে রব রাতির  পোহাইল।’  ব্যাগটা থেকে সব কিছু বের করে মায়ের একটা শাড়ি কয়েক ভাঁজ করে তার মধ্যে সব জিনিস রাখল। এবার চারকোনায় গিট দিয়ে একটি ঝোলা বানাল।  তার সংসার পিঠে বহন করা বেশ সুবিধাজনক হয়ে দাঁড়াল। আবার সে হাঁটতে শুরু করল, অতীতটাকে পিছনে ফেলতেই হবে। রাত হলেই সে গ্রামের দিকে ফিরে যায়,  আজ তেমন কোন গ্রাম দেখল না।  দূরে জমির মধ্যে একটি টং ঘরের মত দেখে সেদিকে হাঁটতে শুরু করল। কাদা পানি ভেঙ্গে সে সেখানে   গিয়ে দাঁড়াল। দেখল উপরে একটা চাল ও বাঁশের মাচা। ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, কেউ কোথাও নেই, এবার সে হাতপা গুটিয়ে অই অপরিসর টংঘরে ঢুকে গেল। পুটলিটা মাথার নীচে দিয়ে শুয়ে পড়ল।

একদিন ফাতেমার বড়বন আসল একটি বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে, সেখানেই  ফাতেমার বিয়ে হয়ে গেল। লোকটার আগে আর একটি বিয়ে আছে,  সতীনের সংসার তার। এখানেও খড়কুটোর মত, শুধু রাতের বেলা তাকে স্বামীর বিছানায় যেতে হয়, ঘন্টার পর ঘন্টা তার হাত পা টিপতে  হয়। খুব সকালে উঠে যায়, ঘরের যত হাঁড়িপাতিল আছে সব পুকুরে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে আনতে হয় ও গোটা দশেক লোকের জন্য সকালের রুটি বানাতে হয়। সবাইকে নাস্তা খাইয়ে এঁটো থালাবাটি পুকুরে নিয়ে ধুয়ে আনতে হয়। এরপর আসে  কাপড় ধোয়ার পালা, সব সেরে দুপুরের একটু পরে রান্না করে সবাইকে খাইয়ে একটু ফুসরত হয়,  তখন সে রান্নাঘরে চুপ করে বসে থাকে, আউরাতে থাকে স্কুলের পড়াগুল। মাঝে একবার সতীনের ছেলের একটা বই ধরেছিল, তার জন্য মার খেতে হয়েছে বরের কাছে, সতিন বলেছে তোকে আনা হয়েছে ঘরের কাজ করতে, পড়তে না।

মাঝে মাঝে বাবার বাড়ি যেতে পারত, মা বলত সংসারের কাজ করবি মন দিয়ে। ফাতেমা বলত, “মা আমি তোমার সংসারের সব কাজ করে    দিব, ও বাড়িতে আমাকে পাঠিওনা। এখানে তোমাদের কোন কাজ করতে  হবেনা, আমি সব করব।“ মা রাখতে সাহস পেলনা, বলল তোর বাপ পিটাবে। তোকে শহরে কারো বাড়িতে কাজে পাঠাব তারাও  মারবে, কত অত্যাচার করবে, তার চেয়ে স্বামীর ঘর কর। বাপ ঘরে না  থাকলেই মা তাকে বই গুলো বের করে দিয়ে বলত,  “পড়।“ এবার মা তাকে নুতন একটা বই দিইয়েছিল, ক্লাস ফাইবের বাংলা বই, বলেছিল, “মুখস্ত করে ফেলবি সব।“ ফাতেমা অবাক হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল তুই এটা কোথায় পেলি, মা বলেছিল,  “তোর ভাইয়ের কাছে একটা বাচ্চা পড়তে আসে সেখান থেকে চুরি করেছি, কেউ জানতে পারেনি।“ ফাতিমা শশুড়বাড়ি যাওয়ার সময় বইটি লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিল । মা তাকে একটা নোটবুক ও পেন্সিল ও দিয়েছিল। সে জানে মা এগুলো ভাইয়ার ছাত্রদের কাছ থেকে চুরি করে।

টং ঘর থেকে নেমে ফাতেমা স্পঞ্জের স্যান্ডেল জোড়া হাতে নিয়ে পানিতে নেমে আসল। মুখে মেখে নিল কিছুটা মাটি, যাতে তার ফরসা  রংটি ধরা না পরে। রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল। একটা দোকান দেখে সেখান থেকে বন্রুটি, মুড়ি ও গুড় কিনল। এক প্যাকেট বিস্কুট ও কিনল।

ভাই স্কুলে চাকরি করে, ভাইয়ের বউও বেশ লিখা পড়া জানে। সেই  ফাতেমাকে তার পূরণ সালয়ার কামিজ দিয়েছিল। মায়ের কাছে তা রেখে গিয়েছিল, সতিনের বাড়িতে তাকে শাড়ি পড়তে হত, যদিও সতিন ও তার মেয়েরা সবাই সালোয়ার কামিজ পড়ত।  ফাতেমা সারাদিন রাত   মনযোগ দিয়ে কাজ করত আর বিকালে খাওয়ার পরে সে রান্না ঘরে বসে বই পড়ত। এটা ছিল তার কোরমা পোলাউ খাওয়ার মত অবস্থা। বিকালের এ সময়টুকুর জন্য সে সারাদিন অপেক্ষা করে থাকত অধীর  আগ্রহে।

হাঁটতে হাঁট্তে সে কোন গ্রামে এসেছে ফাতেমা তা জানেনা। আজ দশদিন ধরে সে হাঁটছে। শরীরটা অনেকটাই শুকিয়েছে, এটাই সে চাচ্ছিল। দেখতে এখন ভিখারির মতই লাগে। আগের পরিচিত কেউ  ফাতেমাকে দেখলেও চিনতে পারবে না, তার সে ফরসা নাদুস নুদুস শরীর আর নেই। ফাতেমার মনে ক্রমেই শান্তি  ফিরে আসছে।  আজ একটু  সন্ধ্যা করে গ্রামের দিকে হাঁটল। ভাবছে, কারো বাড়ির গোয়াল  ঘর বা রান্না ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে থাকতে পারবে। রাতের অন্ধকারে কেউ   আজকাল তেমন ঘরের বাইরে বের হয়না। একটা বিষয় সে জানে যে ফরিদপুর থেকে সে  বেনাপোলের দিকে সে হাঁটছে।

ভাইয়ের বউয়ের বাচ্চা হওয়ার বাপ তাকে শশুর বাড়ি থকে নিয়ে  আসল। ভাবি তাকে খুব ভালবাসে। বলে, “ফাতেমা তুমি না হলে আমার কি হত বলত।“ ফাতেমা ভাবির রক্ত পানির কাপড় ধুয়ে দেয়, বাচ্চার দেখাশুনা করে। মায়ের শরীর ভালনা, কি কি সব রোগ হয়েছে, ফাতেমাকে বলা হয়নি। মা পিছনের বারান্দায় সারাক্ষণ ঘুমাত, বাবা ছোটভাইকে নিয়ে সামনের বারান্দায় থাকত আর ভাই ভাইয়ের বউ ঘরে মা বাবার চকিতে থাকত। এখানে পুরো সংসারের দায়িত্ব ফাতেমা  খুশি হয়ে নিল, ভাবিকে বলেছিল “আমাকে আর সতিনের বাড়ি পাঠিওনা, আমি তোমাদের কাছেই থাকি।“

ফাতেমা দুবার করে পোয়াতি হয়েছিল আর সতিন দুবারই তাকে   আনারসের কচিপাতা বেটে খাইয়ে বাচ্ছা বের করিয়ে দিয়েছে। ভাইয়ের মেয়েটাকে সে বুকে করে রাখত, যতক্ষণ  না ঘুমাট সে  বাচ্চাটাকে কোলে রাখত। কি সুন্দর নরম তুলতুলে শরীর, বুকে চেপে ধরত। ভাইয়ের বউ কাজের সুবিধার জন্য ফাতমাকে আর যেতে দিলনা। ফাতিমা এখন বই পড়তে পারে কেউ বাঁধা দেয়না। একদিন ভাইকে বলল আমাকে তোমার স্কুলে ভর্তি করে দাও, ভাই রেগে গিয়ে মা ও বাবাকে বলল ওকে শশুড় বাড়ি পাঠিয়ে দাও। বাবা আবার তাকে অনেক মারল। কিন্তু স্বামী বলেছে তাকে আর নিবেনা।

ফাতেমার ছোট ভাই তার জমান টাকা দিয়ে বলল, “আপা তুই পালিয়ে যা,” কিন্তু ফাতিমা জানে না সে কোথায় যাবে। একদিন মা একটি  পুটলি দিয়ে বলল, “সাবধানে রাখিস, সব সময় বুকের মধ্যে রাখবি, এটাই তোর সম্পত্তি।“ ফাতিমা বলল, “মা এটা কি,” মা বলল, “আমার জমান টাকা ও আমার গয়না, সব তোকে দিলাম, শহরে গিয়ে  লিখাপড়া শিখে চাকরি করবি।“

মা মারা যাওয়ার চল্লিশ দিন শেষ হতে না হতেই বাবা বিয়ে করে আনল। বড়বোন এসে ছোট ভাইকে নিয়ে গেল। বড়ভাই আলাদা করে  স্কুলের কাছে ঘর ভাড়া নিয়ে চলে গেল। ফাতিমার কথা কেউ জিজ্ঞেস করলনা।  একরাতে ফাতিমা মায়ের দেয়া সম্পত্তি, ক্লাস ফোরের  বইগুলো ও কিছু কাপড় নিয়ে ঘর ছাড়ল।

এখন কোথায় সে জানেনা, তবে মনে হচ্ছে বর্ডারের কাছাকাছি চলে  এসেছে। শেষরাতের দিকে যে বাড়ির গোয়ালঘরে আশ্রয় নিয়েছিল সেখান থেকে বেড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। খাবার যা কিনেছিল সব খেয়ে নিল।  ফাতেমা চলে এসেছে বনগাঁ, এখানে তাকে কেউ খুঁজে পাবেনা, কেউ হয়ত চেষ্টাও করবেনা। সেই ভাল কোন পিছুটান নেই, মা ছিল সেও চলে গেছে কতদিন কয়েক মাস  হল।

এখানে বনগাঁয়ে নানাজাতীয় মানুষের ভিড়। ফাতিমা হারিয়ে গেল সে  ভিরে এখন আর তার তেমন ভয় লাগেনা। মুখের কালো মাটির রঙ তাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। যতক্ষণ সে পানির কলের কাছে ছিল দূর থেকে  তাকে দেখছিল একটা মেয়ে, কিছুক্ষণ পরে এসে মেয়েটা বলল, “অই ছেড়ি ওপারে যাবি।“ ফাতিমা বলল, “না যাবনা, কাজ খুঁজচ্ছি, দিন ঠেকা কাজ রাতে নিজের মত জায়গায় থাকব।“  মেয়েটি বলল, দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস ক্‌ হোটেলে হাড়িপাতিল ধোয়ার লোক লাগে অনেক সময়।“ বলল, “আয় আমার সাথে।“ফাতিমা জানে দিনের বেলা কেউ তার ক্ষতি করবে না, রাতের অন্ধকারটাই ভয়ের।

ফাতিমা লম্বায় অনেক ছোট, এখন এমন শুকিয়ে গিয়ে দেখতে দশ বারো বছরের মেয়ের মত লাগে। সারাদিন তিনটা হোটেলের হাড়িপাতিল ধোয়, বিকালে সে সেই মেয়েটার ছাপড়ায় ঘুমায়। এই মেয়েটা একজন দালাল , যে বিনা ভিসায় লোক পারাপার করে।  মানুষটা অত খারাপ না। একদিন ফাতিমা তার সাহায্য নিয়ে চলে গেল  ইন্ডিয়ার  বাজিতপুর, সেখানে আগে চলে যাওয়া কয়েকটি মেয়ের সাথে একটি বস্তিতে ঠাঁই পেল। প্রায়ই বাড়ি থেকে আনা বইগুলো পড়ে। বস্তির একটি মেয়ে বলল, তুই পড়তে চাস,  এনজিওর লোকেরা আসলে ওদের বলিস, ওরা তোর পড়ার ব্যবস্থা করে দিবে, কাজ করতে চাইলে তাও দিবে।“

তোমার নাম কি?’  “ফাতেমা।”

এপাড়ে কেন এসছো?’ “আমার কেউ নেই।”

তোমার বয়স কত?’ “জানিনা।”

তোমাকে কি এপাড়ে কেউ ফুসলিয়ে এনেছে?’ “না আমি নিজে  এসেছি।”

তুমি স্কুলে যাবে? “আমি ক্লাস ফোরের সব পড়া জানি।“

ওপাড়ে তোমার কে কে আছে?’ “জানিনা, ভুলে গেছি, একটা মা ছিল মরে গেছে।“

ফাতিমার আজ পুনর্জন্ম হয়েছে। আজ বাজিতপুর প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্রী সে। ঘরহীন মেয়েদের থাকার জায়গায় থাকে।   অতীত  তাকে আর টানে না, এখন ভবিষ্যৎ  তাকে  স্বপ্ন দেখায়। এদেশের রেশন কার্ড পেলেই সে ভারতের নাগরিক হয়ে যাবে।