চলমান সংবাদ

চট্টগ্রামের পরীর পাহাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ

চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পরীর পাহাড়ে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ না করতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পরীর পাহাড়ে ১২ তলার দুটি নতুন ভবন নির্মাণ করা নিয়ে আইনজীবী সমিতি ও জেলা প্রশাসনের দ্বন্দ্বের মধ্যে এই নির্দেশনা আগে। পাশপাশি পরীর পাহাড় রক্ষায় অননুমোদিত সকল স্থাপনা উচ্ছেদের প্রস্তাবনায়ও প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। এদিকে আইনজীবী ভবনগুলো উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়া হলে আইনি লড়াইয়ে নামার হুশিয়ারি দিযেছে জেলা আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পরীর পাহাড় রক্ষা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলে তিনি তাতে সায় দেন। গত রোববার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন সংযোগ অধিশাখা থেকে জারিকৃত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের আগস্ট মাসে দ্বিতীয় পক্ষের পাক্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গৃহীত প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত নির্দেশনা কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানানো হয়। এই ‘অনুশাসন’ অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে এর বাস্তবায়ন অগ্রগতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানাতেও বলা হয়েছে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরীর পাহাড়ে আর কোনো স্থাপনা যেন না হয় সে বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগকে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়গুলোকে। মন্ত্রণালয়গুলো আমাদের যেরকম নির্দেশনা দেবে সেভাবে কাজ করব। তিনি বলেন, পরীর পাহাড়ে চট্টগ্রাম আদালত ভবন এলাকায় থাকা অবৈধ স্থাপনা অপসারণেরও নির্দেশনা দেয়া হয়। আমরা উচ্ছেদ নোটিস সৃজন করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার জন্য উদ্যোগ নেব। আইনজীবীদের পাঁচটি ভবনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী কোন পাহাড় বা টিলার উপর কোনরূপ স্থাপনা করা যাবে না সরকারের পূর্বানুমতি ব্যাতিত। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পাহাড় বা টিলার উপর কোনরূপ স্থাপনাই শুধু নয়, কোন পরিবর্তনই করা যাবে না। সিডিএ অনুমোদন দিলেও করা যাবে না। পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারটি হচ্ছে আইন আর সিডিএর হচ্ছে নীতিমালা। সেই হিসেবে অবৈধ সকল স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। তিনি জানান, ফায়ার সার্ভিস নিজস্ব একটা সমীক্ষা করেছে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা নিয়ে। পরিবেশ অধিদপ্তরও কাজ করছে। তারা পরিবেশগত সমীক্ষা করছে। তিনি বলেন, পরীর পাহাড়ের পাদদেশের বাংলাদেশ ব্যাংক কী পয়েন্ট ইন্সটেলশন (কেপিআই) ভুক্ত একটি স্থাপনা। নীতিমালা অনুসারে ‘ক’ শ্রেণির কেপিআই’র আশেপাশে কোনো ধরনের বহুতল স্থাপনা করা যাবে না। তাই এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও কাজ করছে।” চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ইট-পাথরের জঞ্জালে পরিণত করা হয়েছে ঐতিহাসিক এই পরীর পাহাড়টিকে। এটিকে রক্ষা করে পরীর পাহাড়কে পরীর পাহাড়ের মতো করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অবশ্যই অনুসরণ করা হবে। এখানের পরিবেশ এবং প্রকৃতি রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে পরীর পাহাড়ের ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনা প্রসঙ্গে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ এনামুল হক বলেছেন, আদালত ভবনের সাথে আইনজীবী ভবনগুলো গভীরভাবে সম্পর্কিত। আমাদের সবকটি ভবনের অনুমোদন রয়েছে। আইনগত ভিত্তি রয়েছে। এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে আইনজীবীরা তা কখনও মানবে না। আইনজীবীরা আদালতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আদালত ছাড়া আইনজীবী, আইনজীবী ছাড়া আদালত কল্পনাও করা যায় না। আইনজীবীদের বাদ দিয়ে আদালতের কার্যক্রম সম্ভব না। যদি এমনটা হয় আমরা আইনের আশ্রয় নিব এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। প্রসঙ্গত চট্টগ্রাম নগরীর কেন্দ্রে অবস্থিত পরীর পাহাড়ে বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, নতুন আদালত ভবন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন এবং আইনজীবীদের পাঁচটি ভবনসহ বেশকিছু সরকারি কার্যালয় রয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি সেখানে নুন দুটি ভবন তৈরির উদ্যোগ নিলে তা নিয়ে আপত্তি তোলে জেলা প্রশাসন। মুখোমুখি অবস্থানে যায় জেলা প্রশাসন ও সমিতি। সমিতির ওই দুই নতুন স্থাপনা নির্মাণকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ মন্তব্য করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরীর পাহাড় রক্ষায় গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। এছাড়া নতুন সংযোগ না দিতে চট্টগ্রাম ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগ ও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিসহ ১৪টি সেবা সংস্থার কাছে চিঠি দেয় জেলা প্রশাসন। অন্যদিকে সকল নিয়ম মেনে ‘অনুমোদন’ নিয়েই নতুন ভবন করা হচ্ছে দাবি করে আইনজীবী সমিতি গত ৮ সেপ্টেম্বর বিশেষ সভায় প্রশাসনের কর্মকান্ডে নিন্দা প্রকাশ করে। মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের গোপনীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম নগরের কেন্দ্রস্থলে পাহাড়ের চূড়ায় প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ে অবস্থিত। এ অংশে রয়েছে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ সর্বমোট ৭১টি আদালত। জেলা প্রশাসকের নামে এখানে সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ১১.৭২ একর জায়গা রয়েছে। সরকারি ভবনের বাইরে ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত জায়গায় ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি পাহাড় এবং টিলা কেটে অবৈধভাবে ৫ টি ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। এসব স্থাপনাকে পাহাড় ধস, ভূমিকম্প, অগ্নিকান্ড ইত্যাদির জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত করেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি আবারও সরকারের কোনো সংস্থার অনুমোদন ব্যতিরেকে ‘বঙ্গবন্ধু আইনজীবী ভবন’ ও ‘একুশে আইনজীবী ভবন’ নামক দুইটি ১২তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করে এবং ৬০০টি চেম্বার বরাদ্দের জন্য আইনজীবীদের নিকট থেকে ২ লাখ টাকা করে ১২ কোটি টাকা আদায় করেছে। গোপনীয় রিপোর্টে আরো বলা হয় যে, এছাড়াও কোর্ট বিল্ডিংয়ের চতুর্পার্শ্বে আইনজীবীগন অর্ধশতাধিক অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ দোকানপাট, খাবার হোটেল, ছাত্রাবাস, বস্তি ও মুদি দোকান তৈরি করে ভাড়া আদায় করছে এবং এই স্থাপনাটিকে একটি অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। এখানকার অরাজকতার সুযোগ নিয়ে ২০১২ সালে এই কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় জঙ্গি হামলাও হয়েছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সম্প্রতি বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নিরাপত্তা রক্ষার্থে স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরাসমূহও আইনজীবী নেতৃবৃন্দ অপসারণ করেছেন। সিসিটিভি ক্যামেরা অপসারণ করে ফেলার কারণে অপরাধীরা দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আইনজীবীদের এ সকল স্থাপনার অনেক বিদ্যুৎ লাইন ও পানির লাইনের সংযোগও অবৈধভাবে নেওয়া হয়েছে। আইনজীবীদের এসকল কাজে বাধা দিলে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে উশৃংখল আচরণ করেন এবং ইতোপূর্বে তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ২টি বড় কক্ষও দখল করে নিয়েছেন। প্রতিবেদনটিতে প্রস্তাবনা আকারে বলা হয়, চট্টগ্রাম কোর্ট হিল এলাকায় সরকারি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় শ্রেণির জমিতে ইতোমধ্যে স্থাপিত সম্পূর্ণ অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল স্থাপনাসমূহ অপসারণ করা এবং চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি যেন আবারও অবৈধভাবে খাস জমি দখল করে কোর্ট বিল্ডিংয়ের সম্মুখস্থ একমাত্র ফাঁকা জায়গাটিতে কোন অবকাঠামো নির্মাণ করতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা গ্রহণপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন ও বিচার বিভাগকে নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
# ১৫.০৯.২০২১ চট্টগ্রাম #