শিল্প সাহিত্য

নদীপারের এই আষাঢ়ের প্রভাতখানি

– জিললুর রহমান

আজ ২৩ জুলাই ২০২১।  গতরাতে ঘুমাতে বেশ দেরীই হয়েছে। বাচ্চারাও ঘুমিয়েছে দেরীতে। তবু ভোর সাড়ে ছ’টা নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল। দেখি আকাশ মেঘলা, ঝিরিঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই গাছের সবুজগুলো চোখ কেড়ে নিচ্ছে। বউকে ডেকে বললাম ‘চলো, বাচ্চাদের জাগানোর দরকার নেই বৃষ্টিটা একটু উপভোগ করে আসি। তারপর ফিরে এসে প্রাতরাশ করা যাবে।” চট্টগ্রামে কুরবানীর ঈদের পর কমপক্ষে সাত দিন কোন হোটেল রেঁস্তোরা খোলে না। তাই আমরা কিছু পথ ঘুরে বৃষ্টি ভেজা সকালটা অনুভূতিতে ধারণ করে ফিরে আসবো, এটাই নিয়ত করেছি। যখন বের হই তখন প্রায় সাড়ে সাতটা হবে। তাড়াহুড়ায় ঘড়ির দিকে তাকানো হয়নি। এমনকি মাথায় ছিল না আজ থেকে কঠোরতম লকডাউনের সূচনা। পথে নেমে দেখি চারদিক শুনশান, কোন যানবাহন নেই। ফাঁকা রাস্তায় আমাদের জন্যে সব পথই অবারিত। এত সকালে বৃষ্টিস্নাত ভোরে তখনও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চেকপোস্টগুলোতে এসে পৌঁছায়নি। আমাদের অবশ্য চিকিৎসক পরিচিতি আছে, সমস্যা হবার কথা নয়।

জিইসি মোড় থেকে উড়াল পথ ধরে যাত্রা করলাম। মুরাদপুরে নেমে আবার বহদ্দারহাটের উড়াল পথে চড়লাম। প্রথমে ভেবেছিলাম চাক্তাই হয়ে ব্রিজঘাটা ঘুরে কোতায়ালীর মোড় দিয়ে শহরে ফিরে আসব। কিন্তু চাঁন্দগাঁওয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া উড়াল পথ কোন এক অমোঘ নির্দেশে গাড়ির চাকাকে ডেকে নিল। আমরা এগিয়ে যাই কাপ্তাই রাস্তার মাথা পেরিয়ে কামাল বাজারের দিকে। এখানে জনমনুষ্যহীন রাস্তার পাশে বড় বড় কচু সাজানোর আয়োজন করছেন। আস্তে করে গাড়ি থামিয়ে তিরিশ টাকা দিয়ে কিনে নিলাম একটি বিশাল কচু। তারপর এগিয়ে চলি মৌলভীবাজার পেরিয়ে কালুরঘাটের সু্প্রাচীন লক্কর ঝক্কর ব্রিজে। দুইপাশে দুকুল ছাপিয়ে বয়ে চলেছে কর্ণফুলী। বর্ষার এই রূপ দেখলেই মনে পড়ে রবিঠাকুরের কথা, বিভূতিভূষণের কথা। তাঁদের কালের সেই টানা বর্ষণমুখর বর্ষার দিন যেন আজকাল নিরুদ্দিষ্ট। এদিকে লকডাউনের কারণে তেমন একটা গাড়ির চাপ নেই, তাই হেলে দুলে থেমে থেমে নদী ও নৌকার ছবি তুলতে তুলতে পার হলাম ব্রিজ। এই ব্রিজ যে কোন সময় ভেঙে পড়বে বলেই আমার বিশ্বাস। অনেক তক্তা ঝরে পড়ে গেছে কর্ণফুলীর জলে, বেশ কিছু লোহা লক্কর ঝর্ঝরে হয়ে পড়েছে কিছু লোহার বীম মূল ব্রিজ থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে আমরা বাঙালিরা এমন এক জাতি যে, শেষমুহূর্ত পর্যন্ত আমরা থামবো না, পারাপার করতেই থাকবো। আমরা সেই দিন হবো ক্ষান্ত, যবে এই ব্রিজের তক্তা ভেঙে দুই চারটা গাড়ি ডুবে যাবে। তাই নিয়ম করে টোল দিয়ে যাই——প্রতিবার মৃত্যু ঝুঁকি গ্রহণের মূল্য মাত্র পঞ্চাশ টাকা। তাছাড়া এই ব্রিজ ভেঙে পড়ে গিয়ে মরলেন তো ইতিহাসের অংশই হয়ে গেলেন। হয়তো সলিল সমাধির মতো এমন সুপ্ত বাসনা মনের গোপনে রয়েছে বলেই বারবার পারাপার করি এই ব্রিজ। অথবা কৈশোরে মোহরায় খালাম্মার বাড়ি বেড়াতে এলে মাসতুত ভাই দিদার ভাইজান ও তার বন্ধুদের সাথে জোছনা খেতে আসার স্মৃতি মনে পড়ে বলে এখানে বারংবার চলে আসি মগ্নচেতনার টানে। যাই হোক, ভোরের বর্ষণমুখর কর্ণফুলীর রূপ অন্য দিনগুলোর তেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। শামসুর রাহমানের ভাষায় “কোথাও কেউ নেই ত্রিলোকে আমি একা”র মতো আমরা যেন পৃথিবীর একমাত্র যাত্রী অপার হবার জন্যে ভেসেছি ব্রিজের দোলায়। দু’চারটা জেলে নৌকা ভিজে ভিজে জাল ফেলছে, দুয়েকটা লঞ্চ বা ছোটজাহাজও নজরে এলো। ব্রিজের শেষ মাথায় যখন পৌঁছেছি, তখন কিছু চঞ্চল চপল তরুণ একে অপরের কাঁধে হাত রেখে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মাখতে মাখতে হেঁটে আসতে দেখলাম। সম্ভবত ছাত্র, গার্মেন্টস কর্মীও হতে পারে। এখন তরুণদের জামাকাপড় দেখে আর্থসামাজিক অবস্থা আন্দাজ করা কঠিন। একজনের মুখ থেকে ধোঁয়াও উদগীরণ হতে দেখলাম। যদিও আজকাল আর ধূমপান স্মার্টমেসের মাপকাঠি নয়, তবু এই ছেলেটিকেই মনে হলো অন্যদের চেয়ে বেশি স্মার্ট। তাদের অতিক্রমের পরেই আমরা অপার না হলেও ওপাড় হয়ে গেলাম, অর্থাৎ বোয়ালখালী।

নদী পেরুতেই মনে পড়ল কবি আকতার হোসাইনের কথা। তিনি বলেছিলেন, একদিন সময় পেলে নদীর ধার দিয়ে চলে যাও রাস্তায় বেড়িয়ে আসতে। ওনার গ্রামও ওইদিকে বলেই ঈঙ্গিত করেছিলেন। রুমিও মেধস মুনির আশ্রমে যাবার সময় এই পথে যেতে চেয়েছিল। মনে হলো এটাই মোক্ষম সময়। কেবল আমরা দুজন একান্ত সময় কাটানোর জন্যে এমন ভেজা ভোরের নদীর তীর সত্যিই আদর্শ। গাড়িতে যদিও লালনের গান বাজছিলো আনুশেহ্-র কন্ঠে, মনের ভেতরে গুনগুন করে বেজে উঠলো হেমন্তের গান “এই পথ যদি না শেষ হয়…”। জানি আমার মতো জীবনকে লেজেগোবরে করে ফেলা পাঁড় সংসারীর পথ একটু পরেই শেষ করতেই হবে, সন্তানদের খাওয়া দাওয়াত ব্যবস্থা তো রয়েছেই, সাথে আছে পেশার পরম কর্তব্য। তবু যতক্ষণ এসব ভুলে নিজেদের একান্ত সময়টাকে একান্ত আপন ও অনন্য করে নেওয়া যায় ততোটাই পরম প্রাপ্তি।

গাড়ি ঘুরিয়ে ব্রিজের ডানপাশের সিমেন্ট জমানো রাস্তায় ঢুকে পড়তেই সম্পূর্ণ মায়াবী এক জগতে যেন প্রবেশ করলাম। মনে হলো যেন সবুজ দেয়ালের এক সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। কোথাও ধুলাবালির রেশ নেই, জনমানুষের কোলাহল নেই। মাঝে মাঝে ঘুঘুর ডাক শুনতে পাচ্ছি। রাস্তার দুইধারের সকল দোকানপাট সব বন্ধ। মানুষ বা যানবাহনও নেই। সবার আগে চোখে পড়ল একটি পাকা তোরণ——হযরত মুন্দর আউলিয়া মাজার গেইট। কার নীচেই ঠিকানা লেখা। সেটাই জানা বেশি দরকার ছিল। অনেকক্ষণ ধরেই ভাবছিলাম জাযগাটার নাম কি। গুগল ম্যাপে দেখা যেত, কিন্তু মোবাইলের ইউটিউবে গান চলছে। তা থামাতে মন চাইছিল না। জানা গেল স্থানের নাম পশ্চিম কধুরখীল। এই নামটি আমার আশৈশব পরিচিত। আমার জেঠা বোয়ালখালী হাসপাতালে চিকিৎসক ছিলেন এবং কধুরখীল, গোমদণ্ডী, শাকপুরা এসব নাম আমাদের কানে প্রায় আসতো। জেঠার কোয়ার্টারে পরীক্ষা শেষে বেড়ানোর স্মৃতিও তো আছে। কধুরখীল বোয়ালখালী থানার অন্তর্ভুক্ত।

উইকিপিডিয়ার সূত্র মতে “বহু আগে এ ইউনিয়নের মিলন মন্দিরে রাস উৎসব হতো, ঐ রাস উৎসবটা চলতো ১০/১৫ দিন ব্যাপী। ঐ উৎসবে বহু দূরপাল্লা থেকে আসত লোকজন রাস উৎসবের টানে, শ্রোতারা মুগ্ধ হতেন পাঁচ মিশালী গানে। ঐ উৎসবে নাকি একবার এসেছিলেন তখনকার উচ্চপদস্থ কিছু লোক, হাঁটতে হাঁটতে বেহাল দশায় তারা বলেন ‘অবুক-রে অবুক’। তখনকার যুগে ছিল না কোন যানবাহনের ব্যবস্থা; বহু ক্রোশ হাঁটতে হতো। দীর্ঘতম রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত মনে রুদ্ধনিঃশ্বাসে তারা বলেন ‘রাস উৎসবে পৌঁছবো আমরা আর কদ্দুর গেলে?’ পাশে একজন পথচারী পেয়ে তারা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাস উৎসবটায় যেতে ভাইরে আর কতদুর খিল?’ লোকটা বলে, দুর নয় আর আছে সামান্য খিল, ঐ দেখা যায় পাড়াটার পরে বড় একটা বিল। সেই থেকে নামকরণ হয় কধুরখীল”।  শুনেছি মুক্তিযুদ্ধে কধুরখীলবাসীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সে যাই হোক, কধুরখীলের জাগ্রত জনগণ এখন এই নিশ্চিন্তপূরে ঘুমে কাদা হয়ে আছে। আমরা দেখলাম মাজার তোরণের ভেতর দিয়ে সুন্দর একটি রাস্তা অনেক ভেতরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা সে পথ ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রেখে সোজা নদীর পাড় ধরে এগিয়ে গেলাম। যেতে যেতে নদীর পাড়। বৃক্ষশোভিত প্রান্তরের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে গাছের ফাঁক দিয়ে নদীতে দুয়েকটা জেলে নৌকা চোখে পড়ছে। কোথাও বালু উত্তোলনের কর্মকাণ্ডের নমুনা নদীর পাড়কে বিভ্রান্ত করে থেবড়ে পড়ে আছে। একটা গরুর হাট দাঁড়িয়ে আছে বেশকিছু গরুসহ, কিন্তু বেপারী বা ক্রেতা নেই। একটা ঘাসে ঢাকা সমতল এলাকা দেখে নামতে চাইলাম। কিন্তু ভেজা মাঠে জমে থাকা জলে জুতো ডুবে যাবে দেখে আর এগুলাম না। বরং একটু পরেই একটা ছোট ব্রিজ পেরুতে গিয়ে দেখি একেবারে নদীর ধারেই চলে এসেছি। সেখানে নেমে কয়েকটি ছবি তুলতে না তুলতেই বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেল। মাথায় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো টপ টপ করে যখন পড়ছিল, মনে হলো যেন মাথায় চুলই নেই, সরাসরি তালুতে আঘাত করছে। তখন মনে পড়লো একসময় বাচিং আর খুররম ভাইয়ের সাথে কিংবা তৈমুরের সাথে কতো ভিজেছি তুমুল বৃষ্টিতে। তখন ঝাঁকরা চুল ছিল, বয়স কম ছিল, সারাক্ষণ ঠাণ্ডার প্রকোপ লেগে থাকলেও ভীত হতাম না। আর আজ অল্প ভিজেই শঙ্কিত হয়ে গাড়িতে ঢুকে পড়লাম। আরও কিছুদূর গেলে আরেকটি মাজার গেইট চোখে পড়লো। অনেক বিশেষণের পরে খুঁজে পেলাম নাম——কাজী আবদুল মজিদ আলকাদেরী (রহঃ)। পরে অবশ্য ছোট করে লেখা আছে “প্রকাশ বড় হুজুর মাওলানা সাহেব (রহঃ)”। বুঝা গেল এতদঞ্চলে আরও অনেক পীর মুর্শিদ হুজুরের মাজার পাওয়া যাবে। একটু পর পর মসজিদ এবং মাদ্রাসার ফটকও নজরে এলো। চট্টগ্রাম এমনিতেই পীর মুর্শিদদের জায়গা। তবে এখানে মন্দিরেরও উপস্থিতি চোখে পড়লো। সব মিলিয়ে একটি সৌহার্দপূর্ণ সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের লক্ষণ দেখতে পেলাম। এসব নিয়ে তেমন ভাবার সময় কই! আমরা যেন ২০/২৪ বছর আগের বয়সে পৌঁছে গিয়েছি। কিছুদূর গিয়ে থামি, ছবি তুলি, আবার এগিয়ে চলি। চরাচরে যেন আমরা দুই চখাচখী ছাড়া জগত জনশূন্য হয়ে আছে। সময় থমকে আছে আমাদের বিনোদনের জন্যে। একটা বেশ দীর্ঘ পথ রাস্তাটা একেবারেই নদীর পাড় ঘেঁষে গিয়েছে। দেখে মনে হলো এই পয়েন্টটার পর্যটন ও বিনোদনের স্পট হিসেবে পরিচিতি আছে। কারণ নদীর ধারে নৌভ্রমণের জন্যে বোট বাঁধা আছে। আর রাস্তার অপর পাড়ে রয়েছে বেশ কিছু ফ্যান্সি রেঁস্তোরা। কিছু কিছু রেঁস্তোরা নাম মনে আছে——ক্যাফে রিভার সাইড, ক্যাফে মডার্ন লিফ, এলাকাটা গ্রামবাসীদের বৃক্ষশোভিত গ্রাম অপেক্ষা ভিন্ন চরিত্রের তা সহজেই টের পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাচ্চাদের নিয়ে এখানে বৈকালিক ভ্রমণে আসার পরিকল্পনাও করে ফেললাম মনে মনে। মনে মনেই বা বলছি কেন, রুমিকেও জানিয়ে দিয়েছি। এই এলাকার পরে আবার সেই চেনা পথ, চেনা গ্রামের দৃশ্য, সেই বারিছা, মেঠোপথ। এক জায়গায় ধুন্দলের হলুদ ফুল এতো মনোরম লাগছিল যে ছবি তোলার জন্যে থামতেই হলো। তবে সুন্দর পিচঢালা রাস্তা কোথাও কোথাও বেশ ভাঙা, ছোটবড় খাদে আকীর্ণ। মাধে মাঝে আবার সুন্দর সিমেন্ট জমানো রাস্তা। একটা বালুবাহী ট্রাক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আরও কিছুদূর এগিয়েছি, এমন সময় দেখা গেল এক বয়স্কা নারী ছাতা মাথায় হেঁটে আসছেন, আমাদের গাড়ি তাকে পেরিয়ে যাবার সময় রুমি লক্ষ্য করলো, মহিলার হাতে কাগজে মোড়ানো নানরুটি আছে। তখন আমরা টের পেলাম সামনে কোথাও চা’ দোকান খোলা আছে, যেখানটায় গেলে আমরা গরম গরম নানরুটি পেতে পারি। আমরা এবার প্রকৃতির আরতি ছেড়ে উদর পুর্তির ধ্যানে আগ্রহী বয়ে উঠলাম। বেশ কিছু ছোট ব্রিজ ও কালভার্ট পেরিয়ে দেখি পাশাপাশি দুটো চা’ দোকান খোলা। প্রথমটায় কিছু লোকজন আছে, পরেরটা জনহীন। আমরা প্রথম দোকানীকে বললাম ২০টা নানরুটি গরম গরম বানিয়ে দিতে। আমরা গাড়ির ভেতরে অপেক্ষমান। পরম মমতা ভরে তারা নরম নরম গরম নানরুটি আমাদের তৈরি করে দিচ্ছে। নানরুটি নেওয়া হলে তাদের কাছে আবদার করলাম আমাদের দুটো নানরুটি আর দু’কাপ চা যেন গাড়িতে সরবরাহ করে। মুহূর্তের মধ্যেই আজ্ঞা পালনে বিস্মিতই হলাম। যেমন সুন্দর ছিল চায়ের রং, তেমনি অমৃততুল্য তার স্বাদ। নানরুটি চুবিয়ে খেতে খেতে মনে হলো “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে”। নানরুটি আরো একটি চেয়ে খেলাম। দোকানিকে প্রশ্ন করে রুমি জেনে নিল এলাকাটির নাম জামতলী। চা দোকানের পরেই কালভার্ট পেরুলে মাজার তোরণে স্থানের নাম খুঁজতে গিয়ে দেখি আবদুল মালেক শাহ (কঃ)-র ওরছে হায়াতীর ব্যানারের জন্যে ঠিকানা ঢেকে রয়েছে। আমরা এগিয়ে গেলাম আরও অনেক দূর। যেতে যেতে চৌধুরীহাট পর্যন্ পৌঁছে দেখি সামনের রাস্তা বেশ খারাপ, কাদায় ডুবে আছে, সড়কটা অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে। শুনেছিলাম চৌধুরীহাটের ডান দিকে কদ্দুর গেলেই রাসবাড়ি ( মিলন মন্দির) Dr. Ashish Kumar Chowdhury  এর বাড়ি। এর একটু পরেই আশুতোষ চৌধুরী ও সুচরিত চৌধুরীর বাড়ি। কবি আকতার হোসাইনের বাড়িও ওদিকে কাছাকাছি। অগত্যা ফিরতি পথ ধরলাম। এদিকে অদিতা জেগে উঠে আমাদের না পেয়ে ফোন করছে। আমরা একটু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে বললাম——গরম গরম নানরুটি আসছে। অতএব ফিরতে হবে ত্বরা করে। ফেরার পথে যখন কর্ণফুলী পার হচ্ছিলাম তখন আমার মোবাইলের ইউটিউবে বাজছে “আমি অপার হয়ে বসে আছি…”। এদিকে বাইরে তুমুল বর্ষণে চারপাশ ঘোলা হয়ে আছে, তার মধ্যে নদীতে জেলে নৌকাগুলো ভেসে আছে দেখা যায়। রুমি ভিডিও করলো এই অনুপম দৃশ্য, ব্যাকগ্রাউন্ডে রইল “পারে লয়ে যাও আমায়…”।

আমার কেবলই মনে পড়ছিল রবিঠাকুরের সেই অসামান্য গান——

“নদীপারের এই আষাঢ়ের
প্রভাতখানি
নে রে, ও মন, নে রে আপন
প্রাণে টানি।
সবুজ নীলে সোনায় মিলে
যে সুধা এই ছড়িয়ে দিলে,
জাগিয়ে দিলে আকাশতলে
গভীর বাণী–
নে রে, ও মন, নে রে আপন
প্রাণে টানি।

এমনি করে চলতে পথে
ভবের কূলে
দুই ধারে যা ফুল ফুটে সব
নিস রে তুলে।
সেগুলি তোর চেতনাতে
গেঁথে তুলিস দিবস-রাতে,
প্রতি দিনটি যতন করে
ভাগ্য মানি,
নে রে, ও মন, নে রে আপন
প্রাণে টানি।”

অলংকরনঃ আদিবা তাসনিম বানু, ৭ম শ্রেণি, সেন্ট মেরিস স্কুল, চট্টগ্রাম।