চলমান সংবাদ

হেফাজতের প্রধান ঘাঁটি হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে নির্বাচিত হয়েই মারা গেলেন আব্দুস সালাম, ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ইয়াহিয়া

নানা ঘটনার কেন্দ্র, বিতর্কিত সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের প্রধান ঘাঁটি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার মহাপরিচালক নির্বাচিত হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মারা গেছেন ওই মাদ্রাসার প্রবীণ শিক্ষক আব্দুস সালাম চাটগামী। দেশের কওমি অঙ্গনের প্রধানতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই মাদ্রাসার মহাপরিচালক হিসেবে ছিলেন হেফাজতের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফী। তার স্থলাভিষিক্ত হওয়া আব্দুস সালামের মৃত্যুর পর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ঘোষণা করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হাটহাজারী মাদ্রাসায় নিয়ন্ত্রণের উপর সংগঠনটির নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে নির্ভর করে। এই মাদ্রাসা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই হেফাজতের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা নির্বাচিত হন। হেফাজতের বর্মতান আমির মহিবুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচির নূরুল ইসলাম জিহাদী হাটহাজারী মাদ্রাসার শুরা কমিটির সদস্য। এছাড়া হেফাজতের প্রয়াত আমির ও মহাসচিবরাও এই মাদ্রাসার প্রধান দায়িত্বে ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘসময় ধরে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আহমদ শফী মহাপরিচালকের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পরদিনই তিনি মারা যান। এরপর মাদ্রাসার ‘মহাপরিচালক’ পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া না হলেও মাদ্রাসা পরিচালনার সকল দায়িত্ব নেন হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। সম্প্রতি জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর মহাপরিচালক নিয়োগের তোড়জোড় শুরু হয়। বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকালে বৈঠকে বসে মাদ্রাসার শূরা কমিটি। বৈঠকে মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে নির্বাচিত হওয়ার ঘন্টাখানেকের মধ্যে আব্দুস সালাম চাটগামী মারা যান। ৮২ বছর বয়সী আব্দুস সালামের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায়। তিনি আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষকতা করে আসছিলেন। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, মাদ্রাসার শূরা কমিটির সভাপতি ও হেফাজতের আমির মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে করেন বৈঠক শুরু হয়। শূরা কমিটির সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন নানুপুরী জানান, বৈঠকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আব্দুস সালাম চাটগামীকে মহাপরিচালক, মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে সহকারী পরিচালক এবং শেখ আহমদকে প্রধান শায়খুল হাদিস নির্বাচিত করা হয়। কমিটির সকাল ৯টার দিকে বৈঠক শুরুর পর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আব্দুস সালাম শুরু থেকেই অসুস্থবোধ করছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বৈঠকে না গিয়ে নিজ কক্ষে অবস্থান করছিলেন তিনি। পরে সকাল ১১টার দিকে তাকে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক হুজুরকে মৃত ঘোষণা করেন। আব্দুস সালামের মৃত্যুর খবর পৌঁছার পর শূরা কমিটি আবার বৈঠকে বসে মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ঘোষণা করে। পাশাপাশি মাওলানা শেখ আহমদকে প্রধান শায়খুল হাদিস এবং মুফতি জসিম উদ্দিনকে সহযোগী পরিচালক করা হয়। এছাড়া মাওলানা কবির আহমদকে শিক্ষা পরিচালক ও মাওলানা ওমর কাসেমীকে সহকারী শিক্ষা পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. আবু সৈয়দ মো. ইমতিয়াজ হোসাইন বলেন, ‘উনাকে (আব্দুস সালাম) মৃত অবস্থাতেই হাসপাতালে আনা হয়। উনার কী ধরনের অসুস্থতা ছিল তা আমরা জানি না। তবে উনার বয়স হয়েছে।’ এদিকে শুরা কমিটির বৈঠককে কেন্দ্র করে হাটহাজারী মাদ্রাসায় কড়া নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। শাহী গেট দিয়ে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকদেরও প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ও সাংবাদিকদের অপেক্ষা করতে দেখা যায়। হেফাজতের আমিরের শুরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন হেফাজত মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী, আব্দুল মালেক, সালাহউদ্দিন নানুপুরী, মাহমুদুল হাসান ফতেপুরী, হাবিবুর রহমান কাসেমী, মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, মাওলানা ওমর ফারুক, ঢাকা মাদানি নগর মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি ফয়জুল্লাহ সন্দ্বীপী। প্রসঙ্গত হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফী প্রায় ৩৪ বছর ধরে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে ছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মাদ্রাসার কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব ও হেফাজতের অভ্যন্তরীন বিরোধের জেরে আহমদ শফীর বিরুদ্ধে হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র বিক্ষোভ হয়। মাদরাসার অভ্যন্তরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগও করা হয়। এসময় শফীর অনুসারী বেশ কয়েকজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা হয়। এমনকি শফীর কক্ষও ভাংচুর করা হয়। বিক্ষোভের মধ্যে একপর্যায়ে ১৭ সেপ্টেম্বর শাহ আহমদ শফী অনেকটা বাধ্য হয়ে মহাপরিচালকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। বিক্ষোভের মধ্যেই ১৮ সেপ্টেম্বর প্রায় শতবর্ষী শাহ আহমদ শফী মারা যান। এরপর শফীর বিরোধী হিসেবে পরিচিত মাদ্রাসার সহকারি পরিচালক জুনায়েদ বাবুনগরীর নিয়ন্ত্রণে চলছিল এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। গত ১৯ আগস্ট তিনিও মারা যান। ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সূচনালগ্ন থেকে শফী সংগঠনটির আমির এবং জুনায়েদ বাবুনগরী মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০১৩ সালে যুদ্ধারপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনকারীদের নাস্তিক-মুরতাদ আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে সরব হয় হেফাজত। একপর্যায়ে ১৩ দফা নিয়ে ওই বছরের ৫ মে সারাদেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি পালন করে। ঢাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মধ্য দিয়ে সংগঠনটি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক নাশকতা-তান্ডব চালায় হেফাজত। শফীর মৃত্যুর পর গত বছরের ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রতিনিধি সম্মেলনের মাধ্যমে ১৫১ সদস্যের হেফাজতের নতুন কমিটি হয়। এই কমিটিতে থাকা যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ হেফাজত নেতারা প্রথম থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় সভায়, ওয়াজ মাহফিলে সরকার, মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিতে থাকেন। দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধীতা করে হাটহাজারীতে হেফাজতের নেতাকর্মীরা ব্যাপক নাশকতা-তান্ডব চালায়। এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতের নেতাকর্মীরা কয়েকদিন ধরে তান্ডব চালিয়ে থানায় ভাঙচুর, ভূমি অফিসসহ সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে। এসব ঘটনায দায়ের করা মামলার তদন্তকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, হেফাজতের শীর্ষ নেতারা নাশকতার বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল।

# ০৮.০৯.২০২১ চট্টগ্রাম #