চলমান সংবাদ

দেওয়ানহাট ওভারব্রিজঃ অসংখ্য ফাটল, দিন দিন বাড়ছে ঝুঁকি

দেশের প্রথম ফ্লাইওভার খ্যাত দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ যে কোন সময় ভেঙে পড়তে পারে। মাঝারি ভূমিকম্পেও এই ব্রিজ টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। ব্রিজের পিলারের রড বেরিয়ে পড়েছে। শত শত ক্রেক ব্রিজের শরীরে। নিচ দিয়ে ট্রেন যাওয়ার সময় ব্রিজটি থরথর করে কাঁপে। ট্রান্সএশিয়ান রেললাইন উন্নয়নের যে প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ। ব্রিজটির উচ্চতাও নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রচলিত নিয়ম কানুন অনুসরণ না করায় ব্রিজটি সবার অগোচরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত জরুরিভিত্তিতে ব্রিজটি রিমুভ করে নতুন ব্রিজ নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র জানিয়েছে, দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের মূল অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে। পাকিস্তান আমলের মাঝামাঝিতে ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়। দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান ব্রিজটির নির্মাণ কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিল। ব্রিজটির কিছু নির্মাণ ত্রুটি ধরা পড়ায় স্বাধীনতার পরে এটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের দিকে এসে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজটিতে বড় সংস্কার করে আবারো পুরোদমে চালু করা হয়। ব্রিজটি করার আগে নিচের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল করলেও ব্রিজ চালু হওয়ার পর এটিই শহরের দুই প্রান্তের সংযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠে। ব্রিজটির উপর দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করে। এরমধ্যে কন্টেনারমুভারসহ বহু গাড়ি ব্রিজটির ধারণক্ষমতার বেশি ওজন নিয়ে চলাচল করে। ৬০ বছরেরও বেশি পুরনো ব্রিজটির স্ট্রাকচারাল আয়ুষ্কাল হারাতে বসেছে। নানাভাবে জোড়াতালি দিয়ে ব্রিজটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজটির পিলার, গার্ডার এবং ক্রস গার্ডারে শত শত ফাটল দেখা দিয়েছে। ব্রিজের গুরুত্বপূর্ণ পিলারগুলোর রড বের হয়ে পড়ায় পুরো ব্রিজটিই চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সূত্র জানিয়েছে, ব্রিজটির নিজস্ব ওজন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে ডেথ ওয়েটও। ‘ডেথ ওয়েট’ বেড়ে যাওয়ায় এটির বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, ব্রিজ রক্ষণাবেক্ষণের স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে রিসাইক্লিং কার্পেটিং। অর্থাৎ ব্রিজের সেল্ফওয়েট যাতে না বাড়ে সেজন্য ব্রিজের উপরের রাস্তা কার্পেটিং করার সময় আগেকার কার্পেটিং পুরোপুরি তুলে ওই খাদের মধ্যেই নতুন করে ঢালাই দেওয়া হয়। এতে ব্রিজ সংস্কার হয়, কিন্তু ওজন বাড়ে না। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ব্রিজটির উপর দিয়ে প্রায় প্রতিবছরই কার্পেটিং করেছে। রাস্তা সংস্কারের জন্য করা এই কার্পেটিং ব্রিজের উপর রাস্তার উচ্চতা অন্তত দেড় থেকে দুই ফুট বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে ব্রিজের ওজন বেড়েছে হাজার হাজার টন। যা ব্রিজের ধারণক্ষমতাকে চরমভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ব্রিজটির উচ্চতা নিয়েও রয়েছে সংকট। বিদ্যমান ব্রিজটি ভূমি থেকে পাঁচ মিটারের মতো উঁচু। অথচ রেলওয়ের নিয়মানুযায়ী বর্তমানে ব্রিজের উচ্চতা ৮.৫ মিটার করার কথা। বিদ্যমান ব্রিজে তা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। এই ব্রিজটি ট্রান্স এশিয়ান রেল যোগাযোগ প্রকল্পের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠবে বলে আশংকা প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের আওতায় চলাচলকারী ট্রেনগুলো যে গতি নিয়ে চলাচল করবে এবং যেভাবে ঝাঁকুনি তৈরি করবে তাতে এই ব্রিজ টিকে থাকবে কিনা সংশয় রয়েছে। বর্তমানেও স্বল্পগতির ট্রেন চলাচলের সময় ব্রিজটি কাঁপে। এই ব্রিজ সংস্কার নয়, দ্রুত রিমুভ করে নতুন করে ব্রিজ নির্মাণ জরুরি বলেও বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো মন্তব্য করেছেন।
চট্টগ্রামের স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের স্টাকচারাল আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেছে। এটি নানাভাবেই একটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ। এই ব্রিজটিকে জরুরি ভিত্তিতে রিমুভ করে নতুন ব্রিজ নির্মাণ করা দরকার। তিনি বলেন, ব্যাপারটি যত তাড়াতাড়ি ঘটবে ততই চট্টগ্রাম স্বস্তিতে থাকবে।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন লাইফ ফুরিয়ে যাওয়ায় এবং শত শত ফাটল তৈরি হওয়ায় এটি আর সংস্কারের পর্যায়ে নেই। ব্রিজটি সংস্কার করে খুব বেশি সুফল মিলবে না। এটি ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি ব্রিজটিতে করোশান ধরে ফেলার কথা উল্লেখ করে বলেন, এতে ব্রিজের রডগুলো ফুলে উঠেছে। যার ফলে ব্রিজে শত শত ফাটল তৈরি হয়েছে। করোশানের ফলে ব্রিজটির ওই সময়কার নিম্নমানের রডের অবস্থাও শোচনীয়।
ব্রিজটির পুরোপুরি দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। সিটি কর্পোরেশনই ব্রিজটি রক্ষণাবেক্ষণ করে। ব্রিজটির বেহাল দশা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম মানিক দৈনিক আজাদীকে বলেন, সাত-আট বছর আগে আমরা একবার পুরনো সলিং তুলেই নতুন করে ঢালাই করেছিলাম। মাঝখানে যেখানে যেখানে গর্ত হতো তা রিপেয়ার করে দেয়া হতো। সবসময় পুরোটা তুলে না করার কারণও আছে। ব্রিজটি দিয়ে গাড়ির চাপ বেশি। পুরোটা তুলে ঢালাই করতে গেলে সময় লাগে। যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। যানজট লেগে গেলে ট্রাফিক বিভাগ আপত্তি দেয়। তাই পুরোটা তুলে করা সম্ভব হয়নি। তবে এবার পুরোনো ঢালাই সম্পূর্ণ তুলেই নতুন করে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেও ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম মানিক জানান।

সূত্রঃ দৈনিক আজাদী, ৩০ আগস্ট ২০২১