মতামত

শহীদ আব্দুর রবের কবরের উপর কোন স্থাপনা নয়

– জসিম উদ্দিন চৌধুরী

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার ভাই শহীদ সাইফুদ্দিন চৌধুরী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চাকসুর প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শহীদ আব্দুর রব সহ কিছু মুক্তি পাগল তরুন ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারত গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেণিং শেষে দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধ করবেন এবং দেশকে হানাদার মুক্ত করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সাল, তারা একটি জীপে করে রাঙ্গুনিয়া-কাপ্তাই রুট দিয়ে ভারতের উদ্দশ্যে রওয়ানা দিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে তারা তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) এর অদূরে পাক হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হন। তাদের আর ভারতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। শহীদ হন আমার বড় ভাই সাইফুদ্দীন চৌধুরী, আব্দুর রব, স্বপন চৌধুরী, দ্বীপেন চৌধুরী, বোয়ালখালী আওয়ামীলীগ নেতা মোজাফফর আহামদ এবং তাদের গাড়ীর চালক ইউনুছ। স্থানীয় কিছু ব্যক্তি উদ্যোগ নিয়ে চুয়েটের সামনে তাঁদের কবর দেয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আমার ভাইয়ের আইডি কার্ডের ছবি দিয়ে দৈনিক আজাদীতে বিজ্ঞাপন ছাপানো হলে যারা কবর দিয়েছেন তাদের মধ্যে কায়সার নামে এক ভদ্রলোক নিজে এসে আমাদেরকে বিষয়টা নিশ্চিত করেন। কিন্তু আমার বড় মায়ের অবুঝ মন কখনো মানতে চাইতোনা তাঁর ছেলে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। আমার বড় মায়ের দিকে তাকালেই আমার কানে বাজতো মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের সেই অমর গান – “সেই রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে এক মধ্যবয়সী নারী এখনো রয়েছে হাত বাড়িয়ে খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে, কবে ফিরবে নাকি ফিরবে না ?” আমার বড় মাও কত রজনী জেগে ছিলেন? কত দিন ছেলের অপেক্ষায় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে ছিলেন? ছেলে যদি কখনো ফিরে আসে …? এটা যেমন আমার বড় মায়ের ক্ষেত্রে সত্য ছিল তেমিনি শহীদ আব্দুর রব সহ ত্রিশ লক্ষ শহীদের মায়ের ক্ষেত্রেও সত্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন কিংবা মুক্তিযুদ্ধ পরবরতী ত্রিশ লক্ষ শহীদের মা যেন রফিকুজ্জামানের সে অমর সৃষ্টি মধ্যবয়সী নারী হয়ে উঠেছিলেন। শহীদ আব্দুর রবের বাবা রেলের কর্মচারী ছিলেন। সেই সুবাদে আব্দুর রবের পরিবার সিআরবি এলাকায় থাকতেন। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে শহীদ রবের মায়ের অনুরোধে তাঁর কবর সিআরবিতে স্থানান্তরিত হয়। তার মাত্র এক-দেড় কিলোমিটারের মধ্যে দামপাড়া পল্টন রোডস্থ আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম মন্ত্রীসভার সদস্য চট্টগ্রামের গণমানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীর কবরের পাশে শুয়ে আছে আমার বড় ভাই শহীদ সাইফুদ্দিন চৌধুরী। ২০০৯ সালে আমার ভাইয়ের করবও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এখানে সমাহিত ও স্থানান্তরিত হয়। এভাবে বিভিন্ন দেশের জাতীয় বীরদের কবর স্থানান্তরের বিষয়টি আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়। যেমন সেন্ট হেলেনাকে নির্বাসনের পর ফ্রান্সের জাতীয় বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কবর সম্মানের সাথে স্থানান্তরিত করে প্যারিসের রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে সমাহিত করা হয়। এবার সিআরবি প্রসঙ্গে ফিরে আসি। প্রাণ প্রকৃতিতে ভরা এই সিআরবি এলাকায় প্রতিদিন প্রচুর মানুষের জমায়েত হয়। এখানে রয়েছে নানা প্রজাতির শতবর্ষী বৃক্ষ, রয়েছে অনেক ঔষধি গাছ, বিলুপ্ত ঘোষিত এবং ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে এমন গাছও এখানে আছে। বৈশাখী মেলাসহ অনেক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মিলন মেলা হয় সিআরবির সিরিশ তলায়। আর এ সকল অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে অথচ এখানে আগত বেশিরভাগ মানুষই জানতোনা যে, এই এলাকায় একজন জাতীয় বীর শুয়ে আছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান কর্তা ব্যক্তিরা জানেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সম্প্রতি সরকার এবং সিআরবি কর্তৃপক্ষ বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল সহ তার পেছনে ৬ একর জমিতে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপের ভিত্তিতে ইউনাইটেড গ্রুপের মাধ্যমে হাসপাতাল নির্মানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ছয় একর জায়গার মধ্যে শহীদ আব্দুর রবের কবরও রয়েছে। শহীদ আব্দুর রবের কবরের উপর কোন স্থাপনা তৈরি হলে মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা এবং শহীদ সাইফুদ্দিন, শহিদ আব্দুর রব সহ ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের সাথে বেইমানীর সামিল। সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামবাসী প্রায় দীর্ঘ তিন মাস যাবত আন্দোলন পরিচালনা করে আসছেন। দুই-একজন স্বার্থান্বেসি মহল ছাড়া সমগ্র চট্টগ্রামবাসী আন্দোলনের পক্ষে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। যারা সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মানের পক্ষে অবস্থান নিবেন তাদেরকে চট্টগ্রামবাসী কখনো ক্ষমা করবেননা। তারা চট্টগ্রামবাসীর নিকট ঘৃণিত ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত হবেন এবং ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। চট্টগ্রামবাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য বলা হচ্ছে, সিআরবিতে হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে নেয়া হয়েছে। যারা এই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি জানেন এখানে শহীদ আব্দুর রবের কবর আছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি জানেন সিআরবি চট্টগ্রামের একমাত্র ফুসফুস এবং সিআরবি যদি ধংস হয়ে যায় তাহলে চট্টগ্রামের মানুষের নিঃশ্বাস নেয়ার আর কোন জায়গা থাকবেনা? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি জানেন চট্টগ্রামের প্রায় শতভাগ মানুষ সিআরবিতে হাসপাতাল হোক সেটা চান না? নিঃসন্দেহে জানেন না। প্রধান মন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে যদি এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়া যায়? তাহলে আন্দলোনকারীদের দায়িত্ব সঠিক বিষয়টা বুঝানোর উদ্যগ নেয়া। আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথভাবে বুঝাতে সক্ষম হলে তিনি সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মানের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিবেন।

২০১৮ সালে ১৮ এপ্রিল আমরা বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী এবং  শহীদ আব্দুর রব এর স্মরণসভা আয়োজন করেছিলাম। উক্ত স্মরণসভায় আমি সভাপতিত্ব করেছিলাম এবং অতিথি হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির মাননীয় চেয়ারম্যান শাহজাহান খান উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা দুজনই আওয়ামীলীগ সরকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। দুজনই কথা দিয়েছিলেন শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী এবং  শহীদ আব্দুর রব এর কবর সংরক্ষণের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেয়া হবে। আমরা আশা করবো কথাটি তাঁরা মনে রেখেছেন।

বাহাদুরশাহ ছিলেন মোগল সালতানাতের শেষ সম্রাট। তাঁকে গ্রেফতারের পর বার্মায় নেয়ার পথে উর্দু ভাষা জানা কিছু ইংরেজ অফিসার বাহাদুর শাহকে ব্যাঙ্গ করে বলেছিলেন,

“দাম মে দাম নেহিয়ে
আপ খেইর মাগো জানকি
হে জাফর আপ মায়ান হো চুকিহে
শামসের হিন্দুস্থান কি ……”

এর অর্থ হচ্ছে, এখন তোমার জীবনের শেষ দিন। আমাদের কাছে তোমার প্রাণ ভিক্ষা চাও। হিন্দস্থানের তলোয়ার ভেঙ্গে গেছে।

উত্তরে সম্রাট বাহাদুর শাহ বলেছিলেন,

“হিন্দিয়ে মে বু রেহেগি
জাব তালাক ঈমান কি
তাখতে লানদান তাক চালেগি
তেঘ হিন্দুস্থান কি…”

অর্থাৎ যতক্ষন ঈমানের সুগন্ধ থাকবে, ততক্ষণ হিন্দুস্থানের তলোয়ার চলবে।

আমরাও সম্রাট বাহাদুর শাহের মত বলতে চাই, চট্টগ্রামে মরহুম জহুর আহামদ চৌধুরী এবং মরহুম মহিউদ্দিন চৌধুরীর লাখো উত্তরসূরি এখনো বেঁচে আছে। এই দুই জন নেতার একজন উত্তরসূরিও যদি বেঁচে থাকে তাহলে চট্টগ্রামবাসীর উপর চাপিয়ে দেয়া কোন অন্যায়-অবিচার কখনোই মেনে নেয়া হবেনা। চট্টগ্রামের ফুসফুস সিআরবিতে  কোন হাসপাতাল বা বাণিজ্যিক স্থাপনা করতে দেয়া হবেনা।

লেখক, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারবর্গ।