শিল্প সাহিত্য

অপেক্ষা

– শাহীন আকতার হামিদ

আজ একটা অজানা ফোনে ঘুম ভাংলো। রয়েল লন্ডন থেকে ফোন করে একজন কেউ বললেন, ”আমাদের হাসপাতালে আজ একজন ইন্ডিয়ান বাঙ্গালী মহিলা মারা গেছেন তার বয়স পাসপোর্ট অনুযায়ী ৭১ বছর। সে দীর্ঘদিন ধরে এ হাসপাতালেই ছিলো। তার কোন আপনজন নেই তাই ব্যাগ খুঁজে একটি ছোট ডায়েরী পেয়েছি সেখানে লন্ডনের আরো কয়েকটি নাম্বারের সাথে এ নাম্বারটি আছে, তাই ফোন করলাম।”

মনে পড়ে গেল তার কথা।

অপারেশান থিয়েটার থেকে মিরনকে রিকভারী রুমে নেয়ার পরে আমাকে  জানান হল শীঘ্রই তাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে দেয়া হবে। বলা হল ইনটেনসিভ কেয়ারের অপেক্ষমান জায়গাটিতে অপেক্ষা করতে। আমি সহজভাবে বসতে পারছিলাম না, অস্থির হয়ে আছি।  দুপুর দু’টো থেকে সেখানেই অপেক্ষা করতে  থাকলাম। অনেক মানুষ অপেক্ষা করছে প্রিয়জনকে দেখার জন্য। নানা দেশের নানা মানুষ। কেউ কাঁদছে, কেউ কফি খাচ্ছে, কেউ আড্ডা দিচ্ছে, কেউ বা চুপচাপ বসে আছে।  আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল জানলার কাছে বসা মহিলা, অনেকক্ষণ ধরে তিনি আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি বার বার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। তাকাতেই  হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন। শুদ্ধ ব্রিটিশ ইংরেজিতে জানতে চাইলেন আমি কোথাকার, এবং এখানে কার অপেক্ষায়। বললাম বাংলাদেশের ও আজ বরের অপারেশন হয়েছে, তাই অপেক্ষা করছি যদি দেখতে পাওয়া যায়।  তিনি হেসে বাংলায় বললেন আমি কলকাতার মেয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আপনি কাকে দেখতে এসেছেন।  দেখতে আসার মতো কেউ নেই, হাসলেন, বললেন এমনিই হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই।   এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে আমি সপ্তাহের ছয়দিন এখানে থাকি আর একদিন বাসায় থাকি। ওরাই এম্বুলেন্সে করে দিয়ে আসে। সারাদিন নিজের ঘরে কাটাই, গান শুনি, কোন একটা বাংলাদেশি খাবারের দোকানে ফোন করে ভাত মাছ আনাই, পেট ভরে খাই। একদিন পরে ওরাই আবার হাসপাতালে নিয়ে আসে। বললেন নানা জাতীয় অসুখ আমার, জানতে চেওনা।

এরপর আমি যতদিন মিরনকে দেখতে হাসপাতালে গেছি ততদিনই তার সাথে  দেখা হয়েছে। দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মিরনের কাছে থেকে যখন  বেরিয়ে আসতাম, দেখতাম সে বসে আছেন ওয়ার্ডের বাইরে। আমরা পাঁচ তলায়  গিয়ে চা খেতাম ও গল্প করতাম। নানা গল্প!

তার নাম সে আমাকে কোনদিন বলেনি। তার গল্পগুলোর মধ্যে একটা সন্দেহ ও ভয় কাজ করত। মাঝে মাঝে বলতো, “টিউবে সবার পরে উঠবে ও সবার শেষে নামবে। খেয়াল রাখবে তোমাকে কেউ যেন ধাক্কা না দেয়। কাউকে বিশ্বাস  করবেনা। সাদা চামড়া এড়িয়ে যাবে ওরা সব কেড়ে নেয়।“ এ ধরণের কোন কথা বলার পরেই তিনি আনমনা হয়ে যেতেন, সেদিন আর কোন কথা বলতেন না। একদিন আমার ব্যাগ দেখে বললেন, “তোমার ব্যাগে তালা দাওনি কেন ?” বললাম তালা কেন দিব, বললেন, “কেউ কিছু চুরি করতে পারে।“

কলকাতার সম্ভ্রান্ত পয়সাওয়ালা বাড়ির মেয়ে তিনি। মা বাবার প্রথম সন্তান, ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছেন। লন্ডনে পড়তে এসেছিলেন। মা বাবা চলে যাওয়ার পরে আর দেশে ফেরা হয়নি। ভালই ছিলেন। পনের বছর আগে একবার কলকাতা গিয়েছিলেন, কিছুই ভাল লাগেনি। ছোট দুই ভাইবোন ও তাদের সংসারে কেউই আশ্রয় দিতে চায়নি তাকে তাই হোটেলে ছিলেন। ফেরার সময় তাদের  কাউকে বলে আসেনি, ইচ্ছে হয়নি। এখানেও কোন সংসার হয়নি, তাই একেবারেই একা, বললেন, “ভালই আছি। কারো কাছে কিছু চাওয়ার নেই, তাই না পাওয়ার কষ্টও নেই।“

মিরনকে নিয়ে ঘরে ফিরলাম শুক্রবার আর সেদিনই তার নিজের ঘরে ফেরার  দিন। আগের দিন অনেক গল্প বললেন, ভালবাসা ও না ভালবাসার গল্প। আমি একটুকরো কাগজে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম, ফোন করবেন। তিনি হাসলেন, বললেন, “আমায় দেখতে আসবে?” বললেন, আমি নার্সদের যেদিন তোমাকে ফোন করতে বলব সেদিন এস।

না, আমাকে অনেকদিন কেউ ফোন করেনি। অপেক্ষায় ছিলাম!!  আজ আমি সে ফোনটি পেলাম।  হাসপাতালের সে কন্ঠটি জানতে চেয়েছিলো আমি আসবো কিনা, কিছু বললাম না। এরপর বলল, আমি কি তাকে দাহ করার কাগজে সই করতে পারবো,  কিছুই বললাম না। এরপর বলল, আমরা ১২টার মধ্যে তাকে দাহ করবো। এবার আমি বললাম হ্যা আমি তার আত্মীয়, রক্তের নয় আত্মার। তিনি আমায় বলেছিলেন তার নার্সকে দিয়ে ফোন করাবেন, আজ সে ফোন পেলাম। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা। ইতস্তত করে বললাম দাহ করে ফেলুন।

সেই রয়েল লন্ডন হাসপাতালের কন্ঠটি আমায় আরো জানিয়েছিল, ইস্ট লন্ডনের ইলফোরডে তার একটি এক রুমের সরকারী বাসা আছে, কোন উত্তরাধিকারের নাম না থাকার কারণে তা সরকার ফিরিয়ে নেবে বলেছে, তার কিছু জিনিসপত্র আছে, সেগুলো কি তুমি নেবে?” বললাম না, ইলফোরডের ক্যান্সার রিসার্চের যে শাখা আছে সেখানে খবর দাও, ওরা যা দরকারি মনে করে তা নেবে বাকিটা ফেলে দেবে ।

এ কদিনের ঝকঝকে রোদের সাথে আজকের আকাশের কোন তুলনা হয়না, মেঘলা মন খারাপ করা আকাশ। মনে মনে তার উদ্দেশ্যে বললাম, তোমার জন্য কাঁদার কেউ নেই, তাই প্রকৃতি কাঁদছে। আমাকে তুমি ফোন করনি, বলনি হাসপাতালের কোন ওয়ার্ডে তুমি থাক, তোমার বাস কোথায় ছিলো তাও বলনি,   শুধু বলেছিলে আমার নার্স তোমায় ফোন করবে, কথা রেখেছো! বলেছিলে তোমায় দেখতে যেতে, না যাবোনা, তুমিতো এখন নেই হয়ে গেছো আমি মৃত মানুষের চেহারা দেখতে চাইনা, তুমি আমার কাছে জানালার কাছে বসে থাকা সেই সুন্দর চেহারার মানুষটি হয়ে বেঁচে থাকো । যে ভালবাসার মানুষটির গল্প তুমি  আমায় করেছিলে, তাকে আমি ক্ষমা করলাম না। তুমি বলেছিলে, “প্রথম দিকে আমরা ভালই ছিলাম। দুজনেই ভর্তি হয়েছি কিংস কলেজে। আমি অংকের ছাত্রী আর সে বায়োলজির।  সংস্কার ভাংতে চাইনি, আমি তার সাথে এক বাড়িতে  থাকতে অস্বীকার করেছিলাম। বলেছিলাম চল পড়া শেষ করে দেশে যাই, বিয়ে করে ফিরে আসবো ও সংসার করব। না আমার ভালবাসার মানুষটি আমার জন্য অপেক্ষা করেনি।”

তোমাকে ফেলে সে ইংরেজী  বান্ধবীর সাথে ঘর বেঁধেছিল, তোমাকে দিয়েছিলো মানুষকে অবিশ্বাস করার  অসুখ, যা তুমি নিজেই বলেছো “কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা, মনে হয় ঠকাবে” , এ এক ভয়াবহ রোগ, এখান থেকে নিজের মুক্তি নিজে না আনলে কোন ভাবেই আর মুক্ত হওয়া যায়না। এবার তুমি মুক্তির স্বাদ পেলে, একঘন্টা পরে তোমার শরীর ছাই হয়ে যাবে। ভাল থেকো।

তোমার জন্য আমার অপেক্ষার দিন শেষ!