মতামত

আগস্টের দিনগুলি (১) – তিরিশ বছর পর

– বিজন সাহা

নারুদা বলে আমাদের এক সিনিয়র বন্ধু গল্প করতেন, “আমার দাদা কয়েকদিন পরপর দাড়িগোঁফ রাখে আবার ক’দিন পরেই ছেঁটে ফেলেন। বলেন এটা গরীবের ফ্যাশন, রাখতেও পয়সা লাগে না, কাটতেও না। “আমার মত লোকেরা যাদের খুব বেশি পয়সাও নেই আবার বাহারী দাড়িগোঁফও নেই – তারা ফ্যাশন করবে কি করে? অন্যেরা কি করে জানি না, তবে আমি মাঝেমধ্যে ঘরের টেবিলচেয়ার, বইপত্র এদিক ওদিক করে ফ্যাশন করি। এ যেন লেনিন সুব্বোতনিক, এ বছর এখানকার ময়লা সেখানে ফেল তো পরের বছর সেখানকার ময়লা এখানে।  এমন এক সকালে ঘরের আসবাবপত্র এদিক ওদিক করার সময় দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলে দেখি শাহীন দাঁড়িয়ে। শাহীন, মানে শাহীন আক্তার হামিদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। এখন পি এইচ ডি করছে দনেপ্রোপেত্রভস্কে। মস্কো এলেই দ্বিজেন কাকুর ওখানে উঠত। ওখানেই পরিচয়। কাকুরা ক’দিন আগে চলে গেছেন গ্রীষ্মের ছুটিতে ইংল্যান্ড বেড়াতে। ও রয়ে গেছে।  কিন্তু ওকে চা খাওয়া তো দূরের কথা ঘরে ঢুকতেও বলতে পারলাম না। গতকালের এই অনিচ্ছাকৃত পরিস্থিতির জরিমানা হিসেবে আজ সকালে ওকে চায়ের নেমন্তন্নে ডেকেছি।  বেশ ক’দিন হল ঘুমটা ভালো হচ্ছে, খিদেটাও বেড়েছে। তাই ন’টা বাজতে না বাজতেই উঠে পড়েছি ঘুম থেকে। শাহীন আসবে সকাল দশটায়। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করলেও অপেক্ষা করছি। শত হলেও ভদ্রতা শব্দটি তো উঠে যায়নি পৃথিবী থেকে!
ঘুম ভাঙলেই যে কাজগুলো প্রথমে করি তা হল ঘড়ি দেখা আর পর্দার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা।  জেগে উঠেই উজ্জ্বল নীলাকাশ আর হাসিখুশি মেঘ না দেখলে মেজাজ বিগড়ে যায়। শীতপুরী মস্কোতে সূর্য খুব একটা দেখা যায় না। এবার গ্রীষ্মেও তার দেখা নেই। প্রায়ই ছিঁচকাঁদুনে বৃষ্টি। মস্কোতে রোদ ভরা দিনগুলো যেমন হাসিখুশি, বৃষ্টি ভেজা দিন তেমনই গোমড়া, বিষণ্ণ;  দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়। কী ধূসর, কী বিষণ্ণ যে মেঘে ঢাকা মস্কোর আকাশ!

আজও বাইরে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। আরেকটা সূর্যহীন দিন, মেঘের চাদর গায়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকা আরেকটা দিন। সেতারে নিখিল ব্যানার্জির মেঘ রাগ বাজছে, চায়ের জল ফুটছে শোঁ শোঁ করে।  সাড়ে দশটা বাজতেও শাহীন না আসায় ভদ্রতায় ক্ষান্ত দিয়েছি। কিছু না খেলেই নয়। ক্যাসেটটা বদলিয়ে দেবব্রতের বর্ষার গান বসিয়ে কেবলই কসমোলজির একটা প্রবলেম দেখতে শুরু করেছি, দরজায় টোকা পড়ল। “সরি ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল” বলে শাহীন ঘরে ঢুকল। এই বৃষ্টি ভেজা দিনে কে-ই বা সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে? অনেকেই ওঠে। এমন রাতে অনেকে ঘুমায়ই না। সে কথা পরে।

চা খেতে খেতে আমরা আইভাজভস্কি, সেরভ, শিশকিন, ব্রুলভ আর ৎসিয়ানের এ্যালবাম দেখছিলাম। এমন সময় ঘরে ঢুকল আমার রুমমেট ইয়েভগেনি।

“আমি মস্কোর রাস্তায় ট্যাঙ্ক দেখে এলাম। ব্যাপার কি, কিছু জানিস?” ঢুকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আমার উদ্দেশ্যে। “কই, নাতো। গতকাল বিবিসি ইয়েলৎসিন আর নাজারবায়েভের নাগোরনি কারাবাখ সম্পর্কে গরবাচভকে হুঁশিয়ার করে দেওয়ার খবর দিয়েছে। এছাড়া সায়ুজ (সোভিয়েত ইউনিয়ন) সম্পর্কে অন্য কোন খবর ছিল না।“
“এটা মস্কোয় ট্যাঙ্ক নামানোর কারণ হতে পারে না” বলেই চলে গেল ইয়েভগেনি।

আমরা আবার ছবি দেখায় মন দিলাম। বেলা তখন ১ টা, ১৯ আগস্ট ১৯৯১।

প্রায় আধঘণ্টা পরে শাহীন চলে গেলে জামাকাপড় পড়ে বেরুচ্ছি খেতে যাব বলে। করিডোরে দেখা রেজার সাথে।

“সব তো বন্ধ হয়ে গেল। অলরেডি চে পে।”

“মানে?”

“মানে আবার কি? জরুরী অবস্থা (রাশান ভাষায় জরুরী অবস্থাকে বলে চ্রেজভিচায়নয়ে পালাঝেনিয়ে বা সংক্ষেপে চে পে)। গরবাচভ ক্ষমতাচ্যুত। ইনায়েভ, পাভলভরা ক্ষমতা নিয়েছে।“

“হতেই পারে না। ঠাট্টা করছ।“ অবিশ্বাস ভরে মাথা নাড়ালাম আমি। যতক্ষন পর্যন্ত না নিজকানে বিবিসি শুনলাম, নিজ চোখে দেখলাম টিভি বুলেটিন ততক্ষন পর্যন্ত এই অবিশ্বাস ছিল। গরবাচভ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন বলে যে দুঃখ পেয়েছি তা নয়, কষ্ট লাগছিল গণতন্ত্রের জন্যে, বাক স্বাধীনতার জন্যে। ভয় পেয়েছিলাম কমিউনিস্ট ত্রাসের আগমনের আশঙ্কায়। গরবাচভকে প্রথম দিকে সাপোর্ট করলেও তাঁর প্রতি মোহ কেটেছে অনেকদিন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্রুচকভ, পাভলভ, ইনায়েভদের নিজের চারপাশে জড়ো করার পর থেকেই বরং তাঁর বিরোধী হয়ে উঠেছিলাম এই অর্থে যে তাঁর মিশন শেষ। এখন উচিত বরং     রেডিক্যাল কারো হাতে ক্ষমতা দিয়ে কেটে পড়া। তবুও এভাবে গরবাচভের অপসারনে খারাপ লাগছিল। এলেনা বোনার (আন্দ্রে শাখারভের স্ত্রী) যেমন লিখেছিলেন “আমি কখনই গরবাচভের ভক্ত ছিলাম না, আবার তাঁর শত্রুও নই। ……… ভাবতে চাই না যে তিনি নেই। তাঁর ভালমন্দ দোষত্রুটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার মালিক আমরা, তারা (ইনায়েভ অ্যান্ড কোং) নয়।“ মনে করার চেষ্টা করলাম পুরানো ঘটনাবলী। ইনায়েভ যেদিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন, এক সাংবাদিক অনেকটা এ ধরণের প্রশ্ন করেছিলেন “আপনার সাথে তো গরবাচভের বিভিন্ন প্রশ্নে দ্বিমত। কাজ করতে পারবেন কি?” উত্তর শুনে বুঝতে পেরেছিলাম এর কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। এতো রক্ষণশীল মানুষ পেরেস্ত্রইকার হাল ধরতে পারে না। মনে পড়লো পাভলভের নাদুসনুদুস মুখখানা। আসলে এই ইনায়েভ অ্যান্ড কোং প্রথম দর্শনেই  এমন এক বিরূপ অনুভুতির জন্ম দেয় যে আপনা থেকেই মন এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ওঠে।

ঠিক করলাম, ঘরে বসে না থেকে সেন্টারে যাব। নিজের চোখে দেখব ব্যাপারখানা। এছাড়া টিভিতে ইনায়েভদের সাক্ষাৎকার দেখে বুঝেছিলাম তেমন কড়াকড়ি নেই। ওকে দেখে লাগছিল ঠিক যেন যাত্রার দলের রাজা। আত্মবিশ্বাসে তার এতো ঘাটতি। এই লোক যে কীভাবে ক্যু করলেন ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওঁর সাক্ষাৎকার দেখে আমরা সবাই হেসে খুন। গরবাচভকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে এ সহজ সত্যটা স্বীকার করার মত হিম্মৎ পর্যন্ত নেই। বলে কিনা, “গরবাচভ আমার বন্ধু। এখন অসুস্থ, চিকিৎসা চলছে। সেরে উঠলেই এসে কাজে যোগ দেবেন বলে আশা করি।“ অথবা গরবাচভের শাস্তির প্রশ্ন উঠলে বলে, “মিখাইল গরবাচভ সম্মানীত ব্যক্তি। তাঁর শাস্তির প্রশ্নই ওঠে না।“ এক কথায় ক্যু’র পর থেকেই ইনায়েভ অ্যান্ড কোং  সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। সব দেখে শুনে সেন্টারে যাওয়া আশঙ্কাজনক হবে না বলেই মনে হচ্ছিল। তবে বন্ধুদের অনেকেই বাধা দেওয়ায় সেদিন আর যাওয়া হল না।  সকালের বিষণ্ণ আকাশ ইতিমধ্যেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। ভীত, হতচকিত মানুষের প্রাণের আর্তি  মিশেছে আকাশের সে অশ্রুবর্ষণে।

সেন্সরের  বেড়াজাল টপকে রাতের খবরে এল ইয়েলেৎসিনের দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বেলি দম বা রাশান ফেডারেশনের সুপ্রীম সোভিয়েতের সামনের রাস্তায় দেখা গেল নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং তাকে ঘিরে ব্যারিকেড তোলার দৃশ্য। এছাড়া মৌখিক খবরও আসতে লাগল একটু আধটু করে। ২০ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠেই ক্যামেরা হাতে  সোজা ছুটলাম রেড স্কয়ারের দিকে। সতর্কতার জন্যে প্রথমে ঢুকলাম রেড স্কয়ারের সাথেই মস্কোর সবচেয়ে দোকান গুমে। রেড স্কয়ারে ঢোকার পথ বন্ধ। বিশেষ পারমিশনে ঢুকছে কেউ কেউ। এদিকে কোন ট্যাঙ্ক বা সাঁজোয়া গাড়ি না দেখে ভাবলাম “ক্যু কি শেষ হয়ে গেল?” এদিক ওদিক তাকিয়ে খানিক ঘুরে মস্কো হোটেলের সামনে আসতেই চোখে পড়লো সাঁজোয়া গাড়ির সারি।  তাদের ঘিরে মানুষের ভিড়। এক সৈনিককে দেখলাম ছোট এক বাচ্চাকে কোলে তুলে দেখাচ্ছে সাঁজোয়া গাড়ির ভেতরটা। চটপট ছবি তুলে এগুলাম সামনের দিকে। সৈন্যদের ঘিরে ধরেছে মানুষ। এক বুড়ি শুনলাম সৈন্যদের বলছে, “তোমরা এখানে কাকে রক্ষা করছ? ঐ দস্যুদের? যাও, বেলি দমে যাও। ওখানে আমাদের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তাকে গিয়ে রক্ষা কর।” কেউ তার সমর্থনে বলছে, কেউ বা বিপক্ষে। গেকাচেপে মানে জরুরী অবস্থাকালীন রাষ্ট্রীয় কমিটির পক্ষেও আছে কেউ কেউ। সেটাও বোঝা যাচ্ছে বেশ। বেশ মজাই লাগছিল। বলতে গেলে ক্যুর দেশেই আমার জন্ম। ১৯৬৪ সালে আয়ুব শাহীর আমলে জন্ম নিয়ে ১৯৮৩ পর্যন্ত যে উনিশ বছর দেশে ছিলাম ১৯৭২ থেকে ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে তিন বছর বাদ দিলে বাকি সবটাই কেটেছে স্বনামী বা বেনামী সামরিক শাসনে। তিন তিনটে ক্যু তো দেখলাম নিজের চোখেই। তাই সব দেখে কেন যেন মনে হল এ ক্যু টিকতে পারে না, সাত দিনের বেশি তো নয়ই।

পেরেস্ত্রোইকার ধাক্কায় রুশীদের কাছে আমাদের আদর কমে গেলেও মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের লোকেরা এখনও আমাদের দিকে তাকায়। ইন্ডিয়ান ভেবে ছুঁড়ে দেয় প্রশ্নের বাণ। বাঙ্গালিদের দমন করতে ইংরেজ যেমন গুরখা, রুশীদের দমন করতে জার যেমন কসাকদের ব্যবহার করত, তেমনি মস্কো নিয়ন্ত্রণ করতে ইনায়েভ ও তার কোম্পানি নিয়ে এসেছিল মধ্য এশীয় সেনা সমৃদ্ধ ব্রিগেড। আমাকে দেখেই হেসে উঠলো এক কাজাখ। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই কি আমাদের গুলি করবি?” (রুশ ভাষায় সমবয়েসীদের সাধারণত তুই করেই বলে, এদেশে আপনি আর তুইয়ের মাঝামাঝি কিছু নেই।) “গুলি করার আদেশ নেই, তাছাড়া আমাদের কাছে প্যাট্রনও নেই।” “যদি আদেশ দেয়?” “তবুও করব না। নিজের দেশের মানুষের উপরে কিছুতেই গুলি চালাব না।” “তোর কাছে যে প্যাট্রন নেই সেটা বিশ্বাস করি কিভাবে?” চার চারটে কার্তুজ বের করে ও বলল, “কোনটা দেখবি বল? সবগুলোই ফাঁকা।” নেড়েচেড়ে দেখে বললাম, “যাই বলিস, ক্যু সফল হবে না। দে না একটা ফাঁকা শেল, স্মৃতি হিসেবে রেখে দেব।” ওকে ইতস্তত করতে দেখে এগিয়ে এল এক রুশ ছেলে। একটা ফাঁকা শেল দিয়ে বলল, “রেখে দে স্মৃতি হিসেবে।” ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাচ্ছি, রুশ ছেলেটা ডেকে বলল, “ওপেনার হিসেবে ব্যবহার করিস।” পকেট হাতড়ে স্যুভেনির জাতীয় কিছুই পেলাম না। ভাবলাম, “ইস, যদি একটা বোতল থাকতো, ওকে দিয়েই শুরু করতাম বোতল খোলার কাজটা।”

ঐ জটলার মধ্যেই কয়েকজনকে দেখলাম মেগাফোন মানে লাউড স্পীকার দিয়ে সবাইকে আহ্বান করছে মস্কো সোভিয়েত চত্বরে সমাবেশে যোগ দিতে। সব দেখে তো চক্ষু স্থির। কয়েক শ’ ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ি এলো মস্কোতে, অথচ ক্যু হল কিনা বিনা রক্তে। সংখ্যাটা ঠিক মনে নেই তবে ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ি মিলে হাজার খানিক ছাড়িয়ে গেছিল। পাঁচ জনের বেশি সমাবেশ নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। অথচ খোদ রেড স্কয়ারেই কিনা চলছে সমাবেশের প্রচারণা। দোকানপাট যেমন মানুষে গিজ গিজ করছে, রাস্তায়ও তেমনি ঢল নেমেছে মানুষের। সেন্টারে ঘুরে মানুষ বানের জলের মত ছুটে চলছে মস্কো সোভিয়েত হয়ে বেলি দমের দিকে। বানের জলে ফেনার মত ভাসতে ভাসতে আমিও চললাম মস্কো সোভিয়েত অভিমুখে। গোর্কি স্ট্রীট (অধুনা তভেরস্কায়া) ধরে হেঁটে যাওয়া। মস্কোর প্রাণকেন্দ্রে ব্যস্ততম রাস্তার শিরদাঁড়া ধরে দিনে দুপুরে হেঁটে বেড়ানো – এও কি সম্ভব! সারা রাস্তা লোকে লোকারণ্য। মানুষ আর সৈন্যের ছড়াছড়ি। সব একাকার হয়ে গেছে আজ। সবার মুখে চোখে বিস্ময়! মানুষ যেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সৈনিকদের, সৈনিকরাও তেমনই হতবাক অগণিত মানুষের অবিরাম গতিতে। শুধু হাসি নেই অফিসারদের মুখে। সেখানে শুধুই পেশাদার কাঠিন্য। কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসের সামনে দেখলাম জেনারেলকে। তার বুকভরা ব্যাজের বাহার দেখে অন্তত তাই মনে হল। সৈন্য আর মানুষের উপর কি তার হম্বিতম্বি। কিছুটা হেঁটে পৌঁছে গেলাম মস্কো সোভিয়েত চত্বরে। সেখানে পড়ে শোনানো হচ্ছে ইয়েলেৎসিন আর হাজবুল্লাতভের আহ্বান। মানুষের পদভারে কম্পিত চত্বর। তিরতির করে কাঁপছে বাতাস সংগ্রামী প্রত্যয় মেশান শ্লোগান আর হাততালিতে।

বেলা হয়েছে বেশ। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত দেহ। খিদেটাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে হাঁটছি পাতাল রেলের দিকে। পুশকিন স্কয়ারে এসে দেখি খাঁ খাঁ করছে ম্যাকডোনাল্ড। কোথায় সেই বিশাল লাইন? ভোজবাজির মত কোথায় হারিয়ে গেছে সে? ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো ট্যাঙ্ক। সৈন্যদের ঘিরে ভিড় করেছে মেয়েরা। হাসছে। কথা বলছে। ট্যাঙ্কের উপর দাঁড়ানো সৈনিকের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে দুটো মেয়ে উঠে গেল তাতে। ওদের হাসির দমকে চিড়ে গেল বাতাসের বুক, যেন পাহাড়ের বুক বেয়ে নামল ঝরনার জল। কি যে ঘটছে চারিদিকে, বুঝে উঠতে পারছি না। একটা ক্যু যে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, সন্দেহ নেই যে ওরা সফল হলে এদেশ আবার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। সন্দেহ ছিল না তেমনি এদের অবশ্যম্ভাবী পরাজয়েও। বুঝছিলাম না শুধু এদেশের মানুষগুলোকে। এদের লাখ লাখ সৈন্য আর সাধারণ মানুষজনকে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, অথছ মানুষ কেমন শান্ত। অতি উৎসাহী কিছু লোক বাদ দিলে সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। বরাবরের মতই দোকানে দোকানে ভিড়। প্রেমিকের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত প্রেমিকা। সর্বত্র যেন উৎসব। মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় যে হাজার হাজার মানুষ তাতে সংগ্রামের, প্রতিরোধের, প্রতিবাদের চেয়ে নারদনয়ে গুলিয়ানিয়ে বা উৎসবের চরিত্রই প্রকট। যদিও যত জনকে জিজ্ঞেস করেছি প্রায় সবাই ক্যুর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে, সমর্থন ব্যক্ত করেছে ইয়েলেৎসিনের পক্ষে। শুধুমাত্র ট্যাঙ্কের পটভূমিতে ছবি তোলার জন্য কত লোক যে বেরিয়েছে রাস্তায়!

পাতাল রেলে ঢুকে দেখলাম জটলা পাকাচ্ছে মানুষ। হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ইয়েলেৎসিন, সিলায়েভ, হাজবুল্লাতভদের আহ্বান সম্বলিত লিফলেট

“রাশিয়ার জনগনের প্রতি”

১৮ আগস্ট ১৯৯১ দিবাগত রাতে দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। এই ক্ষমতাচ্যুতিকে  যেভাবেই যৌক্তিক প্রমানিত করা হোক না কেন,  ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলচক্র দ্বারা এই ক্ষমতা দখল অসাংবিধানিক। জনগণের শত দুঃখ-কষ্ট ও কঠিন অভিজ্ঞতা সত্বেও  দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গভীর হচ্ছে যা  কিনা পরিবর্তিত হবার নয়। কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য অসাংবিধানিক সংগঠনসমূহের ক্ষমতা যথেষ্ট খর্ব করে দেশের মানুষ নিজেদের ভাগ্যের মালিক হচ্ছে।  সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ার একতা রক্ষাকল্পে রুশ দেশের নেতৃত্ব ইউনিয়ন প্রসঙ্গে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান ইউনিয়ন চুক্তির প্রক্রিয়াকে গতি দিয়েছে, অন্যান্য প্রজাতন্ত্রের সম্মতি লাভ করতে সাহায্য করেছে। ঠিক  হয়েছে ২০ আগস্ট এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। ঘটনার এই ডেভেলপমেন্ট প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ক্ষুব্ধ করেছে, তাদেরকে এই জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে বলপ্রয়োগের মত দায়িত্বহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ সমাধানের পথে যেতে বাধ্য করেছে। এর আগেও সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালান হয়েছে। আমরা মনে করি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বিশ্বের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্মান ধূলিসাৎ করেছে, আমাদের শীতল যুদ্ধের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে, বিশ্ব সমাজে সোভিয়েত ইউনিয়নকে একঘরে করেছে।
এসব ঘটনা আমাদের বাধ্য করেছে তথাকথিত কমিটির ক্ষমতা দখলকে বেআইনি ঘোষণা করতে। আমরা এই কমিটির সমস্ত সিদ্ধান্ত ও আদেশ অবৈধ বলে ঘোষণা করছি। আশা করছি স্থানীয় সংস্থাগুলো রাশিয়ান ফেডারেশনের সংবিধান ও প্রেসিডেন্টের নির্দেশ মেনে চলবে।

আমরা জনগনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি এই সামরিক জান্তাকে রুখে দাঁড়িয়ে দেশকে স্বাভাবিক সাংগঠনিক বিকাশের পথে ফিরিয়ে আনতে। এখন প্রয়োজন দেশের প্রেসিডেন্ট গরবাচভকে জনতার সামনে তার বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দেওয়া। দরকার সুপ্রিম সোভিয়েতের জরুরী অধিবেশন ডাকা।

আমরা বিশ্বাস করি যে প্রিয় দেশবাসী এই অরাজকতা, এই আইনহীনতাকে গ্রহণ করবে না। সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে এবং এই প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যুত্থানে  অংশগ্রহণ না করতে। আমাদের দাবী আদায়ের জন্য অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানাচ্ছি। সন্দেহ নেই যে বিশ্ব নেতৃবৃন্দও এই ডানপন্থী অভ্যুত্থানের সঠিক  মূল্যায়ন করবে।

প্রেসিডেন্ট, রুশ ফেডারেশন                                          ইয়েলেৎসিন

প্রধানমন্ত্রী, রুশ ফেডারেশন                                          সিলায়েভ

ভারপ্রাপ্ত স্পিকার, রুশ পার্লামেন্ট                                     হাজবুল্লাতভ

১৯ আগস্ট ১৯৯১, সকাল ৯ ঘটিকা।

পরিচিত অপরিচিত কত লোকের সাথে যে ঐদিন কথা হয়েছে! অধিকাংশের চোখেমুখে বিস্ময় আর উৎকণ্ঠা। স্বস্তির নিঃশ্বাস যে কেউ কেউ ফেলেনি তাও নয়।  অনেকেই এই ভেবে খুশি হয়েছে যে অবশেষে আইন শৃঙ্খলা ফিরে এলো। এরকম কথা যে শুধু এদেশের মানুষই বলেছে তাই নয়, অনেক বিদেশী বন্ধুদের মুখেও একথা শুনেছি। পরে পত্রিকায় দেখেছি ও লোক মুখে শুনেছি যে এ নিয়ে ঢাকা, লন্ডন সহ অনেক জায়গায়ই মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। হায়রে কপাল – হায়রে শৃঙ্খলার পূজারী! এরাই আবার দেশে যখন সামরিক শাসন আসে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে বলে গলা ফাটান “দেশ গেল, গণতন্ত্র গেল” বলে। এরা কি বোঝেন না যে বেআইনিভাবে কখনও আইন প্রতিষ্ঠিত হয় না, যেমন কিনা শৃঙ্খল দিয়ে আনা যায় না শৃঙ্খলা।  তাহলে তো সারা পৃথিবীটাকেই জেলখানা বানাতে হয়। ঐ লোকগুলো হয়তো সচেতনভাবেই এটা চান। জেলে তো তারা যাবেন না, যাবে তাদের সাথে ভিন্ন মত পোষণকারীরা। আলো বাতাসে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলো যদি এক রকম না ভাবে, একই ভাবে না চলাফেরা করে, তাবে সাম্যবাদ আসবে কেমন করে? এর জন্যে যদি পাঁচ মহাসাগর রক্তে ভেসেও যায়, ভূস্বর্গ থেকে দেবতারা যদি নির্বাসিতও হন, দানবের সাম্যবাদ তবুও চাই-ই-চাই।

চলবে . . . .

পরবর্তী পর্ব ২২ আগস্ট প্রকাশ করা হবে

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া