পরোক্ষ! – শাহীন আকতার হামিদ
মিনু গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে হেঁটে মানুষকে একটা কথাই বোঝানোর চেষ্টা করে, “আপনারা কেউ ধূমপান করবেন না। যারা আপনাকে ভালবাসে তাদের জীবনে ধবংস টেনে আনবেন না। আমি আমার বরকে ভালবাসতাম, আমার বাচ্চারাও ভালবাসত, কিন্তু দেখুন আজ আমার কি অবস্থা হয়েছে। পরোক্ষ ধূমপান ও যে ধূমপান করে দু’জনেরই একরকম ক্ষতি হয়।” এটাকেই মিনু এখন জীবনের একমাত্র স্লোগান মনে করে। সবাইকে এ কথাটি বলে বেড়ায় গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে।
মিনু অনেক আগে একবার পত্রিকায় পড়েছিল “পরোক্ষ ধূমপানকে উপেক্ষা করবেন না। নিজের ভালোবাসার, কাছের প্রিয় মানুষগুলোকে ধূমপান করতে নিষেধ করার ব্যাপারে কখনো লজ্জা পাবেন না। এটা যেমন তাদের ভালোর জন্য ভালোবেসে করবেন, তেমনি নিজেকে ভালোবেসে নিজের ভালোর জন্যেও করবেন।”
মিনুর বিয়ে হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, যে বছর এ দেশের অকৃতজ্ঞ মানুষ স্বাধীনতার জনককে তাঁর পরিবারসহ গুলি করে মেরে ফেলে। এ বছরই সে তার উপজেলার কলেজ থেকে বিএ পাশ করে। জীবনে সে একটা সিগারেটও খায়নি, অথচ ডাক্তাররা বলেছেন ধুমপানের কারণেই আজ তার ক্যান্সার হয়েছে।
মিনুর স্বামী ছিল অসম্ভব প্রাণবন্ত মানুষ, সিগারেট খেত, আড্ডা দিত, সবার প্রিয় ব্যক্তি ছিল সে। প্রতি শুক্রবারে তার আড্ডা দেয়া চাই ই চাই। শুক্রবারে তার বসার ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় একাকার হয়ে যেত। মিনুর বর মনির ও তার বন্ধুরা সবাই ধুমপান করতেন। মিনু আর মনির ছিল সবার প্রিয় দম্পতি। মিনু মাঝে মাঝে বলত, “মনির তোমার সিগারেট খাওয়া একটু কমিয়ে দাও, এতোটা ভাল নয়”।
মিনু গ্রামের কলেজ থেকে বি এ পাশ করা মেয়ে, শহুরে বরের সাথে বিয়ে হওয়ার পরে আর কোন কাজ করেনি। তিনবাচ্চা ও শাশুড়িকে সামলাতেই তার সময় চলে গেছে। শাশুড়িই তাকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে, তার ধারণা ছিল শহুরে মেয়েরা ভাল বউ হয়না। মিনু কথা রেখেছে। শেষ পর্যন্ত সে শাশুড়ির সব আবদার মিটিয়েছে। শাশুড়ি তাকে প্রায়ই রান্নায় সাহায্য করত। মাঝে মাঝে ছেলেকে বকা দিত, “তোর সব সময় এতো বন্ধু পিরিত ক্যান। বউটার অনেক কষ্ট হয়।” মনির কখনোই মায়ের কথায় কান দেয়নি।
সিগারেট খাওয়া নিয়ে প্রায়ই মায়ের অভিযোগ থাকত। কে শোনে কার কথা। ছেলে মেয়েরা খুব একটা বাবার কাছাকাছি আসতনা, তারা মা ও দাদীকে ঘিরেই থাকতে পছন্দ করত। মনিরের বাবা ৭১ এর যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরেনি। শহিদ পরিবার হিসাবে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে এ বাড়িটা তারা পেয়েছিল, তাই মনির বাড়ি বা সম্পত্তি কিনার কথা ভাবেনি। তার কোম্পানীর চাকরি ও বউ, বাচ্চা ও মা নিয়ে সুখী জীবন।
৪৫ বছর বয়সে তার প্রথম স্ট্রোক হয়। এরপর মনির বন্ধু আড্ডা কিছুটা কমিয়েছে কিন্তু সিগারেট ছাড়েনি। মা ততদিনে চলে গেছেন। একদিনের জ্বর নিয়ে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরে আর ঘরে আনতে পারেনি। মনির কিছুটা অসহায় হয়ে পড়ে মাকে ছাড়া। এ কারনেই হোক আর অন্য কোন কারণেই হোক মনিরের সিগারেট খাওয়া আরো বেড়ে গেল। বউ কিছু বললে ঘর থেকে বেড়িয়ে যেত। একদিন রাতে সিগারেট নিয়ে ঝগড়ার মুখে মনির বলল, “তুমি এ বাড়িতে থাক আমি আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকব। মা তোমাকে এনেছে, বাবার ভাতা আছে, আমিও কিছু দিবো বাচ্চাদের খরচবাবদ, কিন্তু এখানে তোমার সাথে থাকব না।”
এরপর মিনু একেবারেই অসহায় হয়ে গেল। কোনদিন চাকরি করেনি, বাইরের কাজও শাশুড়ি বেশি করত। সে কখনও ব্যাংক থেকে একটা টাকাও তোলেনি। মনিরকে আর কিছু সে বলল না। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে সাথে নিয়ে সে একটি মিটিং করল। ছেলে একজন কলেজে পড়ে আর একজন ক্লাস টেনে। মেয়েটি ক্লাস এইটে। এই মেয়ের সাথেই বাবার খুব ভাল সম্পর্ক। মিনু মেয়েকে তার বাবার কাছে যেতে দেয়না যখন সে বন্ধু, সিগারেট, মদ ও তাসে ডুবে থাকে। আগে বসার ঘরেই এ আড্ডা হত, মা চলে যাওয়ার পর সে ঘরটিকে আড্ডার জায়গা বানিয়েছে মনির।
মনির একদিন রেগে বলল “তোমার মত এক গ্রাম্য মেয়েকে মা আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে, আমি তাই বহন করে চলছি। আমার বন্ধুদের বউয়েরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা মেয়ে চাকরি করে, কত স্মার্ট।” মিনু বলল, “তুমি এক কাজ কর, এ আড্ডাটা তুমি কোন এক বন্ধুর বাড়িতেই করনা কেন, আমরা বেঁচে যাই।” মনির বলল, “তাইতো আমি আলাদা থাকতে চাই।” না মিনু মনিরকে আলাদা যেতে দেয়নি। ভেবেছে আহা স্ট্রোকের রোগী, যত্ন না করলে মারা যাবে। মিনু আলাদা বিছানায়ও শোয়নি কখনো।
বছর পাঁচেক এভাবেই চলল এরপর একদিন হার্ট এট্যাক হল। বড় ছেলে ডাক্তারি পড়ছে শেষ বছর, ছোট ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, মেয়েটা তিতুমির কলেজে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিবে। এ সময়ে বাবার এ অসুখ। এ যাত্রা ছেলেই সামলিয়েছে বাবার অসুখ। মনির বন্ধু আড্ডা কিছুটা কমালেও সিগারেট ছাড়তে পারেনি। ডাক্তার বলেছে, সিগারেট না ছাড়লে আমার কাছে আসবেন না। মনির এখন আর সিগারেট খেতে বাইরে যায়না, সে শোয়ার ঘরে বসেই সিগারেট খায়। এতো বছর হয়ে গেল মিনু এখনও সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারেনা। এখন মনে হয় বিছানার চাদর, মশারি বালিশের কভার সব কিছু থেকেই সিগারেটের গন্ধ আসে।
এভাবে আরো অনেকগুলো বছর কেটে গেল। বড় ছেলে ডাক্তার হয়ে মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশনে কাজ করে, ছোট ছেলে পাশ করে বেড়িয়ে এবারই বি সি এস শেষ করল, ম্যাজিষ্ট্রেট হয়ে চলে গেল উপজেলায়। মেয়ে বুয়েট থেকে পাশ করে চুয়েটের শিক্ষক হয়েছে। না তারা কেউই বাবার সাথে থাকেনি। মেয়েটা মাঝে মাঝে আসে কিন্তু ছেলেরা তেমন আসেনা। তাদের সাথে তাদের বাবার কি যেন একটা অলিখিত শত্রুতা।
প্রায় ৯ বছর অসুস্থ থাকার পরে একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে চলে গেল মনির। মনির চলে যাওয়াতে মিনুর জীবনটা শুন্যতায় ভরে গেল। এতদিন মনিরের জন্য বাজার করে, রান্না করে তার সময় চলে যেত, আজ কিছুই করার নেই। মিনু ভাবছিল গ্রামে ফিরে যাবে তার আগেই ঘটল বিপত্তি।
মিনু খুব ভাল গান করত ছোটবেলা থেকেই। তেমন করে মাস্টার রেখে গান করা তার হয়ে উঠেনি, কিন্তু খালি গলায় সে খুব ভাল গান করত। শাশুড়ি তার গান খুব পছন্দ করতেন। মনির কোনদিন গান শুনতে চায়নি, তাই তার সামনে গাওয়া হয়ে উঠেনি। বাচ্চাদের সামনে মাঝে মাঝে গান করত। একদিন গান করতে গিয়ে মনে হল শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে। বড় ছেলেকে ফোন করে বলল তার সমস্যার কথা। ছেলে এসে মাকে নিয়ে গেল। ছেলের বউ লতাও হার্ট ফাউন্ডেশনের ডাক্তার। ওদের পছন্দের বিয়ে।
এক্সরে করতে গিয়ে ধরা পড়ল, মিনুর ফুসফুসের অবস্থা খুব খারাপ। তারপর ফুসফুস থেকে টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেল তার ফুসফুসের ক্যান্সার হয়েছে। ডেল্টার ডাক্তার তাকে জিজ্ঞেস করল “আপনি কি খুব ধূমপান করতেন?” মিনু বলল, “না কখনো করিনি”। সে বলল, “আমার বর খুবই ধূমপান করত, আমি তার সাথে থাকতাম সব সময়”। ডাক্তার বলল, “এটা পরোক্ষ ধূমপানের ফল”।
ছেলে বলল, “মা তোমার ফুসফুসের ক্যান্সার তৃতীয় স্তরের, এখনো অন্য কোথাও ছড়ায় নি। তুমি এতো সচেতন মানুষ ছিলে অথচ বাবার ধুমপান বন্ধ করাতে পারলে না। আজ তাইতো তোমার এ অবস্থা হল”।
ডেল্টা হাসপাতাল থেকে মিনুকে ছেড়ে দিল। সে আর আগের মত গান গাইতে পারেনা, এমনকি কথাও বলতেও কষ্ট হয়। তার ফুসফুসে অনেক ধরণের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে, যেমন কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি। এক সময় কেমো রেডিয়েশন দুটোই একসাথে দেয়া হয়েছে।
কোন কিছু খেতে ইচ্ছা হতনা, সারাক্ষণ বমি বমি লাগত। এত এত ক্লান্ত থাকত যা কাউকেই বলে বোঝানো যাবেনা। ছেলেটা মিরপুর থাকে, তার বাসায় থেকেই মিনুর চিকিৎসা হয়েছে। তিনমাস পর পর এক্সরে করে দেখতে হবে ক্যান্সার বাড়ল কিনা। মিনু ভাবছে লোকটা যদি একটু কথা শুনত, সেও যেতোনা, মিনুরও এ অবস্থা হতনা।
চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে মিনু সিদ্ধান্ত নিল বাপের বাড়ি ফিরে যাবে। মেয়ে তার কাছে চট্টগ্রামে যেতে বলল। মেয়ের জামাইটি বেশ ভাল, বলল মা আপনি আমাদের কাছে এসে থাকেন। মিনু ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ডেভেলপারকে দিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে গেল।