মতামত

ইতিহাসের নির্মোহ পাঠেই পাব বঙ্গবন্ধুকে

– রমেন দাশ গুপ্ত

বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা বেড়ে উঠেছি একটা ভয়ের পরিবেশে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলছিলাম। আরও সহজভাবে বলতে গেলে, বঙ্গবন্ধুকে ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্বোধন করা নিয়ে একটা ভয়-আতঙ্কের মধ্যে আমরা বেড়ে উঠেছি। আমি যে স্কুলের ছাত্র ছিলাম, সেখানে স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবসে উপস্থিত বক্তৃতার প্রতিযোগিতা হত। সেখানে তখন বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের দোর্দণ্ড- প্রতাপ। দেওয়ালে-দেওয়ালে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, বাকশালের বিরুদ্ধে চিকা থাকতো। পাশাপাশি থাকতো ‘আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই’ এমন শ্লোগানের পাশে জামায়াত ইসলামী বা ইসলামী ছাত্রশিবির- লেখা। সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় একদিন উপস্থিত বক্তৃতায় সাহস করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলে ফেলি। মঞ্চ থেকে নামার পর শিবিরের কয়েকজন ছেলে এসে টেনেহিঁচড়ে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। তবে কয়েকজন শিক্ষকের ত্বরিৎ পদক্ষেপে সেই যাত্রায় রক্ষা পাই।

তখন মেধাবী ছাত্র-শিক্ষকদেরও এভাবে বলতে শুনেছি যে- শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে জাতিকে বিপদের মুখে রেখে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের কাছে ধরা দেন, বাদবাকি আওয়ামী লীগের নেতারা সবাই ভারতে পালিয়ে যান, একমাত্র সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং দেশ স্বাধীন করেন। তাদের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুরু হত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে। বাঙালি যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে সেটা উহ্য রেখে বলা হতো ‘হানাদার বাহিনী’। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে যে দেশটি সবার আগে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে, সেই ভারত সম্পর্কে এমনভাবে বলা হতো যেন মনে হতো বাঙালি যুদ্ধ করেছিল ভারতের বিরুদ্ধে অথবা ভারত সহযোগিতার নামে পাকিস্তানকে বিভক্ত করেছে। রাজাকার-আলবদরদের একাত্তরের কুকীর্তির কথা তো আমরা তখন সেভাবে জানতেই পারিনি।

এই অসত্য-খন্ডিত বক্তব্যের বিপরীতে জোরালো সত্য উচ্চারণ তখন পর্যন্ত আমরা কমই শুনতাম। গ্রামের একেবারে বৃদ্ধ লোকটি, বৃটিশ-পাকিস্তানের শাসনের সাক্ষী মানুষটি মিনমিন করে ‘শেখ সাহেবের’ কথা বলে অসহায়ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। শেখ সাহেবের কথা বলে, বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করে কিন্তু নয়। যারা আওয়ামী লীগ করতেন, তাদের অনেকেই অবশ্য বলতেন জাতির পিতার কথা, বঙ্গবন্ধুর কথা। কিন্তু সেটা ব্যাপকতা পায় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে। আরও ব্যাপকতা পায় ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আরেকদফা ক্ষমতায় আসার পর।

আমরা যারা শেখ মুজিবুর রহমানকে একনায়ক আর খলনায়ক শুনে শুনে বেড়ে উঠেছি, তাদের কিন্তু স্বাধীনতা আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস জানতে অপেক্ষা করতে হয়েছে তারুণ্য আসা পর্যন্ত। কিন্তু এরপরও কি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন খুব বেশি আমরা পেয়েছি বা পাচ্ছি ? আমাদের আগের-পরের প্রজন্ম পাচ্ছে ? যারা জানাবেন তারা জানেন তো? তারা হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ দ্বিধাহীনভাবে ধারণ করেন তো ? এসব প্রশ্ন কিন্তু তুলতেই হবে। তুলতে হবে এই কারণে যে, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বঙ্গবন্ধুকে খলনায়ক বানানোর যে প্রাণান্ত চেষ্টা এদেশের কিছু মহল করে গেছে, তার বিপরীতে বঙ্গবন্ধুকে বাঙালির জনমানসে স্থায়ী আসন করে দেওয়ার জন্য খুব বেশি প্রয়োজন।

অথচ আমরা কি শুনি ? সেই যে খলনায়ক বানানোর প্রচেষ্টা, ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা, মনগড়া ধান্ধাবাজির ইতিহাসের বিপরীতে পাই কিছু স্তুতিবাক্য। কিছু বলছি কেন, একনাগাড়ে হাজার-হাজার, লাখো কন্ঠে স্তুতিবাক্য। স্তুতিবাক্য তোতা পাখির শেখানো বুলির মতো করে বলা যায়, তাতে জ্ঞান-মেধার লেশমাত্র লাগে না। স্বাভাবিকভাবেই সেই স্তুতিবাক্য একসময় হয়ে ওঠে অস্বস্তি¡কর। মানুষের মনে দ্বিধা-সংশয় জাগায়।

শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে আমরা সাতচল্লিশের আগে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সংগ্রামের বিবরণ পাই। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর আমরা কি দেখি ? মুজিব কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে নিজেকে বিলীন করেননি। দেশ বিভাগের আগে কোলকাতায় পড়ালেখার সময় যে উদারপন্থী মুসলিম তরুণ সমাজের সান্নিধ্যে মুজিব এসেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামো সৃষ্টির পর সেই প্রগতিশীল ধ্যানধারণা তাঁর মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল কি না, গরীব-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বশীল মানসিকতার কারণে তিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের দিকে ঝুঁকেছিলেন কি না- এসব নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ চলুক, গবেষণা হোক! কোলকাতা কেন্দ্রিক রাজনীতি করা, আবার ঢাকায় আসা, পাকিস্তান আন্দোলনের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ভাষার জন্য আন্দোলনে শরীক হওয়া, স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে বামপন্থী নেতা মণি সিংহ, খোকা রায়দের সান্নিধ্যে আসা, এর সমান্তরালে দলের মধ্যেও সেই চিন্তার উন্মেষ ঘটানো- এভাবেই এগিয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি। তাঁকে চর্চা করতে গিয়ে এর একটিও বাদ রাখলে কিংবা নিজের মতো করে বয়ান দিলে, কৌশলের আশ্রয় নিলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সঠিক মূল্যায়ন কিন্তু হবে না, এটা বলার জন্য বড় গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে- সামগ্রিক বয়ানে কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের এরকম অনেক চিত্রের দারুণ অনুপস্থিতি দেখি। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের উত্থান দেখি, আদর্শিক রাজনীতির চর্চা দেখি, অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে একজন রাজনৈতিক কর্মীর নেতা হয়ে ওঠার সত্য বয়ান দেখি। আমরা ইতিহাস ঘেঁটে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা জানতে পারি, গোপনে স্বপ্নসারথীদের নিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজ বোনার কথা পড়ি, মানুষের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে কারাগারই হয়ে উঠেছিল যে মানুষটির ঘরবাড়ি সেটাও দেখি, অনুপস্থিতি স্বত্ত্বেও তাঁর নামেই যে এদেশের লাখো মানুষ অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল- ইতিহাসে তার সত্য বয়ানও পাই। আবার দেশ স্বাধীনের পর রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আর্বিভূত হওয়া এবং নানা প্রেক্ষাপটও আছে।

এই প্রেক্ষাপটেই আবারও বলছি নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়নের কথা। কারণ এটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়, যদি সেটা বাস্তবতার নিরিখে হয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে- স্বগোত্রীয়দের রাজনৈতিক বয়ানে বিশ্লেষণ-মূল্যায়ন থাকেই না। সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের মধ্যেও স্তুতির দুঃখজনক প্রতিযোগিতা দেখি, মূল্যায়ন নয়।

জ্ঞানতাপস ড. অনুপম সেনের কথা শোনার সুযোগ হয় মাঝে মাঝে। তিনি সবসময় একটা বিষয় বলেন যে- ‘বাঙালির হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি মানচিত্র, একটি লাল-সবুজের পতাকা কিন্তু এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুই।’ বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টার ওপর সেন স্যারের এই মূল্যায়ন একটি শক্ত আঘাত। বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর বুকে একমাত্র জাতীয়তাবাদী নেতা নন, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য ধাপে ধাপে একটি জাতিকে প্রস্তুত করে যুদ্ধে অবতীর্ণ করে স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি অন্য অনেকের চেয়েও ইতিহাসে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে যারা বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বিচ্যুত করতে চায় বা যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করতে চায়- আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতে হবে, তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। আবার যারা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করেন না, বর্ণচোরা, শুধুমাত্র সুবিধাবাদিতার জন্য ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটিকে শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করেন, আঙ্গুল উঁচিয়ে তাদেরও বলতে হবে যে- আপনাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়।

কিন্তু সেই জবাবও তো দিতে হবে নির্মোহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে, ইতিহাসের খণ্ডিত পাঠ বা উচ্চারণ থেকে নয়। এই যে বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে প্রায় সকলেই ১৯৪৭ থেকে শুরু করেন, সেটা কী ঠিক ? বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের মধ্যেই যে মুজিবের বেড়ে ওঠা, সেই আলোচনা কি তেমনভাবে আমরা শুনি ? বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের যে বীরত্বগাঁথা বাঙালির, সেটা এই প্রজন্মের ক’জন জানে বা এরও আগে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বৃটিশ আধিপত্যবাদী শাসন শুরুর ইতিহাস।

যে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জন্য লড়েছেন, আবার পাকিস্তান সৃষ্টির পর তাদের নীতি, শোষণ-বঞ্চনার প্রতিবাদ করে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনেছেন, সেই মুজিবকে তো চিনতে হবে। বৃটিশ আমলের মুসলিম লীগ থেকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর আওয়ামী মুসলিম লীগ, অর্ধযুগের মাথায় আবার আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ গঠন করা, শেখ মুজিবুর রহমান অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্ব হিসেবে এই পথপরিক্রমা তৈরিতে যুক্ত ছিলেন। সেই সময়ের প্রেক্ষাপট, শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ও চিন্তা-চেতনার সামগ্রিকতা-পরিবর্তন- এসব ইতিহাসের নির্মোহ চর্চা কি হয় ? অথচ শেখ মুজিবুর রহমানকে জানতে হলে এর পুরোটাই জানতে হবে। এই পথপরিক্রমায় শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরুদের কথা না জানলে, সোহরাওয়ার্দ্দী, শেরে বাংলা, ভাসানীদের কথা না জানলে-বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

ভাষা আন্দোলনের মুজিব, যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভার সদস্য মুজিব, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম, শাসকের নিপীড়ন উপেক্ষা করে অধিকারের কথা বলা, বারবার কারাবরণ, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য চার হাজার ৬৭৫ দিনের জেলজীবন-নির্যাতন সহ্য করা- বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে এর পুরোটাই জানতে হবে। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম বঙ্গবন্ধু কোন রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা মাথায় রেখে করেছিলেন সেটা জানা খুবই জরুরি। সেসময় কেমন ছিল পাকিস্তানের মুসলিম লীগসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম, সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার- এর বিপরীতে সমাজ প্রগতির সংগ্রাম-সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকা-ের চর্চা, বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল রেখে উপমহাদেশ জুড়ে সমাজতন্ত্রের রাজনীতির উত্থান, পঞ্চাশ-ষাটের দশকের বাম আন্দোলন- এসব বিষয় না জানলে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির অন্দরমহলে প্রবেশ করা যাবে না।

ষাটের দশকের শুরু থেকে ছাত্রনেতাদের নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া, ৬৬’র ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের সাতই মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকনির্দেশনা ও ঘোষণা দেওয়া- এর খুঁটিনাটিও জানতে হবে। আবার কোন প্রেক্ষাপটে, কোন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু কারাবরণ করলেন, যুদ্ধের নয়মাস বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা মানুষটিকে চিনতে যেমন ইতিহাসের অলি-গলি ধরে সেই জায়গায় পৌঁছুতে হবে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর সারথীদের সম্পর্কেও জানতে হবে। তাজউদ্দিন আহমেদসহ চার জাতীয় নেতা, তৎকালীন ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা এবং তাদের কার্যক্রম যেমন জানতে হবে, চিনতে হবে ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ, মোজাফফর আহমেদদেরও। খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ভেতরে সক্রিয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের রাজনীতির আলোচনাও তো তেমনভাবে দেখি না। একজন চিত্তরঞ্জন সুতারকে এই প্রজন্মের ক’জনই বা চিনেন ? এসব বিষয় না জানলে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানাটা খণ্ডিতই থেকে যাবে।

আবারও বলছি, নির্মোহ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুকে পূর্ণাঙ্গভাবে জানা যাবে। আর পূর্ণাঙ্গভাবে না জানলে বা জানতে না দিলে খণ্ডিত ইতিহাস দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছানো যাবে না, এতে বরং বিভ্রান্তিই তৈরি হবে। অপপ্রচারকারীদের পালে বাতাস লাগবে। খণ্ডিত ইতিহাস দিয়ে প্রজন্মের কাছে দায় মেটানো যাবে না। অনেক অপপ্রচারেও বঙ্গবন্ধুকে জনমানস থেকে মুছে ফেলা যায়নি, কিন্তু সার্বজনীন স্থায়ী আসন তৈরির জন্য ইতিহাসের নির্মোহ চর্চাটা করে যেতেই হবে।

আমাদের জানতে হবে, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যুদ্ধটা কিভাবে হয়েছে, যুদ্ধদিনের মুহুর্তগুলো কেমন ছিল, প্রকাশ্য-অন্তরালের সবকিছু। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থে একটি জনযুদ্ধ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনেই এই যুদ্ধ হয়েছে। জনযুদ্ধ কি, কেন আমরা জনযুদ্ধ বলি- এই বিষয়টি কি নির্মোহভাবে প্রজন্মের সামনে এখনও আনা গেছে ? অথচ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে, এমনকি এখনও বঙ্গবন্ধুসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে খাটো করার জন্য প্রচার চালানো হয় অনলাইন-অফলাইনে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। কত বড় মিথ্যাচার ! সেই মিথ্যাচারের জবাব দিতে হলে, প্রজন্ম যাতে বিভ্রান্ত না হয় সেই পথ তৈরি করতে হলে বৃটিশ থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের সময় পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন সম্পর্কে, সেসময়ের আন্দোলন-সংগ্রামসহ পুরো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বিষয় জানতে হবে এবং জানাতে হবে। অবশ্যই সেনা কর্মকর্তা যারা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, ইতিহাসকে ভিত্তি ধরে তাদের বিষয়েও সঠিকভাবে জানতে হবে। সাথে সাথে কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষের কথা বলতে হবে যারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, হাজার হাজার গেরিলা যোদ্ধার তথ্য সামনে নিয়ে আসতে হবে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে সর্বাগ্রে মুক্তিযুদ্ধকে জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধু নয় মাসের সংগ্রাম নয়, কোন রাজনৈতিক দর্শন, চিন্তা-চেতনা থেকে বাঙালিকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মূল স্পিরিটটা কি ছিল, সেটা যদি আমরা না জানি, না বুঝি এবং ধারণ না করি তাহলে বঙ্গবন্ধুকেও হৃদয়ে ধারণ করতে পারবো না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি- অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই চার মূলনীতি সম্পর্কে জানতে হবে এবং ধারণ করতে হবে। তবেই বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করা হবে। মূলনীতি নিয়ে অস্পষ্টতা, বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে রাজনৈতিক কৌশলের ফাঁদে পা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে চর্চা করা যাবে না। অন্তরে ধর্মান্ধতা আর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প রেখে, এক চিমটি গণতন্ত্র আর এক চিমটি ধমনিরপেক্ষতার বুলি আওড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর চর্চা হবে না। বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হলে সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটকে নিয়েই করতে হবে। ভণ্ড-বর্ণচোরাদের অন্তঃসারশূন্য স্তুতিতে ঘেরা দেওয়াল থেকে বঙ্গবন্ধুকে বের করে আনতে হবে।

শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের দু’টি উল্লেখযোগ্য আলোচ্য বিষয়ের একটি তিনি স্বাধীনতার মহানায়ক, পরবর্তীতে যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকের চেয়ারেও বসেছেন, সেটি তাঁর জীবনের আরেক অধ্যায়। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে একেবারে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা, সাড়ে সাত কোটি মানুষের গুরুদায়িত্ব মাথায় নিয়েই তাঁকে নিতে হয়েছে শাসনভার। একেবারে সদ্য স্বাধীন দেশে স্বগোত্রীয়দের কিংবা বিরোধীদের অপরিমেয় আকাংক্ষা, সেটা পূরণ করতে না পারলে তীব্র বিরোধিতার চাপ তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। আবার নিজ দলের মধ্যে অর্ন্তঘাত-কলহ, ছাত্রলীগ ভেঙে জাসদ সৃষ্টি- এমন নানা টানাপড়েনও তাঁকে সামাল দিতে হয়েছে। রাজনীতিতে একসময়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সারথী তাজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি, দেশজুড়ে নানা অস্থিরতা-সহিংসতা, খুন, লুটতরাজ, একপর্যায়ে বাকশাল গঠন- মাত্র সাড়ে তিনবছরের দেশ শাসনের মধ্যে আন্দোলন-সংগ্রামের নায়ক থেকে রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হওয়া মুজিবের সামর্থ্য-সীমবাদ্ধতা নিয়েও আলোচনা দেখি না খুব একটা।

স্বাধীন দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য নব্য ধনী-লুটেরাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে যে বিপ্লবী পথের সূচনা করেছিলেন রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিব, তাঁকে হত্যার পর ক্রমাগত অপপ্রচারের মাধ্যমে সেই বাকশালকে গালিতে পরিণত করেছিল সামরিক শাসক ও তাদের দল এবং মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি জামায়াত ইসলামীসহ আরও কিছু দল। অথচ বঙ্গবন্ধুর শেষ জীবনের এই রাজনৈতিক দর্শনের চর্চা খুব কমই দেখি, কোথায় যেন দ্বিধা, কোথায় যেন সংশয় ! অথচ বঙ্গবন্ধুর শেষ জীবনের এই রাজনৈতিক দর্শনটা জানলে-বুঝলে অপপ্রচারকারী, কায়েমি স্বার্থবাদীদের পাল্টা জবাব দেওয়া সহজ হতো। প্রজন্মও বিভ্রান্ত হতো না। হ্যাঁ, ভিন্নমত থাকতেই পারে। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য নেওয়া একটি রাজনৈতিক দর্শনকে ক্রমাগত খণ্ডিতভাবে অপপ্রচারের হাতিয়ার করে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের আসন থেকে খারিজ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চেষ্টাকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা- এটাকে যখন একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের কর্মকাণ্ড উল্লেখ করা হয়, হতাশ হই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কুশীলব, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী, নব্য ধনী-আমলাদের চক্রান্তসহ আরও কারণ আছে কি না- সেগুলো জাতির সামনে প্রকাশে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা আছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা যারা করেন, তারাও যখন একেবারে হালকা বিশ্লেষণ করেন তখন হতাশ হওয়া ছাড়া আসলেই উপায় থাকে না। দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, এটা সঠিক হলেও একমাত্র কারণ বলে মনে করি না। এই এক লাইনে জাতির পিতাকে খুনের কারণ সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। কিন্তু জেনে- না জেনে আলোচনাটা সেখানেই সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে দুঃখজনকভাবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর নিজ দল আওয়ামী লীগের নেতাদের অবস্থান, তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে শামিল না হয়ে বরং অনেকের মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যোগদান, সেসময়কার বামপন্থী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল- সেই আলোচনার ব্যাপক অনুপস্থিতি দেখি।

শক্তিমান লেখক আহমদ ছফা। তিনি বঙ্গবন্ধুর কট্টর সমালোচক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনেক নীতির বিরোধী ছিলেন। কিন্তু একাধিক লেখায় দেখেছি- বঙ্গবন্ধুকে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি মানতে চান না বা কুতর্ক করেন তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেননি ছফা। সেই সমালোচনাকে তিনি সামন্তীয় এবং গ্রামীণ নিন্দজ্ঞান উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে তীব্র বাক্যবাণে বিদ্ধ করার পর ছফা শেষে লিখেছেন, ‘মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতো।’ অথচ সেই ছফাই আবার শ্রেণীগত অবস্থান বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি ছাড়া আর কিছু ভাবেননি।

বঙ্গবন্ধু কোনো একক গোষ্ঠী বা দলের নন। তিনি সার্বজনীন। তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে সর্বজনের কাছে। তাঁকে মূল্যায়নের সুযোগ দিতে হবে। সেক্ষেত্রে সবার মূল্যায়ন এক হবে না। জ্ঞানতাপস ড. অনুপম সেন বঙ্গবন্ধুকে শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচনায় নেবেন, বামপন্থী আহমদ ছফা তাঁকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয়তাবাদী নেতা ভাববেন, গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষটা বলবেন ‘শেখ সাহেবের’ কথা। যারা মুক্তিযুদ্ধকে শ্রেণীসংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেন, তারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে তাদের চিন্তা থেকে বিশ্লেষণ করবেন, সমস্যা তো দেখি না ! সংস্কৃতি কর্মী নাটকে-গানে-কবিতায় তাঁর মতো করে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরবেন। গবেষকের দৃষ্টিটা থাকবে হয়তো আবার ভিন্নরকম। এভাবে নিরন্তর চর্চা করতে হবে। তখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কুতর্ককারীরা আর হালে পানি পাবে না। তখন প্রজন্মের মনে স্বাধীনতার স্থপতি নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না।

বিদ্যা-বুদ্ধি-বোধহীন, ভণ্ড-বর্ণচোরা-সুবিধাবাদীদের স্তুতিবাক্যে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইতিহাসের সঠিক চর্চা ও তার সামগ্রিক উপস্থাপনই পারে জনমানসে বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবে প্রতিস্থাপন করতে। বাঙালি জাতিস্বত্তা যতদিন থাকবে, এই জাতির একটি স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুও ততদিন থাকবেন। ভাবিকালে ইতিহাসের বিচার সমসাময়িক দলীয় রাজনীতির লাভক্ষতি দিয়ে বিবেচনা করা হবে না। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে শুধুমাত্র সত্যই টিকে থাকবে, আর কিছু নয়। তাই ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠায় গুণের পাশাপাশি দোষের আলোচনাও থাকবে। অর্জনের পাশাপাশি থাকবে ব্যর্থতাও। বঙ্গবন্ধু কোনো কল্পিত চরিত্র নন। তিনি রক্তমাংসের মানুষ, তিনি এ বাংলার মাটি থেকে উঠে এসে বাঙালিকে নিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম সংগঠনের প্রাণপুরুষ। মানুষের হৃদয়ে যার স্থান তিনি গণমানুষের। কোনো গোষ্ঠীর বলয়ে আবদ্ধ করে তাঁকে খ-িত করা হলে ইতিহাস সেই মিথ্যে চর্চাকারী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের ক্ষমা করবে না।

লখেক : গণমাধ্যম কর্মী