বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বসু ও নোবেল পুরষ্কার

– ড. প্রদীপ দেব

সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে  বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত – এই আড়াইশো বছরে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ভিত্তি স্থাপনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন এমন পঞ্চাশ জন পদার্থবিজ্ঞানীকে নিয়ে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই বেরিয়েছে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে। আইওয়ান জেম্‌স-এর এই ‘Remarkable Physicists From Galileo to Yukawa’ বইতে পঞ্চাশ জন পদার্থবিজ্ঞানীর মধ্যে আটচল্লিশ জন পদার্থবিজ্ঞানী আমেরিকা ও ইওরোপের। আর বাকি পৃথিবী থেকে যে দুজন পদার্থবিজ্ঞানী স্থান পেয়েছেন সেখানে তাদের একজন হলেন জাপানের হাইদেকি ইউকাওয়া এবং অন্যজন আমাদের সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ইউকাওয়া ১৯৪৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। আর সত্যেন্দ্রনাথ বসু নোবেল পুরষ্কার না পেলেও তাঁর নাম জড়িয়ে আছে পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে মৌলিক কণাগুলোর সাথে।

ওয়ার্ল্ড র‍্যাংঙ্কিং-এ আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থান এখন আর তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার তিন বছরের মধ্যেই ১৯২৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর একটি গবেষণাপত্র পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ভিত্তি বদলে দিয়েছিল। এই গবেষণাপত্রের ফলে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামের সাথে জড়িয়ে গেছে আইনস্টাইনের নাম, সৃষ্টি হয়েছে বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন বা Bose-Einstein Statistics।

পৃথিবীর সবগুলো মৌলিক কণাকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের কণা হলো বস্তু-কণা বা matter particle – যাদেরকে বলা হয় ফার্মিয়ন (Fermion)। পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নাম অনুসারে এই নাম রাখা হয়েছে। ফার্মিয়ন কণা ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন (Fermi-Dirac Statistics) মেনে চলে। আর অন্য ধরনের কণাগুলো হলো বল-বহনকারী কণা বা Force-carrier particle – যাদেরকে  বলা হয় বোসন (Boson)। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম অনুসারে এই কণাগুলোর নাম রাখা হয়েছে ‘বোসন’ (উচ্চারণ বোজন)। বোসন কণা বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন মেনে চলে। পরমাণুর ইলেকট্রন হলো ফার্মিয়ন। ফার্মিয়ন কণাগুলোর জন্য পারমাণবিক নিয়ম-কানুন খুবই কড়া। একই ধরনের দুটো ফার্মিয়ন একই কোয়ান্টাম স্টেট বা শক্তিস্তরে থাকতে পারে না। যেমন পরমাণুর একটি শক্তিস্তরে যতগুলো ইলেকট্রন থাকে তাদের প্রত্যেকটিই কোন না কোনভাবে অন্য ইলেকট্রনের চেয়ে আলাদা। কিন্তু বোসনের ক্ষেত্রে সেরকম কোন নিয়ম নেই। যেমন আলোর কণা ফোটন হলো বোসনের একটি সহজ উদাহরণ। একই জায়গায় অসংখ্য ফোটন থাকতে পারে। বিজ্ঞানীদের কাছে ফার্মিয়ন ও বোসন চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো তাদের কোয়ান্টাম স্পিন বা স্পিন কোয়ান্টাম নাম্বার কত তা হিসেব করে বের করা।  যাদের স্পিন ০, ১, ২ ইত্যাদি পূর্ণ সংখ্যা হয় তারা সব বোসন। আর ফার্মিয়নের স্পিন হবে সব অর্ধেক অর্ধেক – ১/২, ৩/২, ৫/২ ইত্যাদি। স্পিনের হিসেব বেশ জটিল। ওটা নিয়ে আমরা অন্য কোনদিন আলোচনা করবো।

এই যে মহাবিশ্বের সবগুলো মৌলিক কণার প্রধান দুই শ্রেণির মধ্যে এক শ্রেণির নাম দেয়া হয়েছে একজন বাঙালি বিজ্ঞানীর নামে, এবং সেই বিজ্ঞানী এই ব্যাপারটা আবিষ্কার করেছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করার সময় – এর চেয়ে গৌরবের আর কী হতে পারে। শুধু তাই নয়, বোসন কণাগুলোর ধর্ম ও কর্ম ব্যাখ্যা করার জন্য যে গণিত দরকার হয় তার নাম বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স। আইনস্টাইনের নামের সাথে সত্যেন বসুর নাম এমনভাবে জুড়ে গেছে যে এখন আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক জীবনী লিখতে গেলে সেই জীবনীতে সত্যেন বসুর কথা লিখতেই হয়।

এমন চমৎকার সম্মান পাবার পরেও আমাদের বিশেষ করে বাঙালিদের মাঝে মাঝে মনে হয় যেন সত্যেন বসুকে তাঁর উপযুক্ত সম্মান দেয়া হয়নি। সেই ‘উপযুক্ত সম্মান’ বলতে আমরা বিজ্ঞানের সবচেয়ে দুর্লভ সম্মান নোবেল পুরষ্কারকেই বুঝে থাকি। বেতার তরঙ্গ সংক্রান্ত গবেষণায় আমাদের জগদীশচন্দ্র বসুকে বঞ্চিত করা হয়েছে নোবেল পুরষ্কার থেকে। সেই ক্ষোভ আমাদের আছে। তার ওপর যখন আমরা দেখি যে সত্যেন বসু যে পথ দেখিয়েছেন সেই পথে গবেষণা করে অন্যরা নোবেল পুরষ্কার পেয়ে যাচ্ছে – তখন আমাদের রাগ হয় বৈ কি।

১৯৯৬ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান  তিন জন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী। কর্নেল ইউনিভার্সিটির ডেভিড লি ও রবার্ট রিচার্ডসন, এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ডগলাস ওসারফ। হিলিয়াম-৩ আইসোটোপের সুপারফ্লুইডিটি আবিষ্কার করে তাঁরা নোবেল পুরষ্কার পান। কিন্তু আমাদের রাগ হয় যখন আমরা দেখি যে হিলিয়াম পরমাণুর সুপারফ্লুইডিটি আসে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেশান বা বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন থেকে যা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদান। আমরা ক্ষুব্ধ হই সত্যেন বসুকে নোবেল দেয়া হয়নি বলে।

পরের বছর আবারো একই ব্যাপার ঘটে। ১৯৯৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান দুজন আমেরিকান – স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্টিভেন চু ও ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেকনোলজির উইলিয়াম ফিলিপ্‌স, এবং একজন ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী – প্যারিসের কলেজ ডি ফ্রান্সের ক্লদে কোহেন-তানোজি। লেজার আলোর সাহায্যে পরমাণুকে ঠান্ডা করে আটকে ফেলার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য তাঁরা নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পরমাণুগুলো কিন্তু ঘন্টায় প্রায় চার হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটোছুটি করে। তাদেরকে এরকম ছুটন্ত অবস্থায় সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। পরমাণুকে ক্রমাগত ঠান্ডা করতে থাকলে তাদের গতিবেগ ক্রমশ কমতে থাকে। দেখা গেলো যে এই আবিষ্কারও বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেশানকে সমর্থন করছে। সত্যেন বসু নোবেল না পাওয়ায় আমাদের ক্ষোভ আরো বাড়তে থাকে।

এরপর ২০০১ সালে পরীক্ষাগারে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেশান তৈরির জন্য নোবেল পুরষ্কার পান তিন জন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী – এম-আই-টি’র উলফ্‌গ্যাং কেটেরলি, এবং কলরাডোর এরিক কর্নেল ও কার্ল ওয়াইম্যান। ১৯২৪ সালে সত্যেন বসুর তত্ত্বীয় গবেষণা থেকে উদ্ভূত বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবনের পরীক্ষামূলক প্রমাণ হাতের মুঠোয় চলে এলো। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ বসু নোবেল পুরষ্কার পাননি বলে আমরা আবারো মন খারাপ করি।

সত্যেন বসুর গবেষণা যে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্য ছিল তাতে কারো কোন সন্দেহ নেই। ২০০১ সালের নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানীরাও তা স্বীকার করেছেন তাঁদের নোবেল বক্তৃতায় এবং অন্যান্য সাক্ষাতকারে।

সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাতি (মেয়ের ছেলে) ফাল্গুনী সরকারের সাথে ২০০১ সালের নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এরিক কর্নেল ও কার্ল ওয়াইম্যান।

এবার বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেওয়ার নিয়মগুলো একটু বলে নেয়া যাক। বিজ্ঞানে শুধুমাত্র তত্ত্বীয় গবেষণার জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় না। তত্ত্বীয় গবেষণা যতদিন পর্যন্ত পরীক্ষাগারে সত্য বলে প্রমাণিত না হচ্ছে ততদিন সেই তত্ত্বের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেশান তত্ত্ব পরীক্ষাগারে প্রথম প্রমাণিত হয়েছে ১৯৯৫ সালে। ততদিন পর্যন্ত যদি সত্যেন্দ্রনাথ বসু বেঁচে থাকতেন তাহলে তাঁর জন্য কেউ না কেউ মনোনয়ন পাঠাতেন। ২০০১ সালে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেশানের জন্য পুরষ্কার দেয়া হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ বসু যদি ঐ সময় বেঁচে থাকতেন তাহলে নিশ্চিন্তভাবে বলা যায় তিনি নোবেল পুরষ্কার পেতেন। নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার জন্য সশরীরে বেঁচে থাকাটাও জরুরি, কারণ মৃত ব্যক্তিকে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার নিয়ম নেই। কোন কোন তত্ত্ব পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হতে বেশিদিন সময় নেয় না। তখন সেই তত্ত্ব যিনি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি দ্রুত নোবেল পুরষ্কার পেয়ে যান। যেমন পল ডিরাক পজিট্রনের তত্ত্ব দিয়েছিলেন ১৯২৮ সালে। ১৯৩২ সালে পরীক্ষাগারে পজিট্রন পাওয়া গেলো। ১৯৩৩ সালে পল ডিরাক নোবেল পুরষ্কার পেলেন।

নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার জন্য আরো একটি ব্যাপার খুবই জরুরি – তা হলো নোবেল কমিটির কাছে মনোনয়ন পাঠানো। যাঁরা একবার নোবেল পুরষ্কার পান – তাঁরা যতদিন বেঁচে থাকেন ততদিন তাঁদের মতে যাঁরা যোগ্য তাদের নামে মনোনয়ন পাঠাতে পারেন। আবার নোবেল কমিটিও প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের কাছে মনোনয়ন পাঠানোর জন্য আমন্ত্রণ পত্র পাঠান। নিজের ইচ্ছেয় মনোনয়ন পাঠানোর কোন সুযোগ নেই। কে কাকে মনোনয়ন পাঠিয়েছে তা নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পরবর্তী পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত গোপন থাকে। অর্থাৎ ২০১৮ সালে নোবেল পুরষ্কারের জন্য কে কে মনোনয়ন পেয়েছিলেন তা জানা যাবে ২০৬৮ সালের পরে। ১৯০১ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত যতগুলো মনোনয়ন পাঠানো হয়েছে নোবেল কমিটির কাছে – তা এখন জানা যাচ্ছে।

নোবেল কমিটির রেকর্ড থেকে দেখা যাচ্ছে সত্যেন বসুকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার জন্য শুধুমাত্র চারটি মনোনয়ন পাঠানো হয়েছিল। প্রথম বার ১৯৫৬ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক কেদারেশ্বর ব্যানার্জি, দ্বিতীয় বার ১৯৫৮ সালে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দৌলত সিং কোঠারি, এবং সর্বশেষ ১৯৬২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটো মনোনয়ন পাঠান প্রফেসর এস এন বাগচি ও প্রফেসর এ দত্ত। আইনস্টাইন সত্যেন বসুকে মনোনয়ন দেননি, ডিরাকও নয়। ইওরোপের অনেক নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানীর সাথে জানাশোনা ছিল সত্যেন বসুর। তাঁদের কেউই তাঁর জন্য মনোনয়ন পাঠাননি। এমনকি সি ভি রামন বা মেঘনাদ সাহাও সত্যেন বসুর জন্য মনোনয়ন পাঠাননি। আমরা হয়তো এতেও ক্ষুদ্ধ হচ্ছি। কিন্তু আসলে তার কোন দরকার নেই। কারণ নোবেল পুরষ্কার শুধুমাত্র কয়টা মনোনয়ন গেলো তার উপর নির্ভর করে না। যে সময়ে সত্যেন বসুর জন্য মনোনয়ন পাঠানো হয়েছিল – সেই সময়ে সত্যেন বসুর তত্ত্ব নিয়ে পরীক্ষাগারে কোন অগ্রগতিই হয়নি। তাই নোবেল কমিটি সত্যেন বসুকে নিয়ে কোন রিপোর্টও তৈরি করেনি। সত্যেন বসু নোবেল পুরষ্কার পাননি তাতে কী হয়েছে! তাঁর তত্ত্ব ইতোমধ্যেই ২০১৩ সালের হিগ্‌স বোসনসহ  চার বার নোবেল পুরষ্কার পেয়ে গেছে। আর কী চাই?