শিল্প সাহিত্য

স্বপ্নের শহর আর সিআরবি

— রবীন গুহ

আমার বন্ধু ইউরি। জন্মসূত্রে  ইউক্রেনের বাসিন্দা। স্কুল জীবন শেষে মস্কো আসে সেই নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। এখন সে রুশ নাগরিক, পুরুদস্তুর মস্কোভিচ। মানে মস্কোর স্হায়ী বসবাসকারী। যদিও আজকাল পারিবারিক ও ব্যবসায়িক কারণে আমেরিকাতেই থাকে বেশি। ওর মা কিন্তু এখনো সেই ইউক্রেনের প্রত্যন্ত গ্রামেই থাকে।

মস্কোতেই তার সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। অনেক ভাল-মন্দ সময়ে একজন আরেকজনের পাশে থাকার চেস্টা করেছি। যদিও প্রায় দুইযুগের বন্ধুত্ব, তবুও জীবনের প্রয়োজনে দূরত্ব বেড়ে যায়। যোগাযোগ কমে যায়। সম্পর্কের বন্ধনও কখনো কখনো ঢিলেঢালা হয়ে যায়! অনেকদিন পর আজকে সকালে উঠে হোয়াটসআ্যাপে ওর ম্যাসেজ পেলাম।একসাথে একগাধা প্রশ্ন। আরব দেশের মানুষেরা বা অনেক সময় ইহুদী বংশোদ্ভুতেরাও কুশল বিনিময়ের সময় এরকম একসাথে অনেক প্রশ্ন করে।

প্রিভেত ( হ্যালো!)

কাক দেলা? ( কেমন আছিস?)

কাক মামা? ( মা কেমন আছেন?)

কাক ঝেনা? ( বউ কেমন আছে?)

কাক ব্রাত? ( ভাই কেমন আছে?)

কাক দেতি? ( বাচ্চারা কেমন আছে?)

উ তিবিয়া সো খারাশো? ( তোর সব কিছু ভাল তো? )

আমিও সকালের নাশতা সেরে টেলিফোন হাতে বসলাম। ওর ম্যাসেজের উত্তর দেয়ার জন্য। সাথে ওর মত করেই অনেকগুলো প্রশ্ন!

প্রিভেত (হ্যালো! )

উ মিনিয়া সো খারাশো ( আমার সব খবর ভালো।)

কাক সাম? ( তুই নিজে কেমন আছিস?)

তি সিচাছ গিদিয়ে? ( তুই এখন কই আছিস?)

কাক মামা? ( মা কেমন আছে?)

কাক সিমিয়া? ( পরিবারের সবাই কেমন আছে? )

কাক দেতি? ( বাচ্চারা কেমন আছে? )

খুব সকালে উঠেই নস্টালজিক হয়ে পড়লাম। কখনো কখনো স্মৃতির জগতে জবর কাটতে ভালই লাগে! যেন টাইম মেশিনে চড়ে সেই দিনগুলোতে পৌছে যাই। ঠিক পঁচিশ বছর আগে।

– প্রিভেত রবীন! ( হ্যালো রবীন! )

– প্রিভেত ইউরি! ( হ্যালো ইউরি! )

– কাক দেলা? (কেমন আছিস? )

– নরমালনা ( ঠিকঠাক )

– তোর কী মন খারাপ?

– একটু!

– ক্যান?

– দেশে চলে যেতে ইচ্ছা করছে!

– আচ্ছা তোর কী সমস্যা?

– বললাম তো দেশের কথা মনে পড়ছে!

– এত সুন্দর একটা শহর মস্কো, এখন তোর মন খারাপ করার কী কারণ! চল, বাইরে থেকে কোথাও ঘুরে আসি। বেড়ানোর জন্য কত সুন্দর সুন্দর জায়গা এ শহরে। কত পার্ক, থিয়েটার, স্টেডিয়াম, মিউজিয়াম আরো কত কিছু। তোর যা কিছু ভাল লাগে সবই এখানে পাবি!

– তাই যদি হয়, তবে তোরা রাশিয়ানরা ছুটি পেলেই আর দেরী না করে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে ছুটে যাস কেন? আর একবার ওখানে গেলেই নাকি সবকিছু ফেলে ফিরতে ইচ্ছে করেনা!

– সে তো সমুদ্রের জন্য, নদীর জন্য, পাহাড়ের জন্য। মানে নগরজীবনের দালান-কোঠা আর কৃত্রিমতা ছাড়িয়ে প্রকৃতির কাছে যাবার জন্য!

– তাই! আমিও তো সেজন্যই নিজের শহর চট্টগ্রামেই ফিরতে চাই। বাসা থেকে দুমিনিট হাটলেই ডিসি হিল, পাঁচ মিনিটে আসকারদীঘি, দশ মিনিট হাটলে পাহাড়ী নদী কর্ণফুলী, গাড়িতে চড়ে দশ মিনিটে ফয়েজ লেক আর কুড়ি মিনিটে সমুদ্রের কাছে চলে যাওয়া যায়। এখানে আমার মা থাকেন, আমার বোন, আমার ছোটবেলার খেলার সাথীরা আর আমার সকল প্রিয়জনেরা যাদের ছাড়া জীবনের সব আয়োজন, সব উৎসব অধুরা লাগে! এখানে সবুজে ঘেরা পাহাড় ভালবাসায় আলিংগন করে। আর নদীও নারীর মত কথা কয়’! এখানকার আলো, এখানকার বাতাস পবিত্র থেকে পবিত্রতর, পবিত্রমত! যতটা পবিত্র হিন্দু ধার্মিকের কাছে বেদমন্ত্র অথবা সত্যিকার মুসলমানের কাছে কোরানের আয়াত!

– তোর মত আবেগী মানুষেরা যে কেন মায়ের কোল ছেড়ে পরবাসী হয়!

টানা প্রায় দুবছর ধরে দেশেই আছি। করোনার কারণে দেশের বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি। আমার ছোটবেলার সেই চাটগাঁ শহরেই আছি। কিন্তু সবকিছুই কেমন যেন হযে গেছে। আমার ছোটবেলার সেই শহর এখন স্বপ্নে আছে, বাস্তবে নেই! আমার ডিসি হিল এখন ডিসি সাহেবের বাড়ির উঠান, উনার বাড়ির উঠেনে কৃপা হলে ঢুকতে দেন, না হলে দেন না! আমার খেলার মাঠ সার্কেট সার্কিট হাউস, আউটার স্টেডিয়াম এখন দখল হয়ে গেছে। সেখানে এখন বড়লোকের জন্য সুইমিং পুল আর শিশুপার্ক। আসকারদীঘি পাড়ের সব বস্তিবাসীদের ময়লা এসে পড়ে এখন দীঘিতে। ময়লা দুর্গন্ধ পানি দেখলে এখন আর বিশ্বাসই হয়না একসময় সার্কিট হাউস বা আউটার স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা শেষে এখানে গোসল করতাম! লালদীঘির পানিতে এখন আর মাছের খেলা দেখা যায়না ইচ্ছেমত। সেটাকেও কারা যেন নিয়ন্ত্রণ করে । মাঝে মাঝে ঢোকা যায়, আবার কখনো কখনো ঢুকতে না পেরে ফিরে আসতে হয়। কর্ণফুলীর সেই জৌলস আর নেই!  ভুমিদস্যুদের উৎপাতে কোনমতে বেঁচে-বর্তে আছে। বিবর্ণ জলে সেই রূপ-যৌবনের ছোঁয়া যেন আর নেই!  চতুর্দশী তরুণীর মত ছলাৎ ছলাৎ করে নেচে বেড়ানোর কথা আজ তার মনেই নেই। ছোট ছোট পাহাড় টিলা কেটে কেটে রাস্তা বা ঘর-বাড়ী নির্মান করা হয়ে গেছে। সেই বাটালী হিল, জিলাপী পাহাড়, ফয়েজ লেক সবকিছুই আজ পণ্যের দামে বিকিয়ে গেছে।

আমাদের এ শহরটার সবকিছুই মনে হ্য় গেছে! সবেধন নীলমনি নগরের পাঁজর ঘেষে বেঁচে আছ এক চিলতে প্রাণ, এক টুকরা সবুজের সমারোহ। শ্বাস নেয়ার জন্য একটু জায়গা। সেটাতেও বেনিয়াদের নজর পড়েছে! আমরা কি পারবো এইটুকু অন্তত: বাঁচাতে। ইট-পাথরের দালান-কোঠা ছাড়া প্রকৃতির কোন দানই কী আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য রেখে যেতে পারবোনা?