বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা

– বিজন সাহা

(৪)

কিছুদিন আগে একটা লেখা চোখে পড়ল।
«অক্ষয় কুমার দত্ত উপাসনা বা প্রার্থনায় বিশ্বাসী ছিলেন না। একবার কোলকাতার হিন্দু হোস্টেলের কিছু ছাত্র তাঁকে প্রার্থনার সাপেক্ষে প্রশ্ন করে। অক্ষয় কুমার তাদের পাল্টা প্রশ্ন করেন — কৃষক পরিশ্রম করে কি পায়?   তারা সমস্বরে উত্তর দেয় — শস্য।
এবার  তিনি ছাত্রদের প্রশ্ন করেন — কৃষক পরিশ্রমের সঙ্গে যদি প্রার্থনা করে, তাহলে কি পাবে?   তারা একসঙ্গে বলে উঠে  — শস্য।  তখন তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করেন  —
কৃষক এই যে প্রার্থনা করল, তার জন্য বাড়তি কিছু পেল কি?  তারা বলল — না।
অক্ষয় কুমার তখন বলে উঠলেন – তাহলে প্রার্থনার মূল্য দাঁড়াল শূন্য।
তিনি গণিতের সমীকরণ দিয়ে ছাত্রদের দেখালেন

পরিশ্রম = শস্য।
পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য ।
অতএব প্রার্থনা = শূন্য।»

এখানে আরেকটা প্রশ্ন হতে পারত, কৃষক যদি পরিশ্রমের পরিবর্তে শুধু প্রার্থনা করত, তাহলে কি পেত?  উত্তর আসত – শূন্য।

এখন বলছি কেন এ গল্পটা বললাম। আমরা বরাবর শুনে এসেছি
পুঁজি + শ্রম = সারপ্লাস ভ্যালু।
যদি শ্রম না দেওয়া হয় তবে ক্যাপিটাল পরিবর্তিত হয় না, সারপ্লাস ভ্যালু তৈরি হয় না। ক্যাপিটাল নয়, শ্রমই আসল। কিন্তু কথাটা হল ক্যাপিটাল ছাড়া শুধু শ্রম দিয়ে কি কিছু হয়? তাই যদি হত, শ্রমিক কেন ভাল থাকে না। তার মানে হল পুঁজি + শ্রম = সারপ্লাস ভ্যালু এই সমীকরণে পুঁজিও শ্রমের মতই গুরুত্বপূর্ণ। এরা পরস্পরের পরিপূরক। আমার মনে হয় সমাজতন্ত্রের সৈনিকদের অনেকেই পুঁজির এই পজিটিভ দিকটা দেখে না, শুধু  এর নেগেটিভ দিক দেখে পুঁজিকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবেই  গণ্য করে। যীশু খ্রিষ্ট খাজনা সম্পর্কে বলেছিলেন “সিজারকে তাঁর প্রাপ্য দাও, ঈশ্বরকে তাঁর।” যেভাবেই বলিনা না কেন, কথাটা হল সবাইকে তার যোগ্য মর্যাদা না দিলে বিপদ ঘনিয়ে আসে। এক্ষেত্রে মাও জে দং এর চড়ুই নিধন কর্মসূচির কথা মনে করা যেতে পারে। চড়ুই নিধন করে ফসল বাঁচানো যায়নি, কেননা চড়ুই যাদের হাত থেকে শস্য রক্ষা করত সেই পোকামাকড়দের নিয়ন্ত্রণ করার কেউ ছিল না। প্রকৃতিতে সবই পরস্পরের সাথে জটিল সম্পর্কে আবদ্ধ। এমনকি মানুষে মানুষে যে সামাজিক সম্পর্ক সেটাও তৈরি হয়েছে প্রকৃতির কাছে শিখে, প্রকৃতির অনুকরণে। তাই সেটাকে ছিন্ন করা মানে বিভিন্ন ধরণের বিপর্যয় ডেকে আনা। প্রাকৃতিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে সমাজ গঠন করতে গেলে সেটা কতটুকু স্থিতিশীল হবে সেটা বলা কষ্ট। তাই পুঁজি আর শ্রমের পারস্পরিক সম্পর্ক মানতে হবে, ভাবতে হবে ঠিক কীভাবে সেই সম্পর্ককে মানব কল্যাণে সবচেয়ে কার্যকর ভাবে ব্যবহার করা যায়।

উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন «গণতন্ত্র দেশ শাসনের জন্য খুব ভাল পদ্ধতি নয়, তবে মানব জাতি এখনও এর চেয়ে ভাল কিছু তৈরি করতে পারেনি।» মোটামুটি একই কথা বলা যায় সমাজতন্ত্র সম্পর্কে। তবে সেটা দেশ শাসনের ক্ষেত্রে নয়, দেশের সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে। মনে রাখতে রাখতে সমাজতন্ত্র যতটা না রাজনৈতিক তার চেয়েও বেশি করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আর সঠিক ভাবে বলতে গেলে জাতীয় সম্পদ বন্টনের তত্ত্ব। আর সেটা মানব সমাজের মঙ্গল করে বলেই বিভিন্ন উন্নত দেশ নিজেদের ওয়েলফেয়ার স্টেট হিসেবে গড়ে তুলছে। যদিও সেটা সমাজতন্ত্রের মূল তত্ত্ব থেকে অনেক দূরে, তবুও বন্টনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সমাজতন্ত্রের নীতি মেনে চলার চেষ্টা চলছে। তাই আমাদের ভেবে দেখতে হবে কোন পথে আমরা যাব, পুঁজির সাথে আমাদের সম্পর্ক কি হবে, এক কথায় বর্তমান বাস্তবতার সাথে মিল রেখে আমাদের এই তত্ত্ব নিয়ে বা তত্ত্বের ব্যবহার নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

যখন বাম রাজনীতি শুরু করি আমাদের এ নিয়ে পড়াশুনা করতে হত। অনেক সময় স্থানীয় বা ঢাকা থেকে আসা কমরেডরা ক্লাস নিতেন। সেখান থেকেই জেনেছি  সমাজতন্ত্রের অর্থনীতির কথা। বলা হত «এই অর্থব্যবস্থায় জাতীয় আয় বণ্টনের মূলনীতি হল প্রত্যেকে তার নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে»। অন্যদিকে সাম্যবাদের অর্থনীতি সম্পর্কে বলা হত «সাম্যবাদে মানুষ নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করবে এবং সে প্রয়োজন অনুযায়ী ভোগ করবে»। সে সময় সমাজতন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন রকমের অপপ্রচার ছিল। একদল সমাজতন্ত্রের গুনগান করতে গিয়ে সোভিয়েত ব্যবস্থাকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরতেন। অন্যদল উঠতে বসতে এর নিন্দা করতেন। মনে পড়ে যখন আশির দশকে বাড়িতে বেড়াতে গেছি  অনেকেই সোভিয়েত সমাজের কমবেশি সাম্যকে এভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন যে এখানে যান্ত্রিকভাবে সবাইকে সমান করা হয়। তারা বলতেন হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান হয় না, সব মানুষও তেমনি সমান হতে পারে না। কথাটা ফেলে দেবার মত নয়। যেমন ধরুন আমাদের দেশের স্কুলের কথা। অনেকেই ভর্তি হয়, তবে কেউ প্রথম হয়, কেউ বা দশম। সেখানে সবার জন্য কমবেশি সমান কন্ডিশন থাকলেও এটা ঘটে। শুধু তাই নয়, অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তান প্রথম হয়। আবার এটাও দেখা যায় একজন ভাল ডাক্তার হয়, অন্যজন ভাল খেলোয়াড়। তাই বলা যেতে পারে প্রাকৃতিক ভাবেই প্রতিটি মানুষ ভিন্ন। তাই একদিকে যেমন চেষ্টা থাকতে হবে  নিজেকে বিকাশের ক্ষেত্রে সবার জন্য কমবেশি সমান সুযোগ তৈরি করার, অন্যদিকে যে যে বিষয়ে প্রতিভাবান,  সে যাতে সেই রকম শিক্ষা পেতে পারে তার ব্যবস্থা করাও জরুরি। সেটা সোভিয়েত ইউনিয়নে কমবেশি ছিল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, যদি পরবর্তী জীবনে, মানে কর্ম জীবনে তার যোগ্য মর্যাদা না পায়, তখন শুরু হয় সমস্যা। সে সময় দেখা যেত একজন দক্ষ কর্মী যে বেতন পায়, যে কোন কাজ করে না, সেও তাই পায়। যদিও মাঝে মধ্যে দক্ষ কর্মীকে  বিভিন্ন উপহার দেওয়া হত, সেটা আর যাই হোক তাকে কাজে ততটা উৎসাহী করত না, কেননা সেটা অনেক সময়ই নির্ভর করত বসদের মর্জির উপর। আর সবচেয়ে বড় কথা যারা শুধুমাত্র ১০ টা ৫ টা অফিস করেই  যারা সময় কাটাত তাদেরও কাজ করার প্রতি আগ্রহী করে তুলত না। তাই সাম্যের কথা বলা আর সেটা বাস্তবায়ন করা এক কথা নয়। সাম্যের কথা বলতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষ রোবোট নয়, প্রতিটি মানুষের চাহিদা আলাদা, ইন্টারেস্ট আলাদা। আর সেটা মনে রেখেই সাম্যের ভাবনা ভাবতে হবে।

পড়ুন  বিজ্ঞান ভাবনা – ৩

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া